কেন আড়ালে ছিল কভিড-১৯

বণিক বার্তা ডেস্ক

২০০৯ সালে মার্কিন সরকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। যেখানে তাদের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল প্রাণী থেকে মানবদেহে আসা যেসব ভাইরাস মহামারীর জন্য দায়ী তা খুঁজে বের করা। প্রেডিক্ট নামের প্রজেক্টটির অর্থায়ন করে ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট। চীনসহ মোট ৩১টি দেশে তাদের টিম কাজ শুরু করেছিল। এর একটি অংশ ছিল বিশ্বব্যাপী হুমকি হতে পারে এমন সংক্রামক রোগের ওপর নজরদারি করা। 

শক্তিশালী নেটওয়ার্ক হাজারো বিজ্ঞানীকে নিয়ে করা গবেষণার লক্ষ্য ছিল সম্ভাব্য বিপজ্জনক মহামারীর প্রাদুর্ভাব থামানো। কিন্তু ২০১৯ সালের শেষ দিকে অপ্রস্তুত বিশ্বকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়া নভেল করোনাভাইরাস সে গবেষণায় চিহ্নিত হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে মানবজাতিকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়া ভাইরাসটি অনির্ণেয় থেকে গেল?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগ গোয়েন্দাদের নজরদারিতেও অনেকগুলো ফাঁক রয়ে গিয়েছিল। অর্থ জনবল সংকটকেও সামনে আনেন কেউ কেউ। ভাইরোলজিস্ট মিকায়েল বুচমেইয়ারের মতে, দীর্ঘদিন ধরে নজরদারি চালিয়ে যাওয়ার ফলে অনেক জায়গা দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়। যে কারণে বিশ্বের জন্য হুমকি হতে পারে এমন সংক্রামক রোগ অধরা থেকে যায়। এরপর ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ইউএসএআইডি প্রেডিক্ট-এর কার্যক্রম থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। 

আনুমানিক ছয় লাখ কিংবা তার বেশি অজানা ভাইরাস রয়েছে, যা প্রাণী থেকে মানবদেহে সংক্রমিত হতে পারে। ধরনের রোগ ছড়িয়ে পড়ার জন্য মানুষ বন্যপ্রাণীর মিলনক্ষেত্রগুলোতে দৃষ্টি দেন। যেখানে তারা কৃষি অথবা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য বন কেটে ফেলা এবং বন্যপ্রাণীর মাংস বেচাকেনার মার্কেটগুলোকে রোগের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেন। এরপর বের করেন সেই সব প্রাণীকে, যারা ভাইরাস ছড়ানোর জন্য অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ। যার মধ্যে বাদুড়, ইঁদুর বানর উল্লেখযোগ্য। এরপর বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা চালান সেই নতুন ভাইরাসগুলোকে খুঁজে বের করার জন্য, যেগুলো মানব কোষকে সংক্রমিত করতে পারে। পাশাপাশি গবেষকরা চেষ্টা করেন সেসব বাস্তুসংস্থানসংক্রান্ত এবং সামাজিক চালকগুলো বের করতে, যা রোগবাহী বন্যপ্রাণী এবং মানুষকে একত্র করতে পারে। 

গবেষকরা নভেল করোনাভাইরাস সম্পর্কে বেশ জ্ঞাত ছিলেন, যাদের একটি কিনা সার্সের জন্য দায়ী ছিল। ভাইরাসটি চীনে প্রথম দেখা যায় ২০০২ সালে, যা পরে ৩০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ২০০৭ সালে ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের একদল গবেষক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন। যেখানে তারা উল্লেখ করেন, সার্সের জন্য দায়ী এমন অনেক সাদৃশ্যপূর্ণ ভাইরাস রয়েছে যার উৎস বাদুড়। পাশাপাশি তারা এও বলেন, এগুলো যেকোনো সময় ধ্বংসাত্মক হয়ে সামনে আসতে পারে। বিশেষ করে চীনের দক্ষিণাঞ্চলে যারা কিনা বন্যপ্রাণী খেয়ে অভ্যস্ত, সেখান থেকে বাদুড়বাহিত এসব ভাইরাস হুমকি হয়ে উঠতে পারে। মূলত অভ্যাসই প্রাণীদেহ থেকে মানবদেহে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া সহজতর করে তুলতে পারে। যার প্রমাণ অবশ্য এবার পাওয়া যাচ্ছে। কভিড-১৯-এর জন্য দায়ী ভাইরাসও ২০০২-০৩ সালে ছড়িয়ে পড়া সার্সের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। 

প্রেডিক্ট-এর সঙ্গে যুক্ত কেভিন ওলিভাল নামে আরেক গবেষক বলেন, ইকোহেলথ গবেষক এবং তাদের সহযোগীরা গবেষণাগারে সার্সের সঙ্গে সম্পর্কিত এমন অনেক নভেল করোনাভাইরাস বাদুড়ের মাঝে শনাক্ত করেছিলেন। তবে কীভাবে কোথায় নভেল করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সন্দেহ করা হয়, প্রাথমিকভাবে প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছিল উহানের হুয়ানান সি-ফুড মার্কেটে, যা গত জানুয়ারি বন্ধ করে দেয়া হয়। 

ওলিভালের মতে, প্রাণী মানুষের সংযোগ জানা খুব সহজ নয়। স্থানীয় বাস্তুসংস্থান, প্রজাতির মানচিত্রগত অবস্থান, স্থানীয় মানুষদের অন্য প্রজাতিদের প্রতি আচরণ এবং প্রাণী বাণিজ্যের সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক চালকগুলো সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকলেই এটা জানা সম্ভব। তবে কাজটি যে জটিল, তা- স্বীকার করেন তিনি। এর জন্য প্রয়োজন বহুলসংখ্যক বিজ্ঞানী এবং পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। সেই সঙ্গে প্রশিক্ষণ অর্থও। তাহলেই কেবল বিশ্বব্যাপী এসব মরণঘাতী ভাইরাস সম্পর্কে একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া সম্ভব। 

মহামারী বিশেষজ্ঞ রোহিত ছিতালে বলেন, কভিড-১৯ দেখিয়ে দিয়েছে এর প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী অপর্যাপ্ত বিনিয়োগের বিষয়টি। এখানে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার পর তার চিকিৎসায়। ওলিভালের দেয়া তথ্য অনুযায়ী দেশব্যাপী গবেষণার জন্য প্রেডিক্ট পেয়েছিল আনুমানিক ২০০ মিলিয়ন ডলার, যা কিনা মার্কিন সরকারের জরুরি ত্রাণের জন্য বরাদ্দ ট্রিলিয়ন ডলারের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। 

জন হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবকিল হেলথের সেন্টার ফর হেলদি সিকিউরিটির ডিরেক্টর থমাস ইংগলেসবাইয়ের মতে, ভবিষ্যতে ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে আইনপ্রণেতা, বিজ্ঞানী দাতাদের একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। 

সায়েন্টিফিক আমেরিকান

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন