পর্যবেক্ষণ

সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সাহায্যবঞ্চিত থাকলে অর্থনীতি গতি হারাবে

ড. আর এম দেবনাথ

প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাস রোগটি সারা বিশ্বে এক মহা আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। প্রতিদিন বিশ্বের ১৯০টি দেশের মতোই বাংলাদেশেও সংক্রমিত লোকের সংখ্যা বাড়ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনীতি স্থবির। আমদানি-রফতানি বন্ধ। রেমিট্যান্সে ধস নেমেছে। মিল-ফ্যাক্টরি, কলকারখানা অচল। মানুষ সব গৃহবন্দি। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে যাচ্ছে না।

সাধারণ মানুষ কষ্টে পড়েছে। তাদের রোজগার নেই। অনেকের বেতন-ভাতা বন্ধ। রকম এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে সরকার দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার উদ্দেশ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্তটি রফতানিমুখী শিল্পের জন্য। অন্তত ৮০ শতাংশ পণ্য যেসব কারখানা রফতানি করে, সেগুলোর জন্য সরকার একটা প্রণোদনার কথা ঘোষণা করেছে। এর থেকে দেখা যায়, সরকার তৈরি পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য রফতানিমুখী শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন-ভাতা দেবে। এর পরিমাণ ধরা হয়েছে হাজার কোটি টাকা। এটা ঋণ হিসেবে কারখানা/শিল্পের মালিকরা পাবেন এবং তা মোট দুই বছরের মধ্যে পরিশোধ  করতে হবে। সার্ভিস চার্জ হবে মাত্র শতাংশসুদ নয়। সরকারের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। সঠিক সময়ের সঠিক পদক্ষেপ এটি। লাখ লাখ শ্রমিককে এছাড়া বাঁচানো সম্ভব নয়, সম্ভব নয় রফতানিমুখী শিল্পকে বাঁচানো। আমার প্রশ্ন এসবে নয়। প্রশ্ন অন্যত্র। রফতানিমুখী শিল্পের মালিকরা, তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকরা কি নিজেরা তাদের নিজেদের টাকা থেকে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা তিন মাস দিতে পারতেন না? তাদের কি টাকা ঋণ হিসেবে নেয়ার এতই প্রয়োজন ছিল? হাজার কোটি টাকা সরকার অন্যভাবে ব্যয় করতে পারত না কি, বিশেষ করে জরুরি সময়ে। আমার কাছে এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। তবে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে আমাদের সামাজিক প্রাত্যহিক জীবনে কী ঘটছে, তার দু-একটা লজিক দেয়া যায়।

মুজিব বর্ষ শুরু হওয়ায় পরপর সময়ে এক জায়গায় আমরা কয়েক বন্ধু বসা। চুটিয়ে সেখানে আড্ডার অছিলায় আলোচনা হচ্ছিল অনিশ্চয়তার ওপর, ভবিষ্যতের ওপর, মানুষের অসহায়ত্বের ওপর। এক পর্যায়ে এক বন্ধু বললেন, তার স্ত্রী সবেতনে তার বুয়া দুজনকে বিদায় দিয়ে বাড়িতে থাকতে বলেছেন। একই খবর ড্রাইভারদেরও। সব বন্ধুই দেখলাম ড্রাইভারদের বিদায় করে দিয়েছেন। অবশ্যই মাসের বেতনসহ। আমার একটু খটকা লাগল। মনে মনে প্রশ্ন, আমরা তো সাধারণভাবে বুয়া ড্রাইভারদের প্রতি এত সদয় উদার নই। তাদের সঙ্গে দরকষাকষি লেগেই থাকে। তাদের বেতন বাড়াতে গিয়ে, মূল্যস্ফীতির দিনেও আমরা কার্পণ্যই করি। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাস নামীয় বিশ্বদানবের মুখোমুখি হয়ে আমরা আজ পরিবর্তিত। আমাদের মধ্যেই মানবিক দিকগুলো জাগ্রত হয়েছে। যেমন হতো পাকিস্তান আমলে। মানুষের দুর্দিনে আমরা রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করেছে। ভিক্ষা দাও হে পুরবাসী’—অনেকেরই গানের সেই কলি দুটি মনে থাকার কথা। সত্তরের ভয়ংকরী জলোচ্ছ্বাসের পর ত্রাণে গিয়েছি আমরা। মানুষ স্বতঃফূর্তভাবে সাহায্য দিয়েছে। গরিবের উপকারে নেমে পড়েছে। এসব কথা মনে করতে করতে একটা অনুকরণযোগ্য উদাহরণ পেয়ে গেলাম। সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক আমাকে বললেন তার এক মর্মস্পর্শী উদাহরণের কথা। পাবনা অঞ্চলের এক ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ী মানে তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ী এক কাজ করেছেন। তিনি নিজের পকেট থেকে তার কারখানার শ্রমিকদের দুই মাসের বেতন দিয়ে ছুটি দিয়েছেন। প্রয়োজনে আগামী দিনে তিনি আরো দেবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন। এদিকে প্রায় প্রতিদিনই খবরের কাগজে তরুণদের মানবতাধর্মী নানা কাজের নজির দেখতে পাচ্ছি। তারা বিনা পয়সায় দুস্থ মানুষের মধ্যে চাল-ডাল, লুন-তেল, সাবান ইত্যাদি বিতরণ করছেন। ধরনের উদাহরণের কথা পাঠ করে যারনারনাই আশ্বস্ত হই। না, পৃথিবী শেষ হয়ে যায়নি। প্রেক্ষাপটেই যখন তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বেতনের টাকা সরকার দিচ্ছে বলে শুনি, তখন থমকে দাঁড়াই, দাঁড়াতেই হয়। আমাদের তৈরি পোশাক খাতের মালিকরা, রফতানিমুখী শিল্পের মালিকরা প্রায় প্রত্যেকেই ধনাঢ্য ব্যক্তি। তারা সব ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন, তারা ব্যাংক-বীমা-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক। তারাই আমদানি-রফতানি ব্যবসার মালিক। রাজনীতি, ক্ষমতা, কর্তৃত্বও এখন তাদের হাতের মুঠোয়। তারা আমাদের ভাগ্য-বিধাতা। দেশে-বিদেশে তাদের কত সহায়-সম্পদ আছে, তার কথা খবরের কাগজে পড়ি। এমন দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ীরা কি তাদের নিজের সংকট থেকে তিন মাসের বেতন শ্রমিকদের দিতে পারতেন না? এতে কি তাদের গাঁটে খুব  বেশি টান পড়ে যেত? যারা তাদের কারখানা সচল রেখে বছরের পর বছর ধরে ব্যবসায়ীদের ভাগ্য গড়তে সাহায্য করছেন, সেই শ্রমিকদের কি রফতানিমুখী শিল্পের মালিকরা তিন মাসের বেতন দিতে পারতেন না? খাতে তিন-চার হাজার কারখানা আছে। যদি সচল কারখানা দুই হাজারও ধরে নিই, তাহলে হাজার কোটি টাকা কি তাদের কাছে খুবই বেশি? তারা কি শ্রকিদের বেতনের টাকা দিয়ে সরকারের কাছে অন্য ধরনের সাহায্য চাইতে পারতেন না? মুশকিল হচ্ছে শ্রমিকদের জন্য বিনা সুদে ঋণ নিয়েও তারা আরো অনেক সুযোগ-সুবিধা চাইবেন, এর আলামত আমরা পাচ্ছি।

রফতানিমুখী শিল্পের মালিকদের শ্রমিকের বেতন-ভাতা বাবদ যে ঋণ সরকার দিচ্ছে, তাতে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ আছে। ঋণের টাকা মালিকদের হাতে দেয়া হবে না। বেতনের টাকা সরাসরি চলে যাবে শ্রমিকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। যাদের ব্যাংক হিসাব নেই তাদের বিকাশের মাধ্যমে টাকা দেয়া হবে। পদক্ষেপ কেন? দৃশ্যতই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে ঋণের টাকার সদ্ব্যবহারের উদ্দেশ্যে। তা না হলে এমনও হতে পারত, অনেক মালিক ওই টাকা থেকে অন্য খরচ নির্বাহ করতেন। বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ঋণের টাকা দেয়ার আগে যেসব বিধি অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হলে সব টাকা শ্রমিকদের হাতেই যাবে। এতে বাজারে চাহিদা (ডিমান্ড) অক্ষুণ্ন থাকবে। ধনীর হাতে টাকা গেলে তা বাজারে চহিদা সৃষ্টি করে না, কথা মনে রাখতে হবে। এখানে আলোচ্য বিষয় হচ্ছে টাকার সদ্ব্যবহার বোঝা যাচ্ছে সরকারকে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করে তুলতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে। এসব টাকার সদ্ব্যবহার করার কাজ হবে খুবই জরুরি। বাজারে টাকা যাচ্ছে। সমপরিমাণে যদি উৎপাদন বা সেবা না বাড়ে, তাহলে কিন্তু মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি থেকে যাবে। আগামীতে এমনিতেই শত সমস্যা দেখা দেবে। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতি ঘটলে সব ভণ্ডুল হয়ে পড়বে। দেখা যাচ্ছে সরকার এরই মধ্যে ত্রাণের কাজ শুরু করেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কয়েকটি পদক্ষেপও গৃহীত হয়েছে। যেমন ঋণের কিস্তির টাকা আগামী তিন মাস না দিলেও ওই ঋণ খেলাপি ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হবে না। সুযোগটি মনে হচ্ছে মোটামুটি ঢালাওভাবেই দেয়া হয়েছে। তা হোক। কিন্তু সুযোগের/সুবিধার সদ্ব্যবহার আগামী দিনে নিশ্চিত করতে হবে। ঋণখেলাপ সমস্যার ঝুঁকি থেকে ব্যবসায়ী মুক্ত হলেন, অথচ ভবিষ্যতে উৎপাদন বাড়ল না, সেবার পরিধি বাড়ল না, তা হলে তা হবে আরেকটি বিপদ। এরই মধ্যে ত্রাণের কাজ নিয়ে বরাবরের মতো নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। একটি দৈনিকের খবরের শিরোনাম দেখলাম। শিরোনামটি হচ্ছে অপরিকল্পিত বরাদ্দে অপচয় বদনাম আলোচ্য খবরটিতে বলা হচ্ছে উপজেলা, ইউনিয়ন ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রকৃত দুস্থ মানুষের সংখ্যা তাদের প্রয়োজনীয় ত্রাণের চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দের পরিমাণ অপ্রতুল। কোনো কোনো ইউনিয়নে যেখানে কয়েক হাজার দুস্থ মানুষ রয়েছে, সেখানে বরাদ্দকৃত খাদ্যসামগ্রী বণ্টন করা সম্ভব হচ্ছে মাত্র ১০০-১৫০ জনকে। এসব সংবাদ খারাপ সংবাদ। সারা দেশে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে সরকারের বদনাম হবে বলে কাগজটি সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছে। বলা বাহুল্য, সদ্ব্যবহারের ইস্যু বাদেও আরো জরুরি দুটো বিষয় আছে। দেশে রফতানিমুখী শিল্প বাদেও আরো শিল্প-কারখানা আছে। প্রকৃত পক্ষে অনানুষ্ঠানিক খাতেই বেশি কারখানা-ব্যবসা-কাজ ইত্যাদি। লোকও বেশিসংখ্যক সেখানেই কাজ করে। অবস্থায় সাহায্যের হাত ওইদিকেও বাড়িয়ে দেয়া একান্ত জরুরি। ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পে শ্রমিক সংখ্যা অনেক। সেখানে বিনিয়োগও কম নয়। ওইদিকেও নজর দেয়া দরকার। দেশে যত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংঘঠিত হয়, তার হিসাব সরকারের কাছে আছে। এরা প্রণোদনার বাইরে থাকলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ থাকবে সাহায্য বঞ্চিত। মুশকিল হচ্ছে এর বাইরেও থাকবে অনেক লোক, যারা মধ্যবিত্ত বলে পরিচিত। এরা কারো কাছে হাত পাততে পারে না। আগামী বাজেটের কাজ চলছে। ওই বাজেটে তাদের দিকেও নজর দিতে হবে। ক্রেতা যারা, ভোক্তা যারা, যারা বাজারের মূল শক্তি, তাদের প্রতিও সরকারকে সদয় থাকতে হবে। বাজেট বড় বেশি ব্যবসায়ীবান্ধব হয়ে যাচ্ছে। অথচ তা হওয়া উচিত ব্যবসাবান্ধব। ব্যবসায়ীবান্ধব বাজেট করার পক্ষে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষ অনেক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমি মনে করি, সরকারকে আগামী দুই বছরের হিসাব ধরে এগোতে হবে। যে ক্ষয়ক্ষতি হবে, তা যেন দুই বছরের মধ্যে পুষিয়ে আমরা লাভে থাকতে পারি, তার ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে। দি ইকোনমিস্টের এক জরিপে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির ওপর এক দুশ্চিন্তার খবর ছাপা হয়েছে। সরকার আশা করি সম্পর্কে সজাগ। সামনে পহেলা বৈশাখ, তারপর পবিত্র রমজান মাস এবং এর পরই বাজেট। এপ্রিল-জুন সময়টি হচ্ছে অর্থবছরের শেষ তিন মাস। এমনিতেই বছরটি ভালো যাচ্ছিল না। রাজস্ব কম। সরকারকে ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ করতে হচ্ছে। আমদানি-রফতানির পরিমাণ কম। রেমিট্যান্সও এখন কমতে শুরু করেছে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ পরিমিতঅধিকতর কোনো ঝুঁকি সামলানোর মতো অবস্থায় তা নেই। অতএব খুব সাবধানে এগোতে হবে। বিভিন্ন চেম্বার অব কমার্স যেসব দাবি নিয়ে আসছে, তার প্রতি সম্পূর্ণ নজর দিতে হলে সরকার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। তারা শুধু চাইছেই। কী কী অবদান তারা রাখবে, তার কথা বলছে না। মুশকিল হচ্ছে ব্যবসায়ীরা বাদেও দেশে ১৬ কোটি মানুষ আছে। তাদের বাঁচিয়ে রাখাও সরকারেরই দায়িত্ব। গোল্ডেন সিন কীভাবে রক্ষিত হয়, তাই দেখার বিষয়। ব্যবসায়ীদের যে অবদান ভূমিকার কথা বললাম, তার একটা নজির প্রায়ই দেখি। এবারও দেখছি। অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করে ছবি তুলছেন। এখানেও কথা আছে। ১০০ টাকা দান করলে এতে সরকারের টাকাই থাকে কমপক্ষে ৩৫-৪০-৪৫ শতাংশ। দান না করলে কোম্পানির মুনাফা হতো। তার ওপর সরকার কর পেত। তার পরও কথা আছে। যেকোনো কোম্পানির শেয়ারে, ব্যাংক-বীমা-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের মধ্যে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের পুঁজিই বেশি। তার অর্থ দান যাচ্ছে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের পকেট থেকে। দান না করলে তারা বেশি লভ্যাংশ পেতেন। লুকোচুরির মধ্যে মহাসংকটের দিনে বড় বড় ব্যবসায়ীর অবদানের কথাটি ন্যায্যতই আলোচনায় আসে না কি?

 

. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন