পর্যালোচনা

নভেল করোনাভাইরাস ও আমাদের শ্রমবাজার

ড. সায়মা হক বিদিশা

বিশ্বব্যাপী নভেল করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতির চাকা শ্লথ হওয়ার ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি ছাড়াও পুরো বিশ্ব এখন বেকারত্ব আর দারিদ্র্যের শঙ্কায় বিপর্যস্ত। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রাথমিক প্রাক্কলনে দেখা গেছে যে নভেল করোনাভাইরাসের কারণে ২৫ মিলিয়ন মানুষ বেকার হয়ে যেতে পারে এবং এর ফলে দশমিক ট্রিলিয়ন সমপরিমাণ ক্ষতি হতে পারে শ্রমিকের আয়ের (২৭ মার্চ, ২০২০) বলা বাহুল্য, করোনার ভয়াবহতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সংখ্যা ঊর্ধ্বগামী হচ্ছে। আর এই মহামারী শেষ না হওয়া পর্যন্ত শ্রমবাজারের ওপর এর প্রকৃত প্রভাব বোঝা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক মন্দাসহ সামাজিক দূরত্ব পালনের ফলে সাময়িকভাবে কাজ হারিয়েছেন কাজ হারানোর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন দিনমজুর, রিকশাচালক, গৃহপরিচারিকা, মুদি দোকানদার, ক্ষুদ্র অতি ক্ষুদ্র দৈনিক আয়নির্ভর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নিম্ন নিম্নমধ্যম আয়ের মানুষ।

শ্রমবাজারের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিতদের অনেকের আয় সময় খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের পরিস্থিতি ভিন্ন। ব্যতিক্রম থাকলেও সার্বিকভাবে বলা চলে যে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজ নিম্ন উৎপাদক, নিম্ন মজুরির কাজ, যা অনেক ক্ষেত্রে অস্থায়ী ঝুঁকিপূর্ণও হয়ে থাকে। বাংলাদেশের শ্রমবাজারের পরিপ্রেক্ষিতে ৮৫ শতাংশের বেশি শ্রমিক যেখানে অনানুষ্ঠানিক খাতে জড়িত, সেখানে সংকটকালে সবচেয়ে আয় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন এসব খাতের শ্রমিকরা। খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে যদি আমরা যাই, তবে এখনো ৪০ শতাংশের বেশি শ্রমিক রয়েছেন কৃষি খাতে, ২০-২১ শতাংশ শিল্পে আর ৩৯ শতাংশ কর্মী রয়েছেন সেবামূলক খাতে। আপাতদৃষ্টিতে কৃষি খাতে, যার সিংহভাগই (৯৫ শতাংশ) অপ্রাতিষ্ঠানিক, কাজ হারানোর ঝুঁকি কম মনে হলেও চাহিদার ব্যাপক সংকট বাজারজাতের জটিলতার কারণে খামারকেন্দ্রিক কৃষি খাতে নিয়োজিতরা আয় সংকটে পড়তে পারেন। খামারবহির্ভূত কৃষিতে নিয়োজিতদের ক্ষেত্রে সংকট আরো গভীর হতে পারে। এছাড়া ধান কাটার মৌসুমে মূলত উত্তরাঞ্চলের অভ্যন্তরীণ অভিবাসী শ্রমিকের সংকট একদিকে যেমন কৃষকদের শ্রমিকের ঘাটতি তৈরি করতে পারে, অন্যদিকে অভিবাসী শ্রমিকদের জীবিকা নির্বাহও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে আমাদের শিল্প খাতের প্রায় ৯০ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক, কারণ নির্মাণকাজের বড় অংশের শ্রমিকসহ প্রচুর শ্রমিক ক্ষুদ্র ভাসমান ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, এসব কাজের একটি বড় অংশ শুধু অপ্রাতিষ্ঠানিকই নয়, অনেক ক্ষেত্রেই সাময়িক কিংবা দৈনিক বেচাকেনাভিত্তিক। সে কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে ধরনের কাজে নিয়োজিত অনেকে কাজ হারিয়ে ফেলতে পারেন এবং সাময়িকভাবে বেকার হয়ে পড়তে পারেন। সেবা খাতের একটি বড় অংশ (২৮ শতাংশ) প্রাতিষ্ঠানিক হলেও বাকি ৭২ শতাংশের মধ্যে রয়েছে অনেক ক্ষুদ্র নিম্ন আয়ের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, সামাজিক দূরত্বের সময়ে যারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, সেবাদানকারীর অনেকেই ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোয় কাজ করেন, তাই সময়ে তাদের অনেকে সাময়িকভাবে শহর ছেড়ে নিজ নিজ গ্রামে চলে গেছেন। একটা সময় পর্যন্ত এই গ্রামে ফেরা মানুষগুলো তাদের সীমিত সঞ্চয় পারিবারিক আয়ের মাধ্যমে চলতে পারলেও পরিস্থিতি বেশিদিন চললে তাদের অনেকের পক্ষেই দৈনন্দিন ব্যয়ভার বহন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে এবং সেক্ষেত্রে একটা বড় সময়ের জন্য তারা বেকার হয়ে যেতে পারেন। এছাড়া এদের অনেকে আবার শহরে থেকে গেলেও ঘরভাড়াসহ দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানো তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। 

উদ্ভূত পরিস্থিতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে চাহিদার সংকট। দেশীয় বাজারে সামাজিক দূরত্ব ছাড়াও নিম্ন নিম্নমধ্যবিত্ত ক্রেতার আয় হ্রাস, রেমিট্যান্সের নিম্নমুখী গতি-প্রকৃতি অনেক পণ্যের চাহিদার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষত বিভিন্ন বিলাস দ্রব্য সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ক্ষেত্রে (যেমন কাপড়ের দোকান, পার্লার, ছোট-বড় খাবারের দোকান) এটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এছাড়া বাংলা নববর্ষ কিংবা সংকট দীর্ঘায়িত হলে ঈদের মতো উৎসবকেন্দ্রিক বেচাকেনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ অনেক বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চাহিদা সংকটের আরেকটি দিক হচ্ছে, বৈশ্বিক বাজারের মন্দাবস্থা, যার কারণে তৈরি পোশাকের মতো রফতানিমুখী শিল্প-কারখানাগুলোর উৎপাদন বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। ফলে এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করেন, তাদের কাজ হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে শুধু মজুরিই নয়, শ্রমিকদের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে এমন কোনো সিদ্ধান্ত যেন কখনই নেয়া না হয়, সেদিকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।

তবে সার্বিকভাবে বলা চলে যে সঠিক কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে কর্মসংস্থান আর আয়ের বিপর্যয় করোনা পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে সামাজিক দূরত্বের অবশ্যই কোনো বিকল্প নেই, তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ক্ষতি মেনে নিতেই হবে। তবে নিম্ন নিম্নমধ্যম আয়ের শ্রমজীবী মানুষের ক্ষতি লাঘব করার জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট নীতিসহায়তা। সরকারের তরফ থেকে এর মধ্যে রফতানিমুখী শিল্পগুলোকে সহায়তা করার জন্য হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ছাড়াও নিম্ন আয়ের মানুষদের সহায়তার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়েছে (৭২,৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা), যা বর্তমান সংকট নিরসনে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এর আওতায় গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক হারে সহায়তা কর্মসূচির প্রসার, শহরের বস্তিগুলোয় নিয়মিতভাবে বিনা মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিতরণ, বাড়িভাড়া মওকুফ ছাড়াও স্বল্প মূল্যে বড় পরিধিতে রেশন ব্যবস্থা বাড়ানো যেতে পারে। অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র মধ্যম শিল্পগুলোর জন্য কাঁচামালের ওপর শুল্ক মওকুফ, স্বল্প সুদে ঋণের মতো নীতি সহায়তার মাধ্যমে ওইসব শিল্পে নিয়োজিত উদ্যোক্তা শ্রমিকদের সহায়তা করা যেতে পারে, যাতে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংকট না হয়। ইউরোপ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ফেরত প্রবাসী যারা কাজ হারাতে পারেন, তাদের জন্য প্রশিক্ষণ, স্বল্প সুদে বিশেষ আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে তাদের দেশীয় শ্রমবাজারে সংশ্লিষ্ট করার জন্য প্রণোদনার কথাও ভাবতে হবে। এছাড়া আয় বিপর্যয়ের কারণে নিম্ন আয়ের অনেকে যারা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দরিদ্র ছিলেন না, তাদের অনেকেই দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে আমাদের দারিদ্র্য বিমোচনের কর্মকৌশলের ক্ষেত্রেও পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি শ্রমবাজারের ঝুঁকি এড়াতে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য প্রয়োজন শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-ব্যক্তি খাত-শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিকল্পিত দক্ষতার সমন্বয়সহ শ্রমবাজারের আধুনিকীকরণ উৎপাদন ব্যবস্থার বহুমুখীকরণ।

 

. সায়মা হক বিদিশা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের

অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন