করোনা মোকাবেলায় পরবর্তী ধাপ

অরণ্য আজাদ

একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা অতিবাহিত করছি। করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্ব অর্থনীতি এরই মধ্যে মন্দার ভেতরে পডেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এর মধ্যে এশিয়া সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলো মন্দায় বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। বাংলাদেশ তার বাইরে নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে দাঁড়িয়ে আছে বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশী নাগরিক, গার্মেন্ট শিল্প মৎস্য খাতের ওপর। তিনটির মধ্যে মৎস্য সম্পদ বাদে অন্য দুটি ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে। বর্তমান করোনা সংকটের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক বিদেশ থেকে বাংলাদেশে চলে এসেছেন। তারা আবার ওইসব দেশে যেতে পারবেন কিনা সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে গার্মেন্টের যে ক্রয়াদেশ মূলত ইউরোপিয়ান দেশ থেকে আমরা পেয়ে থাকি, সেখানেই করোনার সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে। আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, উদীয়মান দেশগুলোর সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য মূহূর্তে প্রয়োজন আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থ শুধু বর্তমান সময়ের জন্য। আমাদের দেশে এরই মধ্যে গার্মেন্ট সেক্টরের জন্য সরকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যা ইতিবাচক।  

 

বর্তমান  অবস্থায় আমাদের করণীয়

. আমাদের ব্যাংক ব্যবস্থার উন্নয়ন করা। ব্যাংক ব্যবস্থার দুর্নীতি রোধ করা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যাংক দুর্নীতি হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে। ফলে ব্যাংক গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে অক্ষম হতে পারে। বিষয়ে নজর দিতে হবে। সরকারি বেসরকারি সব ব্যাংকের মাধ্যমে ক্ষুদ্র কৃষকদের (অবশ্যই প্রকৃত কৃষকদের) সহজ শর্তে স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ করতে হবে।

. রাষ্ট্রকে সহজ শর্তে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে ঋণ বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র মাঝারি ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারকে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য প্রণোদনা চালু করতে হবে এবং শেয়ারবাজার থেকে যাতে এককভাবে টাকা কেউ তুলে নিতে না পারেন, সেদিকে কঠোর নজরদারি করতে হবে।

. এই মহামারী শেষ হলেই খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। এরই মধ্যে গ্রাম পর্যায়ে গম উত্পাদনে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। কৃষকরা গম কাটতে পারছেন না। অনেকে সময় তাদের মাঠে যেতে দেয়া হচ্ছে না কোয়ারেন্টিনের নাম করে। ফলে মাঠে গম নষ্ট হচ্ছে। ধান কাটার সময় হয়ে যাচ্ছে। কৃষকের পুঁজি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। কৃষক যাতে তার ধানের প্রকৃত দাম পান, সেদিকে প্রথম থেকেই নজর দিতে হবে এবং প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে ধান ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সার-বীজ প্রকৃত দামে পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

. আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেকাংশে নির্ভরশীল বিদেশে কর্মরত মানুষের কষ্টার্জিত টাকার ওপর। দেশের মোট জিডিপির ৩০ শতাংশ আসে রেমিট্যান্স থেকে। ২০১৯ সালে হাজার ৮৩৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। রেমিট্যান্স আসা আমাদের জন্য খুবই ইতিবাচক। কিন্তু বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে খাতে বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারে। বিশেষ করে যারা এরই মধ্যে দেশে চলে এসেছেন, তারা কি আবার সেসব দেশে ফিরে যেতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বৈদেশিক শ্রমবাজার হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। তাই বৈদেশিক শ্রমবাজার যাতে আমরা না হারাই, তার জন্য দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সবসময় সচেষ্ট থাকা এবং ওইসব দেশের শিল্প-কারখানার মালিকদের সঙ্গে জোর লবিং করা প্রয়োজন। এজন্য আমাদের দেশে যেসব কোম্পানি আছে, যারা বিদেশে শ্রমিক পাঠায়, তাদের ওপর নজরদারি এবং তারা যাতে সহজে কাজ করতে পারে সে ব্যবস্থা করা দরকার। এই ফাঁকে অনেকেরই প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। রাষ্ট্রকে সেদিকে জোর নজর দিতে হবে। পররাষ্ট্র দপ্তরকে বিষয়ে বেশি কাজ করতে হবে। পররাষ্ট্র দপ্তর যদি সঠিকভাবে সঠিক সময়ে কাজ করতে পারে তাহলে আমরা বৈদেশিক শ্রমবাজার ধরতে পারব।

. গার্মেন্ট সেক্টরে যাতে মালিকপক্ষ শ্রমিক ছাঁটাই না করে, তার পদক্ষেপ নিতে হবে। এখানে পররাষ্ট্র শিল্প দপ্তরের বড় ভূমিকা থাকতে হবে। রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে উত্পাদিত পণ্য বাজারজাত করা। রাষ্ট্র যদি পণ্য বাজারজাত নিশ্চিত করতে পারে তাহলে গার্মেন্ট শ্রমিকরা চাকরিচ্যুত হবেন না। এতে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে না। অন্যথায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

. বাংলাদেশে এনজিওগুলোয় কর্মরত কয়েক লাখ মানুষ। সেক্টরের কারণে বেকার সমস্যা কিছুটা লাঘব হয়েছে। সেক্টরে যেসব দেশ থেকে মূলত আর্থিক সহায়তা আসে, এবার সেসব দেশেই করোনার প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমেরিকায় নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি এবং মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি। দীর্ঘদিন উত্পাদন বন্ধ থাকায় সেখানকার মানুষের আয়ের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। তাদের অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে ওইসব অঞ্চল থেকে সাহায্য আসার পরিমাণ অনেক কমে যাবে। এতে সেক্টরে হুমকির সম্ভাবনা রয়েছে। রয়েছে চাকরিচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা একটা বড় অংশের। এনজিওর সঙ্গে যেসব মানুষ জড়িত অর্থাৎ যারা গ্রাহক, তাদের অধিকাংশ খেটে খাওয়া মানুষ। মানুষগুলো ব্যাংক থেকে ঋণ পায় না অথবা তাদের দেয়া হয় না। দুর্যোগের পরেই এই মানুষগুলোর ঋণের প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে এনজিওগুলো যাতে তাদের গ্রাহকদের ঋণ সুবিধা দেয়, সেদিকে মাইক্রো ক্রেডিট অথরিটিকে (এমআরএ) নজর দিতে হবে। পিকেএসএফসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, যারা পিকেএসএফের ফান্ডে কাজ করে না, তাদের জন্য বাধ্যতামূলক দুর্যোগ ঋণ চালু করতে হবে; যার সুদের হার কোনোভাবেই ক্রমহ্রাসমান ১০ শতাংশের বেশি না হয়। এতে সংস্থা তার স্টাফদের বেতন-ভাতা প্রদানে সক্ষম হবে এবং গ্রাহকরা উপকৃত হবেন। এমআরএর চলতি অর্থবছরের বার্ষিক চাঁদা বন্ধ করে সেই টাকায় বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনা করতে হবে। এতে কর্মসংস্থান ঘাটতি হবে না, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।

. রেশনিং  ব্যবস্থা চালু করা। সব মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য যেমন চাল, আটা, ভোজ্যতেল, ডাল, চিনি রেশনিং ব্যবস্থার মাধ্যমে দিতে হবে। রেশনিংয়ের মাধ্যম্যে মানুষের মাঝে খাদ্য নিশ্চয়তা আসবে। অন্যথায় মানুষ খাদ্য সংকটে পড়লে নৈতিক অবক্ষয় হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। যার কারণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। রেশনিং ব্যবস্থা চালু করলে কৃষকদের উত্পাদিত পণ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। কৃষকরা উত্পাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পাবেন, আর  জনগণও সঠিক দামে পণ্য ক্রয় করতে পারবে। এতে উভয়েরই উপকার হবে।

সরকার যদি সততার সঙ্গে কাজ করে, তবে সমস্যা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন