এপ্রিল আমাদের জন্য দুঃসময়ের মাস হবে : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে চলায় এপ্রিল মাসটা দুঃসময়ের মাস হিসেবে আসছে জানিয়ে দেশবাসীকে সতর্ক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, সারা বিশ্বে  ভাইরাসটা যেভাবে প্রসারিত হয়েছে, এটা অনেকটা অংকের মতো। অন্যান্য দেশ থেকে আমরা যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, তাতে মনে হচ্ছে আমাদের দেশেও ধাক্কাটা এপ্রিল মাসে আরো ব্যাপকভাবে আসার কথা। রকমই একটা আলামত পাওয়া যাচ্ছে। ধরনের কিছু প্রতিবেদন আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিছু প্রেডিকশন দেখতে পাচ্ছি। কাজেই সেই অবস্থায় আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমি জানি, এপ্রিল মাসটা আমাদের জন্য খুবই একটা দুঃসময়ের মাস হিসেবে আসছে। সব জায়গা থেকে সে খবর পাচ্ছি।

গতকাল গণভবন থেকে চট্টগ্রাম সিলেট বিভাগের মাঠ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধের লক্ষ্যে দেশব্যাপী চলমান কার্যক্রম সমন্বয় করতে কনফারেন্সিং চালু করেছেন প্রধানমন্ত্রী। পর্যায়ক্রমে দেশের অন্য সব বিভাগের জেলাগুলোর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও ভিডিও কনফারেন্সিংয়ে অংশ নেবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এপ্রিল মাসটা নিয়ে খুব চিন্তায় আছি। তবে এত চিন্তার কিছুই নেই। আমরা এগুলো সবসময় মোকাবেলা করেছি। মোকাবেলা করতে সক্ষম হব। কারো মধ্যে যদি নভেল করোনাভাইরাসের অসুস্থতা দেখা দেয় দয়া করে সঙ্গে সঙ্গে খবর দেবেন। তার চিকিৎসা ব্যবস্থা যথাযথ আছে। আমরা প্রচুর চিকিৎসক রেখেছি। যারা চিকিৎসাসেবা দেবেন, তাদের জন্য পিপিইসহ সব ধরনের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা আছে। সেগুলোও আমরা পৌঁছে দিচ্ছি। আপনারা লুকাবেন না। কারণ একজন লুকাবেন তো আপনি আরো ১০ জনকে সংক্রমিত করবেন। কাজেই লুকাবেন না। আর এটা কোনো লজ্জার বিষয় না। কেউ কেউ মনে করছেন সে- (করোনার রোগী) বুঝি অচ্ছুত হয়ে গেল। তার সঙ্গে দেখা করা যাবে না। এটা কিন্তু না। আমাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবে হবে।

আমাদের এমনভাবে চলতে হবে, যেন এর প্রভাবে আমাদের দেশের মানুষের যেন ক্ষতি কম হয়। মাসটা সুরক্ষিত থাকতে পারলেই আমরা ওভারকাম করতে পারব।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সরকারের পক্ষ থেকে কভিড-১৯ মোকাবেলায় সর্বোচ্চ কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছি। যার ফলে এখন পর্যন্ত অন্যান্য দেশে যেমন ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হয়েছে, সেটা আমাদের দেশে হয়নি। আমাদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতিও সম্পূর্ণ আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমরা রাখতে সম্ভব হয়েছি। এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের সবার সম্মিলিত প্রয়াসের কারণে। আমি বিশ্বাস করি, সামনে যে আশঙ্কাটা দেখা দিচ্ছে, সেটাও আমরা মোকাবেলা করতে সক্ষম হব। 

তিনি বলেন, এখানে মানবিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এখানে রোগ কার কখন কীভাবে হচ্ছে, সেটা কেউ বলতে পারছে না। আজকে যিনি একজনকে ঘৃণার চোখে দেখছেন। কালকে তিনিও আক্রান্ত হতে পারেন। তখন আপনার কী হবে সেটাও ভাবতে হবে। 

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। প্রবৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে। আমাদের উন্নয়নের গতি অব্যাহত রয়েছে, দারিদ্র্য বিমোচন ২০ দশমিক ভাগে নামিয়ে এনেছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল মুজিব বর্ষ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে হার আরো নিচে নামিয়ে আনা এবং গৃহহীনদের জন্য ঘর নির্মাণ করা। সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীদের ভাগ্য পরিবর্তনও আমাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী মহাপ্রলয় সৃষ্টি হয়েছে। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সবকিছুই স্থবির। তার প্রভাব বাংলাদেশেও এসেছে। আসাটা স্বাভাবিক। আমরা শুরু থেকেই চেষ্টা করেছি এর প্রভাবে মানুষ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে করে অর্থনৈতিক গতিশীলতা থেমে গেছে। এটা কিন্তু শুধু আমাদের দেশে না, বিশ্বব্যাপী। 

নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে যাওয়ার সংখ্যা বেশি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা একদিক থেকে ভালো খবর। তবে প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাক, এটা চাই না। আমরা চাই দ্রুত এটি নিয়ন্ত্রণ হোক। এর জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এখন বিশ্বব্যাপী ঘটনা ঘটেছে, উন্নত দেশও নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে। বাঙালিরাও অনেক জায়গায় মৃত্যুবরণ করছে। যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, আমি তাদের সবার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে যেসব সরকারি চিকিৎসক, নার্স স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করে যাচ্ছেন, কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পুরসৃ্কত করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, সরকারি চিকিৎসক, নার্স স্বাস্থ্যকর্মী যারা কভিড-১৯ সংক্রমণের শুরু থেকে চিকিৎসাসেবা দিতে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছেন, তাদের তালিকা করার জন্য এরই মধ্যে নির্দেশ দিয়েছি। যারা ধরনের সাহসী স্বাস্থ্যকর্মী, তাদের উৎসাহ দেয়া প্রয়োজন। উৎসাহের সঙ্গে সঙ্গে তাদের আমি বিশেষ সম্মানীও দিতে চাই। সেজন্য তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছি। তালিকা তৈরির কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, কভিড-১৯ প্রতিরোধে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য এবং প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী যারা রয়েছেন, তাদের জন্য বিশেষ ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থা করে দেব। অর্থমন্ত্রী অর্থ সচিবের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমরা ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থা করছি।

নভেল করোনাভাইরাস তথা কভিড-১৯ রোগ প্রতিরোধে শুরু থেকেই যেসব চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীসহ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের সবাইকে বিশেষ বীমার আওতায় আনার ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এক্ষেত্রে কেউ নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ সরকারি পদমর্যাদাভেদে থেকে ১০ লাখ টাকার বীমা করে দেয়া হবে। আর কেউ নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে বীমার অংক হয়ে যাবে পাঁচ গুণ। মনে রাখতে হবে এটা তাদের জন্যই করব যারা নভেল করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার পর কাজ করেছেন। মার্চে যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। প্রণোদনাটুকু তাদের জন্য। যারা কাজ করেননি, নিজেদের সুরক্ষার জন্য পালিয়ে গেছেন, যেখানে অন্য সাধারণ রোগীরাও চিকিৎসা পায়নি। তাদের জন্য প্রণোদনা নয়। তারা এটা পাবেন না। 

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, কেউ যদি শর্ত দেন যে আমাদের এটা দিলে আমরা আসব। তবে আমি বলব, সেটা পেতে হলে আগামীতে দুঃসময়টা যেটা যাবে, তিনমাস তাদেরও কাজ দেখব। সেখানে দেখব সত্যি যদি তিনি মানুষের সেবা দেন। তার পর তাদের কথা আমরা চিন্তা করব। কিন্তু শর্ত দিয়ে আমি কাউকে কাজে আনব না। যাদের মধ্যে মানবতাবোধটুকু নেই, তাদের প্রণোদনা দিয়ে কাজে আনার যৌক্তিকতা আছে বলে আমি মনে করি না। যদি বাংলাদেশে এমন দুর্দিন আসে, প্রয়োজনে আমরা বাইরে থেকে ডাক্তার নিয়ে আসব। বাইরে থেকে নার্স নিয়ে আসব। কিন্তু ধরনের দুর্বল মানসিকতা দিয়ে আমাদের কাজ হবে না। এটা হলো বাস্তবতা। কাজেই এখন তারা মিটিং করুক আর শর্ত দিক। শর্তে আমার কিছু যায়-আসে না। বরং ভবিষ্যতে তারা ডাক্তারি করতে পারবে কিনা সেটাই চিন্তা করতে হবে। ডাক্তার আমাদের প্রয়োজন আছে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মানসিকতা থাকবে কেন? মানবতাবোধ হারাবে কেন

তিনি বলেন, একজন রোগী এলে নিজেকে সুরক্ষিত করা যায়। অ্যাপ্রোন পরে নেন, মুখে মাস্ক পরেন, গ্লাভস পরেন। অথবা স্যানিটাইজার ব্যবহার করেন। রোগী দেখেন। রোগী কেন ফেরত যাবে? একজন রোগী নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে সেই রোগী কেন মারা যাবে

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী রোগাক্রান্ত, হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে সে কোনো ডাক্তার পায়নি চিকিৎসা করতে। এটি খুবই কষ্টকর। দুঃখজনক। ডাক্তাররা কেন চিকিৎসা করবেন না। রোগী যেখানে যেখানে গিয়েছে, সেখানে কোন কোন ডাক্তারের দায়িত্ব ছিল। আমি তাদের নামটাও জানতে চাই। তাদের ডাক্তারি বা চাকরি করার মতো সক্ষমতা নেই। তাদের চাকরি থেকে বের করে দেয়া উচিত। সবাইকে সুরক্ষিত থাকতে হবে। এটা আমি মানি। একজন ডাক্তার তার একটা দায়িত্ব থাকে। তাদের সুরক্ষার জন্য যা করা দরকার, তা আমরা দিয়ে যাচ্ছি। লাগলে আরো করব। সেখানে আমরা কোনো কার্পণ্য করছি না। আমরা দেশে তৈরি করছি, বিদেশ থেকে আনছি। যখন যা দরকার সব রকম চেষ্টা করছি। 

খাদ্য সংকট যাতে না হয়, সেজন্য ফসল উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের কাছে জমি আছে, মানুষ আছে। এখন অনেকেই গ্রামে বেকার বসে আছেন। কাজেই কারো ঘরের এতটুকু জমি যাতে অনাবাদি না থাকে। তরিতরকারি, ফলমূল, শস্য যা পারেন কিছু না কিছু লাগান। উৎপাদন করেন। জলাভূমি পড়ে থাকলে সেখানে মাছের উৎপাদন করেন। আমি কৃষিমন্ত্রী মত্স্যমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছি। এসব উৎপাদনের জন্য যা যা প্রয়োজন, তারা ব্যবস্থা করবেন। 

ভিডিও কনফারেন্সে চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বিভিন্ন কর্মকর্তা রাজনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন