আমরা অসহায়

মোহাম্মদ আসাদ উজ জামান

আজ আমার পরিচয়ে আমি বলতে চাই – আমি একজন অসহায় মানুষ। আমি যেমন অসহায়, আপনিও তেমন অসহায়, এবং আজ আমরা সবাই অসহায়। তবে দুদিন আগেও আমরা হয়ত অসহায়ই ছিলাম। কিন্তু ওভাবে বুঝে উঠতে পারিনি। গাড়ি এক্সিডেন্টে পড়তে পারতাম, বাড়িতে আগুন লাগতে পারত, শরীরে বড় কোন রোগ বাসা বাঁধতে পারত ... তখনও আমরা অসহায়ই ছিলাম। অসহায় বলতে এটাই – যখন হাতের কোন কিছুই যুক্তিগ্রাহ্য ভাবে কাজে লাগিয়ে মানসিক স্বস্তি পাওয়া যায় না। তবে আজকের অসহায় অবস্থা যেন অন্যরকম। বাড়ির দোরে দোরে ঢাকঢোল পিটিয়ে কেউ যেন বলছে – তোমরা অসহায়, তোমরা অসহায়। বাড়ির দোরে দোরে অসহায়ত্বের ঢোল বাজানো সত্ত্বাটা খুবই ক্ষুদ্র, যাকে খালি চোখে দেখা যায় না, বর্তমান বিশ্বের সবচে আলোচিত সত্ত্বা, যা কি না একটি ভাইরাস, নাম করোনা। করোনা ভাইরাসের কারণেই আজকের এই অসহায় অবস্থাটা পুরো পৃথিবী ব্যাপি ছড়িয়ে পড়েছে। বলতে গেলে পুরো পৃথিবীটাই অসহায় হরে পড়েছে, কেউ যেন ওকে থামিয়ে দিতে চাইছে। ব্যবসা বাণিজ্য যাতায়াত শিক্ষা ভিসা আমদানি রফতানি চিকিৎসা ... এমন কিছু নেই যার উপর করোনার প্রভাব পড়েনি। ইতিমধ্যেই প্লেনের যোগাযোগে বড় ধরণের ধ্বস নেমে গেছে, হোটেল মোটেল ব্যবসা চলছে খুবই অল্প পরিসরে, রাজনৈতিক সমাবেশ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বড় ধরনের অনুষ্ঠানগুলো স্থগিত হয়ে যাচ্ছে, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে, ... এমনকি বিশ্ব নেতারা তাদের রাষ্ট্রীয় সফর পর্যন্ত বাতিল করতে বাধ্য হচ্ছেন।  

তবে এই অসহায়ত্বের মাঝেও দুটো বড় বার্তা আছে। প্রথম বার্তা হল, পরিষ্কার। বলা হচ্ছে হাত পরিষ্কার রাখতে হবে। সুন্দর একটি বার্তা। হাতের সঙ্গে হাতের কাজও পরিষ্কার রাখতে পারলে ভালো হত। তা না হলে কি হাত সব সময় পরিষ্কার রাখা যায়! হাতের কাজের সঙ্গে চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার রাখতে হবে। সঙ্গে পরিষ্কার রাখতে হবে মুখের ভাষা। এর চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে আমাদের চিন্তা বা মনন! হাত থেকে চিন্তার পরিচ্ছন্নতা পর্যন্ত একটি প্যাকেজ, একটির সঙ্গে অন্যটিও জড়িত। চিন্তা অপরিষ্কার রেখে হাতের কাজ বা হাত পরিষ্কার করা বেশ কঠিন। এখন প্রশ্ন হল, চাইলেই কি সব কিছু একসঙ্গে পরিষ্কার রাখা যায়! সব কিছু একসঙ্গে পরিষ্কার করার কোন উপায় নেই। অর্থনৈতিক অবস্থার উপর নির্ভর করে এই শহরের মানুষ মেসে থাকে, এক রুমের বাসায় থাকে, ছোট এপার্টমেন্ট থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকে ... জীবনের তাগিদে কতভাবেই না মানুষকে থাকতে হয়। হাত পরিষ্কার করা একটু সহজ। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ঘরের দরজার হাতল, ফ্রিজের হাতল, ফোন, চাবি, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, কীবোর্ড ... চাইলেই কি সব এক সঙ্গে পরিষ্কার করা যায়? বিছানার চাদর পরিষ্কার করা যায়, কিন্তু তোশক কি কোন সহজ উপায়ে পরিষ্কার করা যায়! পাবলিক বাসের সিট কীভাবে পরিষ্কার করা হয় কারোর জানা আছে? রিক্সা, গাড়ি, ট্রেন, লঞ্চ, পাবলিক প্লেসের চেয়ার টেবিল ... চাইলেই আমরা পরিষ্কার করতে পারছি না। সবাই ভীষণ একটা অস্বস্তির মাঝে পড়ে গেছে। চাইলেই পুরো একটি শহর ধুয়ে পরিষ্কার করে যায় না; ঢাকাকে ধুয়ে ফেললে সব ময়লা চলে আসবে আমাদের রাস্তায়, ড্রেনে, নদীতে, মাঠে ... এবং শেষমেশ সেই আবার আমাদের ঘরের দোরে! সমাজে পরিস্কারের একটা কালচার থাকতে হয়, যে কালচার আমাদের বর্তমান সমাজে নেই। তাই এই অসহায় অবস্থা কাটিয়ে উঠার জন্য আমরা কিন্তু অবস্থা বুঝার দিকে গুরুত্ব দিতে পারি। খাওয়ার আগে হাত ধুতে হবে, পরিষ্কার প্লেটে পরিষ্কার খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এরপর যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব ততটুকু পরিষ্কার রাখতে হবে। 

বর্তমান অসহায়ত্বের দ্বিতীয় বার্তাটি হল সব মানুষই সমান। করোনা যেন সবাইকেই এক কাতারে নামিয়ে এনেছে। এই একটি মাত্র কারণেই সবাই সমান অসহায়। ধনি গরিব সবার মাঝেই যেন সমান অসহায়ত্ব, ইংল্যান্ডের রানিকেও ছেড়ে যেতে হচ্ছে তার প্রাসাদ। উন্নত বিশ্বের বড় বড় শহরেও মানুষের সাধারণ চলাফেরার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা চলে এসেছে। প্রভাবশালি অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা বাসায় থেকে অফিসের কাজ করছেন। কারোর পক্ষেই কোন দায় নেয়া সম্ভব না। 

দুটো বার্তার পরেও এই অসহায়ত্বের মাঝে বড় একটি আবেদন আছে – আমিও যেমন অসহায়, তুমিও তেমন অসহায়। এই অবস্থায় আমরা চাইলেই পাশের জনের দিকে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারি, বাস্তবের হাত না, সহমর্মিতার হাত। দোকানে গিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস যেন বেশি না কিনি। বরং আগে যা কিনতাম, আমরা চাইলেই তার চেয়ে সামান্য একটু কম কিনতে পারি। মনে রাখতে হবে, আমার মত অন্যরাও সমান অসহায়! এতে করে বাজারে একটি স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করতে পারে।

সম্মিলিত ভাবে এই অসহায় অবস্থা কাটানোর জন্যে সামগ্রিক অবস্থাটা আমাদের না বুঝলেও চলবে। কিন্তু সাধারণ কিছু বিধিনিষেধ অবশ্যই মেনে চলতে হবে। বিশেষ করে সরকার ঘোষিত কোন বিধিনিষেধ। এখন কারো জ্বর হলে, এমনকি সাধারণ জ্বর হলেও, নিজের বাসাতেই থাকতে হবে। এই জ্বর নিয়ে দূরে কোথাও, যেমন দেশের বাড়িতে, যাওয়া ঠিক হবে না। কেননা করোনার কারণে মানুষও যেন করোনা হয়ে উঠেছে। করোনা একটি সংক্রমক রোগ, মানুষের মাধ্যমেই ছড়িয়ে যেতে পারে অন্য মানুষে। নিজের সুস্থতার জন্যেই অন্যকে সুস্থ রাখতে হয় – এই বার্তাটি করোনা নতুন করে আমাদের সামনে এনে দিয়েছে। করোনা ভাইরাস খুবই নতুন, এখনো পুরোপুরি এর গতিবিধি সহ সমস্ত কিছু জানা যায়নি। এর জন্যে আরো সময় দরকার। এক্ষেত্রে সবচে ভালো হল কোন ধরনের জ্বর হলেই বাসা থেকে না বেরোনো। বাসার ভেতরে অন্যদের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রাখতে পারলে খুবই ভালো। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের প্রয়োজন হলে নিজে বাইরে না গিয়ে বাসার অন্য কাউকে দিয়ে আনানো যেতে পারে। যিনি বাইরে যাবেন তিনিও যেন অন্যদের সঙ্গে যথাসম্ভব একটু দূরত্ব বজায় রাখেন। বাসায় একসঙ্গে বন্দি থাকার অভ্যেস আমাদের খুব একটা নেই। এই সময়ে দরকার চিন্তার পরিচ্ছন্নতা। এটাও একদিন সম্ভব না হলেও, একটু দূরত্ব বজায় রেখে সবার অনুভুতিকেই এখন সম্মান করা দরকার। তা না হলে বাবা মা ভাই বোনের চারজনের ঘরেও মানসিক অশান্তি চলে আসতে পারে, একদিকে করোনা নিয়ে চলমান অসহায় অবস্থা, অন্যদিকে মানসিক অশান্তি, জীবন হয়ে উঠতে পারে দুর্বিষহ! এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ চলছে। বাবা মায়েরা যেন সন্তানদের উপর লেখাপড়ার চাপটা বেশি না দেন। সব সময় পড়া যায় না, নিজেদের ইচ্ছেতে সন্তান যতটুকু পড়ে তাতেই খুশি থাকতে হবে। ওদের সঙ্গে ঘরের খেলাধুলা বা অন্য ভাবেও আনন্দময় সময় কাটানোর চেষ্টা করতে হবে, কারণ আপনার আপনার সন্তানও অসহায়, হয়ত ওরা একটু বেশি, কারণ তরুণদের স্বভাবই এদিক ওদিক ছুটে বেড়ানো। 

নিজেদেরকে যেমন বাসায় রাখতে হবে, তেমনি চাইলে যারা বাইরে থেকে নিয়মিত এসে বাড়িতে কাজ করেন, তাদেরকে কিছুদিন আসতে না দেয়া। এটা আপনার এবং তার দুজনের স্বার্থেই। কিন্তু এক্ষেত্রে একটি বিবেচ্য বিষয় হল তার নিয়মিত বেতন। এরজন্যে আপনার মনের কথা শুনলেই আপনার জন্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে। একই সঙ্গে চাইলে ছোটদের প্রাইভেট টিউটর বন্ধ করে দিতে পারেন।   

এখন প্রশ্ন হল, সব কিছু পরিষ্কার করে ফেললেও কি করোনা জনিত বিপর্যয় বা দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব! ব্যাপারটা বোধকরি এত সহজ নয়। প্রকৃতি জগতের নিজস্ব একটি নিয়ম আছে। সেই নিয়ম ধরেই প্রকৃতি এগিয়ে যাবে। কাজে কর্মে চিন্তায় সমস্ত কিছুতেও পরিশুদ্ধ হলেও একজন মানুষের জীবনে যে কোন দুর্ঘটনাই ঘটতে পারে। কারণ সে প্রকৃতি জগতের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ, তার জন্যে বিশেষ কোন নিয়ম নাও থাকতে পারে। তবে একজন সব কিছুতেই পরিষ্কার থাকলে হয়ত জীবনের যে কোন ঘটনাই অপেক্ষাকৃত সহজ ভাবে সামাল দেয়া সম্ভব। কিন্তু এর জন্যে প্রস্তুতি নিতে হয় অনেক আগে থেকে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতির জন্যে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোও প্রস্তুত আছে বলা যাবে না, কারণ করোনা সম্পর্কে এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে সবাই সবার সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছে।  

সবাই যখন সমান অসহায়, তখন সমাজে অধিকার বলে কিছু নেই। কাঙ্ক্ষিত সেবা কেউ না দিলেই তার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগা একেবারেই ঠিক হবে না। এমনকি একজন ডাক্তার, যিনি একজন মানুষও বটে এবং আপনার মত আজ তিনিও অসহায়, তিনিও নিজের অসহায়ত্বের কারণে বিশেষ ক্ষেত্রে আপনাকে সেবা নাও দিতে পারেন। তার অসহায়ত্বকেও সম্মানের চোখে দেখতে হবে। দুই একটি জায়গায় জিনিষপত্রের দামে এদিক সেদিক হতেই পারে। যিনি বেশি দাম রাখছেন, তিনি হয়ত কিনেছেনও বেশি দামে। সম্ভব হলে অন্য কোথাও যদি কম দামে পাওয়া যায়, কিনতে পারেন। অথবা সে দোকান থেকেই বেশি দামে নিলেন, তাই বলে এটাকে ইস্যু বানাতে যাবেন না যেন। এটাও একটু মানতে শিখতে হবে। ব্যক্তি অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়ে ছোট খাট গোলযোগ এড়িয়ে চলাটাই বেশি দরকার; কারণ আপনিও অসহায়, তিনিও অসহায়। যদিও আপনার দৃষ্টিতে তাকে অসহায় নাও মনে হতে পারে। এতে করে সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যেতে পারে। বেঁচে থাকাটাই যখন প্রধান ইস্যু, তখন সবাই মিলে বাঁচার চেষ্টা করাটাও আনন্দের হতে পারে।  

একদিন এই করোনা জনিত অসহায়ত্ব শেষ হয়ে যাবে। একটি বিপর্যয়ের আগে অথবা পরে। কিন্তু শেষ হবেই। কিন্তু এর শিক্ষাটা আমাদেরকে আঁকড়ে ধরতে হবে। করোনার সবচে বড় শিক্ষা হল – প্রকৃতি মিথ্যা বুঝে না। শিক্ষাতে কোন কলুষতা থাকতে পারবে না। শিক্ষা হল তাই যা দিয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রেখে নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখা যায়। এই বর্তমান অসহায়ত্ব থেকে নির্দ্বিধায় শিক্ষার একটি নতুন সংজ্ঞা দেয়া যায়, শিক্ষা আসলে তাই যা থাকলে আমরা আমাদের হাত পরিষ্কার রাখতে পারি, হাতের কাজ পরিষ্কার রাখতে পারি, আমাদের দৃষ্টি পরিষ্কার রাখতে পারি, এমনকি নিজেদের চিন্তাকে পর্যন্ত পরিষ্কার রাখতে পারি। সমাজের বেশিরভাগ মানুষের মাঝে এই পরিচ্ছন্নতা চলে এলে সেই সমাজের মাটি, পানি, বাতাস, ... পরিষ্কার থাকবে, অর্থাৎ প্রকৃতি পরিচ্ছন্ন থাকবে। আর এই পরিচ্ছন্নতা থাকলেই নিষ্ঠার সঙ্গে সবাই মিলে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারব। তবে, এই অসহায়ত্ব কীভাবে কাটবে এটা যেমন আমরা কেউই জানি না, তেমনি এটা কাটিয়ে উঠার আগেই অর্থনীতিতে বড় ধরণের একটি বিপর্যয় নেমে আসবে, যা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে, এই বিপর্যয় বিশ্বব্যাপী। এই বিপর্যয়ের সঙ্গে জড়িত সার্বিক আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন অবনতি না হয়, এর জন্যে প্রস্তুত থাকার একটিই উপায় – অবস্থা বুঝে নিজেকে যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করা। আজ আমরা সবাই সমান অসহায়, এর থেকে পরিত্রাণের জন্যেও সবাইকে চেষ্টা করতে হবে। তা না হলে আমরা হয়ত কিছুই ভালো ভাবে সামাল দিয়ে উঠতে পারব না, বিশ্বব্যাপী একটার পর একটা বিপর্যয় আঘাত করতে পারে।           

লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন