করোনার প্রভাব

সামুদ্রিক মাছের রেকর্ড দাম পতন, লোকসানে ব্যবসায়ীরা

সুজিত সাহা চট্টগ্রাম ব্যুরো

নভেল করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) কারণে গত ২৫ মার্চ থেকে সারা দেশের প্রায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। নিত্যপণ্যের তালিকায় থাকলেও ওই সময় সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের অনুমতি দেয়া হয়নি। জাহাজ মালিকদের আপত্তির মুখে চলতি মাসের শুরুতে অনুমতি দেয়া শুরু করে সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তর। তবে ঝুঁকি নিয়ে মাছ আহরণ করলেও চাহিদা কমে যাওয়ায় রেকর্ড মূল্যপতন ঘটেছে সব ধরনের সামুদ্রিক মাছের। এতে বড় লোকসানের কবলে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।

২৩ দিন সমুদ্রে মাছ আহরণ করে কর্ণফুলী নদীতে ফিরে আসে এফবি কিংফিশার নামে একটি জাহাজ। চলতি মাসের শুরুতে ফেরত আসা জাহাজটি প্রায় ১২০ টন মাছ নিয়ে আসে। মাছ আহরণে প্রায় ২৩ দিনে জ্বালানি, শ্রমিক নাবিকদের বেতন-ভাতাসহ মালিকের খরচ হয় ৭০ লাখ টাকা। যদিও জাহাজের মাছগুলো বিক্রি হয়েছে প্রায় ৩০ লাখ টাকায়। রফতানি না হওয়ায় এবং দেশের বাজারেও চাহিদা না থাকায় ক্রেতা সংকটে লোকসানের কবলে পড়েছেন প্রায় সব জাহাজ মালিক ব্যবসায়ী। কারণে সম্প্রতি মাছ ধরার অনুমতি পেলেও সমুদ্রে জাহাজ পাঠাতে আগ্রহী হচ্ছে না অনেকেই। এতে শ্রমিক, নাবিক ক্যাপ্টেনের বেতন-ভাতা পরিশোধ করে বড় ধরনের লোকসানের শঙ্কায় রয়েছেন সামুদ্রিক মৎস্য খাতের বিনিয়োগকারীরা।

বাংলাদেশ হোয়াইট ফিশ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব তাজুদ্দিন তাজু প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, নিত্যপণ্যের তালিকায় থাকায় সামুদ্রিক জাহাজ ট্রলারগুলো মাছ আহরণ করছে। কিন্তু বৈশ্বিক সংকটের কারণে বিদেশী অনেক অর্ডার বাতিল হয়েছে। সেই সঙ্গে বাজারে মাছের দাম অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়ায় লোকসানের কবলে পড়েছেন জাহাজ মালিকরা। সংকট দীর্ঘ হলে খাতটিতে প্রণোদনা ছাড়াও ভর্তুকিমূল্যে জ্বালানি দিতে হবে। না হলে অনেক জাহাজই অনুমতিপ্রাপ্তি সত্ত্বেও সমুদ্রে মাছ ধরতে চাইবে না।

সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, নভেল করোনাভাইরাস আতঙ্কে ভোগ্যপণ্য, ওষুধসহ জরুরি ব্যবসা শিল্প-কারখানা ছাড়া দেশের প্রায় সব খাতের কর্মপরিধি সীমিত করার নির্দেশনা দেয় সরকার। এর পরিপ্রেক্ষিতে সমুদ্রে মৎস্য আহরণের অনুমতিও বন্ধ রাখে সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। কিন্তু জাহাজ মালিকদের দাবির মুখে কৃষি ভোগ্যপণ্য খাত হিসেবে এপ্রিল থেকে সমুদ্রে মাছ ধরার অনুমতি দেয়া শুরু করে আবার। এর মধ্যে ২৫ মার্চ অনুমতি দেয়া হয় ৪০টি জাহাজের। কয়েক দিন বন্ধ রাখার পর এপ্রিল অনুমতি দেয়া হয় ২৪টি জাহাজকে। এরপর এপ্রিল ১৭টি এপ্রিল অনুমতি দেয়া হয় ১৫টি জাহাজকে। এপ্রিলও বেশকিছু জাহাজকে সমুদ্রে মাছ ধরার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সাগরে মাছ ধরছে ১৪০টির মতো জাহাজ। অন্য প্রায় ৪৫টি জাহাজ কর্ণফুলী নদী খুলনায় রয়েছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, একটি মাছ ধরার জাহাজ প্রতিটি ট্রিপে যে মাছ আহরণ করে, তা অবতরণ কেন্দ্রে এসে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। বাণিজ্যিক জাহাজগুলো প্রতি কেজি মাছ নিলামে ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি করে। কিন্তু সাম্প্রতিক নভেল করোনাভাইরাসজনিত কারণে মাছের চাহিদা কমে যাওয়ায় দাম নেমে এসেছে ৪০-৬০ টাকায়। তাছাড়া সমুদ্রে কয়েক মাস ধরে মৌসুমি বা ক্রাশ ফিশের (হোয়াইট স্পটেড রাবিট ফিশ) আধিক্য বাড়ায় মাছের গড় দাম অস্বাভাবিক কমে গেছে। পণ্য পরিবহনসহ মানুষের মাছের চাহিদা কমে যাওয়ায় কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ সত্ত্বেও বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে রয়েছেন বাণিজ্যিক মৎস্য খাতের বিনিয়োগকারীরা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মশিউর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে নভেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্য খাত হিসেবে মৎস্য আহরণ খাতের বিনিয়োগকারীরা সবচেয়ে কষ্টের মধ্যে আছেন। মাছের দাম কমে অর্ধেকে নেমেছে। তাছাড়া পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়েছে, যানবাহন চলাচল না করায় নিরাপত্তার স্বার্থে নাবিক শ্রমিকদের জাহাজে বসিয়ে বেতন-ভাতা খোরাকি দিতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অনেক জাহাজের পরিচালন খরচও ফুরিয়ে আসবে বলে আশঙ্কা করেন তিনি।

উল্লেখ্য, দেশে মৎস্য খাতের বাণিজ্যিক বৃহদাকার জাহাজ রয়েছে ২২৫টি। এর মধ্যে ১৮০টি জাহাজ নিয়মিত সমুদ্রে মৎস্য আহরণের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের চারটি ফিশিং গ্রাউন্ড রয়েছে। এসব গ্রাউন্ডে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সামুদ্রিক মাছ ধরা পড়েছে লাখ ৩৭ হাজার ৪৭৬ টন। এরপর ২০১৭-১৮ অর্থবছর লাখ ৫৪ হাজার ৬৮৭ টন মাছ আহরণ করেন মৎস্যজীবীরা। সম্প্রতি সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড ছাড়া প্রায় প্রতিটি গ্রাউন্ডেই ক্রাশ ফিশের আধিক্যের কারণে বাণিজ্যিক জাহাজগুলো সংকটে পড়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন