করোনার ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি

ইয়ান ব্রেমার

নভেল করোনাভাইরাস আমাদের নিত্যদিনের জীবন বদলে দিয়েছে। একই সঙ্গে সংকট ঝুঁকিতে ফেলেছে বিশ্বরাজনীতিকে। কভিড-১৯ মহামারী সমাপ্ত হলেও পুরো দুনিয়া রাজনৈতিক ঝুঁকি থেকে মুক্তি পাবে না, বরং তখনই শুরু হবে মূল ভূরাজনৈতিক খেলা। ২০২০-এর জন্য চিহ্নিত প্রধান কয়েকটি ভূরাজনৈতিক ঝুঁকির ওপর নভেল করোনাভাইরাসের সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন ইয়ান ব্রেমার।

বড় বিভেদ

জানুয়ারিতেই যুক্তরাষ্ট্র চীনের মধ্যে প্রযুক্তিগত যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈরিতা আরো খারাপ চেহারা নিতে পারে বলে আমরা ইঙ্গিত দিয়েছিলাম। নভেল করোনাভাইরাস বিভেদকে আরো এগিয়ে এনেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানুফ্যাকচারিং এবং সার্ভিস সেক্টর এরই মধ্যে চীনের এক্সপোজারকে সামনে রেখে নিজেদের সাপ্লাই চেইন কর্মীদের পুনর্বিন্যাস করছে। এটা সাময়িক পদক্ষেপ হলেও মহামারী দীর্ঘস্থায়ী হলে অনেক ব্যবসাই ধরনের পদক্ষেপ নেবে এবং বিষয়টি স্থায়ী চেহারা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনের মধ্যে বিভেদকে গভীর করবে।

মতামত: নভেল করোনাভাইরাস ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে।

যুক্তরাষ্ট্র বনাম চীন

কয়েক মাস আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র চীনের মধ্য বাণিজ্যিক যুদ্ধ জোর কদমে এগোচ্ছিল। অর্থনীতির পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে প্রভাব বজায় রাখা নিজেদের মূল্যবোধ নিয়েও দেশ দুটির মধ্যে উত্তজনা বেড়েছে। নভেল করোনাভাইরাস উত্তেজনাকে আরো বৃদ্ধি করবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার দলের সদস্যরা করোনাকে চীনা ভাইরাস বলে আখ্যা দিয়েছেন। অন্যদিকে চীনারা দাবি করেছে, কভিড-১৯ যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ল্যাবে তৈরি। এটা স্পষ্ট যে সামনের দিনে যুক্তরাষ্ট্র চীনের মধ্যে উত্তেজনা আরো বাড়বে।

মতামত: নভেল করোনাভাইরাস ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে।

জালিয়াতি! যুক্তরাষ্ট্রকে কে শাসন করবে?

বছরের শেষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এমনিতেই গত নির্বাচন থেকেই নানা ধরনের ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব দেশটিতে ছড়িয়ে পড়েছে। নিজের পছন্দের প্রার্থী এবার জয়ী না হলে দেশটির অর্ধেক ভোটার মনে করবে তাদের নির্বাচন চুরি হয়ে গেছে। নভেল করোনাভাইরাস দেশটিতে রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ি আরো বাজেদিকে নিয়ে যাবে। ভাইরাসের কারণে সশরীরে ভোট দেয়া বন্ধ হতে পারে এবং প্রথমবারের মতো দেশজুড়ে -ভোটিং হতে পারে। রকম পরিস্থিতিতে সামান্য উনিশ-বিশ ঘটলেও মানুষ নির্বাচনের ফলকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে।

মতামত: নভেল করোনাভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে।

ভারত হবে মোদি-ফাইড

জানুয়ারিতে আমার আমাদের প্রতিবেদনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী নীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলাম। রাজনৈতিক নীতি ভারতীয় সমাজ অর্থনৈতিক সংস্কারের দিকে দেশটির প্রগতিকে ব্যাহত করছে। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাস মহামারীকে ভারত সরকার বেশ ভালোভাবে সামাল দিচ্ছে। অবশ্য সামনে কতদিন সাফল্য বজায় থাকবে, সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। নভেল করোনাভাইরাস ভারতে ব্যাপকভাবে আঘাত হানলে তা দেশটিতে সামাজিক সংকটকে আরো উসকে দেবে, যা মোটেও ভালো ফল বয়ে আনবে না।

মতামত: নভেল করোনাভাইরাস ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে।

ভূরাজনৈতিক ইউরোপ

নভেল করোনাভাইরাসের আক্রমণের আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নতুন নেতৃত্বের অধীন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে সম্পর্কে বেশ শক্ত পদক্ষেপ নিতে চেষ্টা শুরু করেছিল। বাণিজ্য নীতি, রাজস্ব বিষয়ে নিয়ম-কানুন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছিল। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্র চীনের পরিবর্তে ইউরোপকে লড়তে হচ্ছে নভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে। লড়াইয়ে সফল হলে ইউরোপ আবার চীন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমানে সমানে কথা বলবে। কিন্তু ব্যর্থ হলে নিজেদের অর্থনৈতিক সংকট তাকে আরো বিপদে ফেলবে।

মতামত: ইউরোপের নিজস্ব অর্থনৈতিক সংকটের ঝুঁকি নভেল করোনাভাইরাস বৃদ্ধি বা হ্রাস কোনোটাই করবে না।

শিয়া প্রভাব

মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া নেতৃত্বাধীন দেশগুলোতেইরান, ইরাক, সিরিয়াযুক্তরাষ্ট্রের ভুল নীতি অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে রেখেছে। তবে গলাবাজি করলেও যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইরান কেউই সরাসরি সামরিক সংঘাতে যেতে চায় না। দেশ দুটো এখন নভেল করোনাভাইরাস সামলাতে ব্যস্ত। মানে এখনো আর কেউই যুদ্ধে যেতে চাইবে না। একই সঙ্গে ইরাক বা সিরিয়ায় করোনার বড় আক্রমণ হলে দেশ দুটির অবস্থা আরো খারাপ হবে।

ফলাফল: নভেল করোনাভাইরাস ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির ঝুঁকি কমালেও সিরিয়া ইরাকে বৃদ্ধি করবে।

লাতিন আমেরিকায় অসন্তোষ

নভেল করোনাভাইরাসের আক্রমণের আগে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল। নতুন বিকশিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি আরো পাবলিক সার্ভিস দাবি করছে এবং সরকারের দুর্নীতি হ্রাসের দাবি তুলেছে, কিন্তু এগুলোর কোনোটাই পূরণ হচ্ছে না। লাতিন আমেরিকায় করোনা এখনো ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো আঘাত হানেনি। তবে সে রকমটা হওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। তেলের দাম কমে যাওয়ায় ব্রাজিল, কলম্বিয়া, একুয়েডর মেক্সিকোর মতো তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো সামনে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে। লাতিন অন্য দেশগুলোয়ও সংকট ছড়িয়ে পড়বে।

মতামত: নভেল করোনাভাইরাস লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক অস্থিরতার ঝুঁকি ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেবে।

তুরস্ক

লাতিন আমেরিকার মতো তুরস্কেও এখনো নভেল করোনাভাইরাস বড় আঘাত হানেনি। তবে করোনা দেশটিতে আঘাত হানবে না, এমনটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। প্রেসিডেন্ট এরদোগানের দল একে পার্টি থেকে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা বেরিয়ে গেছেন। দেশটির অর্থনীতিও চাপে আছে এবং সিরিয়ায় তার ব্যয়বহুল সামরিক অভিযান রাশিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তার সম্পর্কে ফাটল ধরিয়েছে। এখন নভেল করোনাভাইরাস জেঁকে বসলে ক্ষমতা জনপ্রিয়তা দুটোই ধরে রাখতে এরদোগানকে হিমশিম খেতে হবে।

মতামত: নভেল করোনাভাইরাস ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে।

সামনের দিনগুলোতে উপরিউক্ত বিষয়ে আরো নতুন নতুন বাঁকবদল হবে।

 

ইয়ান ব্রেমার: টাইম ম্যাগাজিনের পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক কলামিস্ট

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন