গরিব দেশে জন্মানোর কিছু সুবিধা আছে। আপনি চান বা না চান, যেকোনো ধরনের অভাব জাতীয় সমস্যাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার একটা স্বভাবজাত অভ্যাস আপনার থাকবেই। তাই অস্ট্রেলিয়ায় প্রথমেই যখন টয়লেট পেপার নিয়ে হায় হায় শুরু হলো, আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, ‘কোনো সমস্যাই নেই। এদের যে সাপ্লাই, শেষ হবে না এত তাড়াতাড়ি।’
তার দুই দিন পর গিয়েছি সুপারমার্কেটে। সত্যি সত্যিই দেখতে পেলাম কোথাও কোনো টয়লেট পেপার নেই। নেই মানে নেই, একেবারেই নেই।
আমি এতটা আশঙ্কা করিনি আসলে। মোটে আড়াই কোটি লোক এখানে; আর দেশের সাইজ আমাদের থেকে ৫২ গুণ বড়। আমাদের এক ঢাকাতেই দুই কোটি লোক। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, এ কয়টা মানুষের চাহিদা সামাল দিতে এরা পারবে। কিন্তু ভুলেই গিয়েছিলাম যে ‘চাহিদা’
একটা সীমাহীন ব্যাপার, তার ওপর আবার এমন হুট করে ঘাড়ে চেপে বসা ক্রাইসিস সামাল দেয়ার অভ্যাসও তো নেই এদের। শুরু হলো ‘প্যানিক বায়িং’। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে পাঁচটা মৌলিক চাহিদার ঊর্ধ্বে উঠে অস্ট্রেলীয়রা হুড়োহুড়ি করে কিনতে লাগলেন টয়লেট পেপার।
তাই স্বাভাবিকভাবেই সুপারমার্কেটের পুরো র্যাকই খালি। টয়লেট পেপার না পেয়েও আমি অবশ্য তখন অব্দি নির্বিকারই ছিলাম। ‘বালতি ভর্তি পানি, বদনা আর একটা মগ থাকলেই তো হয়, শুধু শুধু টেনশন’। কিন্তু সুপারমলে আমার আশপাশের অজিগুলোর চেহারা হয়েছিল দেখার মতো। একজন ফোনে ‘হাপ্স, হুপ্স’
করতে করতে শেষ, ‘দেয়ার ইজ নাথিং, ইটস লিটারেলি এম্পটি। অল দ্য র্যাকস আর এম্পটি’!
আমি এর ভেতর থেকেও হিসাব করি, ওই যে সবজির তাকে ম্যালা সবজি আছে তো। ডিম আছে। ব্রেড তো অনেক আছে। এমনকি গোটাকয়েক আইসক্রিমও আছে। পাউরুটি দিয়ে ডিম টোস্ট, একটু সালাদ আর খাওয়ার শেষে ডেজার্টও কল্পনা করে ফেলি আমি! আর এদিকে কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর চলছেই, ‘এমটি এমটি, অল র্যাকস আর এমটি’।
এ ‘এমটির’
হাত থেকে বাঁচতেই তাড়াতাড়ি লাইনে দাঁড়াই আমি। প্রায় ২০-২৫ জনের মতো মানুষ লাইনে দাঁড়ানো। এত লম্বা মানুষের লাইন আমার প্রবাস জীবনে এ প্রথম দেখা। আর কাউন্টারে যিনি বসে আছেন, তিনি সম্ভবত তার জীবনে এ প্রথম এত মানুষ একসঙ্গে লাইনে দাঁড়ানো দেখেছেন। দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছি তিনিও ‘হাপ্স, হুপ্স’
করছেন, দুই কাঁধ উঁচু করে চোখ-মুখ বাঁকা করে প্রত্যেক কাস্টমারকে কী কী যেন সব বলছেন। আর মাঝে মাঝেই উঠে দাঁড়াচ্ছেন আবার দুই হাত মাথায় দিয়ে বসে পড়ছেন। আহা রে বেচারা!
আরেক বেচারা হলো আমার সামনের দাঁড়ানো বয়স্ক মানুষটা। বিড়বিড় করে কী সব যে বলছেন তা কে জানে! হঠাৎ করেই আমার দিকে ফিরে বলল, ‘ইউ ডোন্ট হ্যাভ আ ট্রলি? সিরিয়াসলি? ইউ ওয়ানা গো ইন ফ্রন্ট অব মি?’ আমি হেসে দিয়ে বললাম, ‘ইটস ওকে, হোয়াটস দ্য ডিফারেন্স বিটুইন থার্টি অ্যান্ড থার্টি টু মিনিটস?’ আশপাশের দু-চারজন একটু হাসাহাসি করল, যাক গুমোট ভাবটা একটু কাটল।
আসল মজাটা হলো চেকআউট কাউন্টারে। পাঞ্জাবি ভদ্রমহিলা আর তার পাশের ‘বয়স্ক’
ভদ্রলোক তাদের ট্রলি থেকে জিনিস রাখছেন। তাকিয়ে দেখি পাঁচ রকমের ১০-১২টা টিস্যুর প্যাকেট (কিচেন টিস্যু, ফেসিয়াল টিস্যু, পেপার টাওয়েল, পেপার ন্যাপকিন আর ওয়াইপস), ৩০
লিটার দুধ (পাঁচ লিটারের ছয় কার্টন), আরো
একগাদা কীসব যেন। কাউন্টারের ক্যাশে বসা ‘বেচারা’
এতক্ষণে রাগ ঢালার এক মোক্ষম জায়গা পেলেন! হাঁক ছেড়ে ডাক দিলেন স্টোর ম্যানেজারকে। শুরু হলো বাক্যবাণ ‘সরি, ইউ কান্ট টেক মোর দ্যান টু প্যাকস অব মিল্ক অ্যান্ড টিস্যুজ। দিস ইজ নট জাস্টিস ফর আদার্স, ব্লা ব্লা ব্লা’। ভদ্রমহিলাও মোদির দেশের লোক, তিনিও কম যান না। মুহূর্তেই বলে বসলেন, পাশের ভদ্রলোক আর তিনি আলাদা! যেহেতু পাশের ভদ্রলোক ‘বয়স্ক’
এবং ইংরেজি বোঝেন না, তাই তাকে তিনি সাহায্য করতে আসছেন। উনি দাম দেবেন ক্যাশে আর তিনি দেবেন কার্ডে। দুজনার আলাদা বাসা, আলাদা ঠিকানা, আলাদা সংসার, আলাদা হ্যানো আর আলাদা ত্যানো। অন্যদিকে স্টোর ম্যানেজারকে পাশে পেয়ে কাউন্টারের ‘বেচারা’র তো সে-ই খুশি। পিংক সিনেমার অমিতাভ বচ্চন স্টাইলে তিনি বলতে লাগলেন, ‘হি সেইড নো; অ্যান্ড নো মিনস নো’।
আপডেট: ১৬ দিন ধরে ঘরে আছি; বের হইনি একবারও।
আপডেট দুই: আমাদের শহরের স্যুয়ারেজ সিস্টেম এলোমেলো হয়ে গেছে। ড্রেনে মোজা, নন ফ্ল্যাশেবল ওয়াইপস, আন্ডার গার্মেন্টস, ছোট ছোট কাপড় আরো কত কী যেন পাওয়া গেছে! এ মানুষগুলো এত কিছু ব্যবহার করছে অথচ পানিটা ব্যবহার করার বুদ্ধি এদের এল না। কেন যে এরা খালি ট্রেনিং দেয় আমাদের মতো দেশগুলোকে; মাঝে-সাঝে কিছু বিষয়ে ট্রেনিং তো নিতেও পারে, তাই না?