দূরত্ব না মানায় খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী শ্রমিক ঝুঁকিতে

সুজিত সাহা চট্টগ্রাম ব্যুরো

চলমান নভেল করোনাভাইরাস সংকট মোকাবেলায় সর্বত্র মানুষের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখার নীতির প্রয়োগ হচ্ছে বেশ জোরেশোরে। তবে এর পরও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের মতো দেশের বৃহৎ পাইকারি বাজারগুলোয় নীতি মানছেন না ব্যবসায়ী শ্রমিকরা। অন্যত্র কঠোর হলেও এখানকার বিষয়ে উদাসীন প্রশাসন। ফলে নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ী, কর্মচারী, পণ্য কিনতে আসা ব্যবসায়ী পরিবহন শ্রমিকসহ বাজারসংশ্লিষ্ট অন্যরা। 

দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের মালিকরা সংক্রমণের ভয়ে নিজ নিজ বাসায় অবস্থান করছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্মচারী থাকলেও তাদের জন্য রাখা হয়নি কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। ফলে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক, মালামাল তুলে দেয়ার শ্রমিক ভ্যান-ঠেলাগাড়ি চালকদের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েই যাচ্ছে। প্রতিদিন বাজারে কাজের প্রয়োজনে লক্ষাধিক মানুষ আসে। বিশেষ করে বিভিন্ন আড়ত, পাইকারি দোকান ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা প্রতিদিন নানা ধরনের মানুষের সংস্পর্শে এলেও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অপ্রতুল হওয়ায় ঝুঁকি নিয়েই দায়িত্ব পালন করছেন তারা।

গতকাল চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের মালিক উপস্থিত নেই। কর্মীরাই ব্যবসা পরিচালনা করছেন। অনেকের কাছেই নিরাপত্তামূলক মাস্ক নেই। কেউ কেউ হ্যান্ড গ্লাভস পরলেও টাকা গোনার সময় সেটি খুলে ফেলতে হচ্ছে। তাছাড়া যানবাহন চলাচল সীমিত থাকায় একই সময়ে একাধিক ক্রেতা ভিড় করছেন আড়ত দোকানে। সবাই দ্রুত পণ্য সংগ্রহ বিল পরিশোধ করতে চাওয়ায় বিপাকে পড়ছেন কর্মচারীরা।

গতকাল বিকাল ৫টা পর্যন্ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার নির্দেশনা থাকলেও সন্ধ্যার পরও খোলা রাখতে বাধ্য হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। আসন্ন রোজার আগে ভোগ্যপণ্যের বাজারে ভিড় বাড়লে কভিড-১৯ ছড়ানোর ঝুঁকি আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের।

জানা গেছে, ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়তে থাকায় দুই সপ্তাহ আগে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে সমিতির ৪২৪টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের সাবান, ফেস মাস্ক সচেতনতামূলক লিফলেট দেয়া হয়। এছাড়া খাতুনগঞ্জের আর কোনো ব্যবসায়ী সংগঠনই শ্রমিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়নি।

বিষয়ে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, প্রশাসনের মুখাপেক্ষী না হয়ে খাতুনগঞ্জে আমাদের সংগঠনের সদস্য সদস্যবহির্ভূত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং শ্রমিকদের মধ্যে নভেল  করোনাভাইরাস প্রতিরোধক সামগ্রী বিতরণ করেছি। খাতুনগঞ্জের সবগুলো ব্যবসায়ী সংগঠন এভাবে এগিয়ে এলে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি কমে যেত। খাতুনগঞ্জের -১০ হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আগে প্রতিদিন দুই লাখ মানুষের আনাগোনা থাকলেও বর্তমানে তা অনেক কমেছে। অবস্থায় খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্য ব্যবসাকে নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে না আনলে এখানেও ব্যাপক হারে সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে।

জানা গেছে, সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী বর্তমানে ব্যাংক ছাড়া খাতুনগঞ্জের অন্যান্য অফিস-প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। তবে ভোগ্যপণ্য বাজার হওয়ায় ট্রেডিংসহ ৯০ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই খোলা। ফলে নিয়মিত বাজারের মতো ভিড় না হলেও খাতুনগঞ্জ সেই পুরনো রূপেই রয়েছে। নিত্য যানজট ছাড়াও ভিড়ের কারণে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা অসম্ভব। এছাড়া 

ভোগ্যপণ্য বাজারের রীতি অনুযায়ী একটি প্রতিষ্ঠানের ছোট একটি মোকামে পাঁচ থেকে আট কর্মী কাছাকাছি বসে ক্যাশ মেমো লেখায় নিয়োজিত থাকেন। এভাবে কাছাকাছি বসে কাজ করাটাও নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি তৈরি করছে।

ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর তথ্যমতে, খাতুনগঞ্জ চাক্তাইয়ের কয়েক কিলোমিটার জুড়ে প্রায় ১০ হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। নৌযান, ভ্যান-ঠেলাগাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহনে পণ্য পরিবহন এবং এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে পণ্য নিয়ে যাওয়ার জন্য শ্রমিক রয়েছেন কয়েক হাজার। এছাড়া খাতুনগঞ্জে আট-দশটি বড় ব্যবসায়ী সংগঠনও রয়েছে। এসব সংগঠনও এখন পর্যন্ত বর্তমান পরিস্থিতিতে ভোগ্যপণ্যের বাজার পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ে কোনো বৈঠকে বসেনি। ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি প্রশাসনের পক্ষ থেকেও। ফলে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চালু থাকা খাতুনগঞ্জ, পাহাড়তলী রিয়াজউদ্দিন বাজারের মতো বড় পাইকারি বাজারগুলোর মাধ্যমে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। 

বিষয়ে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জামাল উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, খাতুনগঞ্জ একটি অত্যন্ত শ্রমঘন এলাকা। নভেল করোনাভাইরাসের শঙ্কায় সবকিছু বন্ধ থাকলেও ভোগ্যপণ্য বাজারটি বন্ধ নেই। খাতুনগঞ্জ দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ ভোগ্যপণ্যের সরবরাহকারী বাজার। প্রশাসনেরও উচিত নিরাপত্তাসামগ্রী প্রদান, গাইডলাইন মনিটরিং কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পাইকারি বাজারকে নিরাপদ রাখতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

তবে চলমান সংকটে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো কর্মী ক্রেতাদের  জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বলে স্বীকার করেন তিনি। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে কোনো ধরনের নির্দেশনা নেই। ব্যবসায়ী নেতারা সবাই যার যার বাসায়। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও খাতুনগঞ্জ নিয়ে নিরাপত্তামূলক কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। ফলে চাকরির প্রয়োজনে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা নিয়মিত এলেও ঝুঁকি নিয়েই কাজ চালাচ্ছেন। এতে দূর-দূরান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সবাই ঝুঁকিতে পড়ছেন।

এজন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপসহ বৃহৎ পাইকারি বাজারগুলোর জন্য বিশেষ নির্দেশনার দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা।

বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের আমরা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে আগেও বলেছি। কিন্তু প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাসামগ্রী জোগাড় করতে না পারার বিষয়ে তারা আমাদের জানিয়েছেন। তারা বলছেন, এসব উপকরণ পাওয়া যাচ্ছে না। এখন হার্ড লাইনে গেলে গোটা দেশের ভোগ্যপণ্য সরবরাহ লাইনে ব্যাঘাত ঘটবে। আমরা তাদের সম্প্রতি স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে সবার সর্বোচ্চ নিরাপত্তার বিষয়টি যেকোনো উপায়ে নিশ্চিত করার জন্য নির্দেশনাও দিয়েছি। বিষয়টি আরো জোরালোভাবে মনিটরিং করা হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন