করোনাকাল

আশা টুকু বেঁচে থাকুক!

সজল চৌধুরী

সময়ের আবর্তে আমরা আজ চলছি এক লাগাম হীনতার মধ্যে। যেখানে ভোর থেকে মধ্যরাত অবধি চলছে চার দেয়ালের বন্দীদশার কাব্য। জীবন যেন আজ স্থবির থেকে ক্রমে আরো স্থবির হয়ে যাচ্ছে। দেয়ালে ঝুলানো ছবিগুলো আজ যেন পরম আপন মনে হয়। কতদিন যে খেয়ালই করিনি ফেলে আসা ফটো ফ্রেম এর দিকে। আজ যেন হঠাৎ করে সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। করোনা মহামারী আর সেই স্রোতে আমরা হয়তোবা কোন এক অন্ধকার দিনের অপেক্ষায়। যেদিকে তাকাই সেদিকেই এক হতাশার সুর। সারাদিন কাটে করোনা ভাবনার সাথে। ভার্চুয়াল জগতে শয়ে শয়ে লেখা, মৃত্যুর খবর, কত কবরের গল্প! সবার চোখে যেন এক বিশ্বাসভঙ্গের চিত্রপট। কেন যেন সবাই সন্দেহ ভরে তাকাই পৃথিবীর নীল আকাশের দিকে। যেখানে একসময় তাকাতাম উড়ে যাওয়া পাখিদের দৌড়ঝাঁপ দেখতে। আজ যেন সেখানে দেখতে পাই প্রাণভয়ে ছুটে চলা এক চরম বাস্তবতা।

কত বছরের পুরনো চির চেনা মানুষগুলো আজ অচেনা মনে হয়। তাইতো কাছে আসলেই ভয় লাগে। অথচ আজ থেকে মাস খানেক আগেও এমনটা ছিল না মোটেও। অস্ট্রেলিয়ায় আমার বাসার বাসিন্দা অনেক চেনা ইয়াজিদকেও তাই আজ অনেক অচেনা মনে হয়। সংকোচ আমাদের দুজনেরই। দেখা হলে খুব বেশি সময় কথা হয়না, দাঁড়ানো হয় না, পাছে যদি বাতাসে ভাইরাস ভেসে আসে! দেশে অসুস্থ বাবা-মা, স্ত্রী সন্তানকে দেখি ভার্চুয়াল পর্দায়! কি যেন ভয়, না পাওয়ার কষ্ট সব সময় মনের আড়ালে। আজ আমরা সবাই গৃহবন্ধী। মানুষের জেলখানাতে সব মানুষ নামের মানুষগুলোর শাস্তি না হলেও পৃথিবীর জেলখানাতে আজ আমরা সকলেই বন্দী। কে জানে অপরাধের মাত্রা সইতে না পেরে এ কোন এক প্রকৃতির খেলা জলজ্যান্ত মানব সভ্যতায়?

এইতো জানলাম স্পেনের রাজকুমারী মারিয়া তেরেসার মৃত্যুর খবর! চলে গেলেন জাপানের বিখ্যাত কৌতুক অভিনেতা কেন শিমুরা! প্রতিদিন এভাবেই পড়ে ফেলছি কত অচেনা মানুষের কষ্টকর দিনগুলির খবর, সাবধান বাণী, কত ইতিহাসের গোলকধাঁধা! দেখে ফেলছি কত মানুষের সভ্যতার মানবিক পরিচয়! সেই এক অবসরেই পড়ে ফেললাম ইতালির উপন্যাসিক ফ্রান্সেস্কো মিলান্দ্রির সামনের পৃথিবীর অবয়ব এর কথা। যা তিনি লিখেছেন তার চিঠিতে ঈঙঠওউ-১৯ নিয়ে। এরই ফাঁকে খবর হল আসামির সংখ্যা অনেক কমে গেছে আমাদের দেশে। ঘরের মধ্যে বসবাস করছে কি মন্ত্রী আরকি আমজনতা! অন্যদিকে বাংলার মানুষকে ঘরে ঢুকাতে কতইনা হিমশিম খেতে হচ্ছে আরেক দলের মানুষদের। কত কেরামতি, কত কৌশলে! কেউ কেউ আবার কৌশলের বেড়াজালে নিজেদের মানবিকতাকে ভুলে এককাঠি উপরে উঠেছেন। তাদের নাকি খেয়ালই ছিল না সবাই আমার মত ঘরে থাকলেই পেটের ভাত জোগাড় করতে পারবেন না! অথচ যাদের ঘরই নেই, রাস্তার পাশে পলিথিন মোড়ানো চার বাই চার ফুটের জায়গায় তাদের বসবাস, আর তার সামনের জায়গাগুলো আঙিনা তাদেরকে ঘর চেনাই কিভাবে বলুনতো? এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে ভাইরাস একজন থেকে আরেকজনে, তারপর আরো একজন, এভাবে হাজারে হাজারে পৃথিবীতে।

চলুক তাতে কি? আমরা তো বেশ ভালো আছি। আমাদের সংক্রমণের হার কম। মৃত্যুহার নেই বললেই চলে! কি জানি হয়তো দারিদ্রতা আমাদের ইমিউনিটি কে বাড়িয়ে দিয়ে গেছে! অথবা যে গরমকে এতদিন এতটাই অসহ্য মনে হতো সেটিই আজ নিরাপত্তা বলয়। যদিও শুনতে পাই এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। না থাকলে নাই। আশাটুকু থাকুক! 

সত্যিই আমরা অনেক আশাবাদী। সারা বিশ্ব যখন করণায় সংক্রামিত লকডাউন, ঠিক তখন এই আমরাই নিজ উদ্যোগে সকল বাধা কাটিয়ে একে অপরের খাবার নিয়ে ছুটে চলছি। ডাক্তার, পুলিশ, জনপ্রশাসন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের সেবা করে চলছে। ডাক্তার যখন তাদের নিরাপদ পোশাকের অভাবে হাসপাতালে যেতে সাহস পাচ্ছেনা, রোগী ঠিকমতো দেখতে পারছেনা - এই আমরাই আমাদের যেটুকু সামর্থ্য আছে তাই দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছি তাতে কিছু পাই আর নাই পাই! সামাজিক নেটওয়ার্ক গুলো যখন বিশাল এক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কত চেনা অচেনা মানুষকে যোগসূত্রের মাধ্যমে এক সারিতে দাঁড় করাচ্ছে সামাজিক দূরত্ব মেনে তখন আমরা আশান্বিত হই। পাড়া-মহল্লায় ছেলে-বুড়ো সবাই যখন সংক্ষিপ্ততার মাঝেও নিজ মনোবলে মহামারী কে জয় করতে চায় তখন আশাবাদী হই। যে যার অবস্থান থেকে যখন কিছু একটা করতে চায় তখন সংকল্পিত হই। 

তিনবেলা হতদরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষগুলো তো আজ অন্ততপক্ষে হাত ধোয়া শিখছে! বাতাস দূষণ রোধে মুখে মাস্ক পরছে! সচেতনতায় ভিড়ে যে যার মত বাড়ির আঙিনায় থাকছে! যা হয়ত এত জনবহুল রাষ্ট্র ব্যবস্থায় খুব বেশি সহজ নয়। মানবতার খাতিরে হয়তো কিছু বাড়িওয়ালা বাড়ি ভাড়া নিচ্ছে না, অন্যরা যাদের খাবার নেই তাদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিনামূল্যে চিকিৎসার কথা বলছে। হাসপাতাল তৈরীর কথা বলছে। রাষ্ট্র চিন্তা করছে সমন্বয়ের কথা। দেশকে মহামারী থেকে বাঁচানোর জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে যুদ্ধ করছে বিজন কুমার শীলরা। আর এটিই আমার দেশ, বাংলাদেশ। তাই আশাবাদী। বড় বড় দেশের সাথে তুলনা নয়। সমালোচনা হতে পারে, আশাহত নয়। কে জানে আমরাও সফল হতে পারি? তৈরি করতে পারি একটি উদাহরণ এই শহরে যাকে কিনা আমরাই আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত করে ছিলাম একসময়।

এই আমরাই হয়তো পারবো! আমি তাই কোন ভয়ের কথা লিখছি না, আশার কথা বলছি! নতুন পৃথিবীর কথা! কে জানে এরপরে হয়তো আমরা আরো পাল্টাবো নিজেদের জন্য। নিজেদের নতুন দিনের জন্য। আজ যা পাল্টাচ্ছি ভয়ের জন্য! আর এই আশাটুকুই না হয় থাক জনবহুল খেটেখাওয়া সংগ্রামী মানুষের এই দেশের জন্য। তবে কোন ধরনের অসতর্কতা নয়। কারণ আমাদের যেকোন ধরনের অসতর্কতাই ভবিষ্যতে অনেক বড় বিপদের কারণ হতে পারে।

সজল চৌধুরী

শিক্ষক ও স্থপতি, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের পিএইচডি গবেষক

[email protected]


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন