পর্যবেক্ষণ

অভিভাবকহীন এক বিশ্বের পথে...

মো. আব্দুল হামিদ

আপনার বাবাকে কখনো কাঁদতে দেখেছেন? আমি দেখিনি। পরিবারে শত ঝড়ঝঞ্ঝা, আর্থিক সংকট, রোগশোক কোনো কিছুই এই মানুষটাকে কাঁদাতে পারে না। কখনো ভেবেছেন—কেন? জিজ্ঞাসা করলে হয়তো তারা স্মিত হেসে বলবেন, ‘বাবাদের কাঁদতে নেই রে বোকা!’ আর হয়তো সে কারণেই (অধিকাংশ ক্ষেত্রে) মায়েদের আগেই বাবারা দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। যাহোক, সে অন্য আলোচনা। বলছিলাম, বাবারা কেন কাঁদেন না? জবাব অনেক রকমই হতে পারে। তবে সম্ভবত আসল কথাটি হলো, তিনি কেঁদে ফেললে পরিবারের অন্য সদস্যদের ভরসার জায়গাটা আর থাকে না। তখন সবাই মিলে লড়াই করার মানসিক শক্তি দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যায়।

তাছাড়া অনেক সময় মাত্র একজনের দৃঢ়তায় লড়াইয়ের যে রসদ জোটে, তা অভাবনীয় ফল বয়ে আনে। চে গুয়েভারা, নেলসন ম্যান্ডেলা, শেখ মুজিবুর রহমান, লি-কুয়ান ইউ, মাহাথির মুহাম্মদ, ফিদেল কাস্ত্রো, মুয়াম্মার গাদ্দাফি—এমন অনেকেই তার জ্বলন্ত উদাহরণ। আর সে কারণেই পরিবারে ভরসার প্রতীক হয়ে বাবারা হাল ধরে থাকেন। তাদের অনুপস্থিতিতে মা, বড় ভাই বা বোনদেরও অনেক সময় এমন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। তবে সেটা বাবা হলে শত উত্কণ্ঠার মাঝেও তার একটি বাক্য—‘আচ্ছা, আমি দেখছি কী করা যায়।’ আশার প্রদীপটা জ্বালিয়ে রাখেন। তখন আমরা বিশ্বাস করি, একটা কিছু হবে। অর্থাৎ লড়াই চলাকালে ঝাণ্ডাটা কাউকে না কাউকে সুউচ্চে তুলে ধরতে হয়।

যোগ্য নেতৃত্ব আবার নতুন করে বাঁচতে প্রেরণা জোগায়, কঠোর শ্রম দিতে উদ্বুদ্ধ করে। ম্যানেজার ও নেতার পার্থক্য তো এখানেই। বিপুল সম্পদ ও জনশক্তি থাকার পরেও সঠিক নির্দেশনার অভাবে একটি গোষ্ঠী হতাশ হয়, পরাজয় হয়ে ওঠে অনিবার্য। ভাবছেন, এমন বোধের জন্ম হলো কেন? গত কয়েক মাস অদৃশ্য প্রাণঘাতী এক ভাইরাসের কাছে স্বঘোষিত বিশ্বমোড়লদের অসহায় আত্মসমর্পণ বা নীরবতা আমাকে সত্যিই ভাবাচ্ছে। বিশেষত বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী যখন জনসম্মুখে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন, তখন ভরসার জায়গা খুঁজে পাওয়া সত্যিই মুশকিল হয়।

বলতে পারেন, ইতালির প্রধানমন্ত্রী তো আরো বিধ্বস্ত অবস্থায় মিডিয়ার সামনে এসেছেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই বলে নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। ঠিক আছে, কিন্তু তিনি পরিবারের আর পাঁচজন সদস্যের মতো একজন মাত্র। তার হতাশ হওয়া আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া মোটেই এক ব্যাপার নয়। নভেল করোনাভাইরাস আমাদের অনেক কিছু নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। তার মধ্যে গ্লোবাল ভিলেজের নাগরিকরা যে আক্ষরিক অর্থেই অভিভাবকহীন, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। গ্রামের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষটিরও কুঁড়েঘরে আগুন লাগলে তা নেভানোর লোকের অভাব হয় না। একটি অঞ্চল বা দেশ আক্রান্ত হলে সহসাই অন্যান্য এলাকা বা রাষ্ট্র থেকে সহযোগিতার হাত বাড়ানো হয়। কিন্তু করোনা প্রমাণ করে দিল—হায় হায়, কেউ কারো নয়!

একসময় বিশ্ব স্পষ্ট দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। তাদের অভিভাবকত্ব মানতে না পারাদের নিয়ে নতুন জোট ন্যামের উদ্ভবও হয়েছিল। কিন্তু কালক্রমে বন্যার পানি বাড়তে থাকলে যেমন সব পুকুর-খাল একাকার হয়ে যায়, তেমনি আমরাও এক বিশ্ব হয়ে গেলাম। সেখানে নেতৃত্বের আসনে বসল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাদের তর্জন-গর্জনে গোটা দুনিয়া তটস্থ আছে দীর্ঘ সময়। অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে অনেক অঞ্চলে। অনেক দেশকে করে রেখেছে অবরুদ্ধ। এমনকি কিউবা করোনায় ভীষণভাবে আক্রান্ত ইরানে মেডিকেল সাপোর্ট দিতে চায়,  তাতেও তাদের আপত্তি! কিন্তু ভুলে গিয়েছিল, নিজেরা আক্রান্ত হলে সুরক্ষা ব্যবস্থা কেমন হবে! মানুষ মারার যন্ত্র উদ্ভাবনে যতটা মনোযোগী ছিল, মানুষের জীবনরক্ষার উপাদান প্রস্তুতে তারা ছিল ঠিক ততটাই উদাসীন। করোনা না এলে বিশ্ববাসী হয়তো কখনো তা টেরই পেত না।

লোকে বলে, মুর্খ-অশিক্ষিতরা মৌলবাদী হয়। সাম্প্রদায়িকতার বীজ লালন ও চর্চা করে। কিন্তু গত মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্প সাহেবের জেতার মূল হাতিয়ার কী ছিল? নির্বাচিত হলে ওই দেশটির অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি-বৈদেশিক নীতিতে কীভাবে অবদান রাখবেন তা ব্যাখ্যা করার খুব একটা দরকার কি হয়েছিল? মোটেই না। জনগণকে শুধু তিনি গেলাতে পেরেছিলেন—‘Make America Great Again.’

কোন পদ্ধতি বা কৌশলে সেটা হবে তা-ও বলার খুব একটা দরকার হয়নি। দর্শন, যুক্তি ও তথ্য ছাড়াই সে দেশের জনগণ তার ওপর আস্থা রাখে। আর বিশ্বময় মার্কিন প্রভাবের কারণে অঘোষিতভাবেই তার সামনে বিশ্বনেতা হওয়ার দ্বার উন্মুক্ত হয়। কিন্তু তিনি দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবনাকে প্রসারিত করার পরিবর্তে সংকুচিত করায় মনোযোগী হন। ফলে তাদের লজ্জা নিবারণের জন্যও যে দেশের পোশাক ছাড়া চলে না, সেই রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। আজকের দিনে বাণিজ্যযুদ্ধ ও সামরিক যুদ্ধের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য আছে কি? বরং অনেক ক্ষেত্রে বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব অনেক বেশি বিস্তৃত হয়। জানি না ‘করোনা’ তারই সাইড এফেক্ট কিনা!

এ ভাইরাস ঠিক কোথা থেকে কীভাবে ছড়িয়েছে, তা নিয়ে নানা তত্ত্ব ও গুজব রয়েছে। আমার কাছে সেটা খুব বড় প্রশ্ন নয়। বরং এই ক্ষুদ্র ভাইরাসটি সবাইকে দেখিয়ে দিল যে আজকের বিশ্ব কতটা নেতৃত্বহীন। তথাকথিত মোড়লরা বা তাদের জোটগুলো আজ কেউ কারো দায়িত্ব নিতে চাইছে না। এমনকি এই উত্তাপ এখনো সেভাবে গায়ে না লাগা রাশিয়ার ভূমিকা সত্যিই হতাশাজনক। এত বড় শক্তি, তার চেয়েও বড় নেতা। অথচ কোনো দেশকে খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম দেয়ার কোনো সংবাদ আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি।

এমনকি বিশ্ব ফোরামে এটা নিয়ে কোনো প্রস্তাব বা উদ্যোগের কথাও শুনিনি। তবে হ্যাঁ, নিজ দেশের জনগণকে ঘরে রাখতে নাকি রাস্তায় সিংহ ছেড়ে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়ে নেটিজেনদের কাছে স্যালুট পেয়েছেন! পরে অবশ্য জানা গেছে সেই ছবিটা অনেক আগের, অন্য প্রেক্ষাপটের। কিন্তু বিশ্ববাসীর এমন বিপদের সময় তার কাছ থেকে কোনো উদ্যোগ না আসাটা আমার কাছে বিস্ময়কর লেগেছে। অন্তত আমেরিকাকে কিছু ত্রাণ দেয়ার ঘোষণা তো দিতে পারত, তাই না?

অন্যদিকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংস্থা জাতিসংঘ এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পেরেছে কি? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একের পর এক গৃহীত নীতির তীব্র সমালোচনা হচ্ছে গোটা বিশ্বে। চীনের সঙ্গে প্রথম কয় মাস তারা ঢাকঢাক গুড়গুড় না করে স্পষ্টভাবে গোটা দুনিয়াকে সতর্ক করলে হয়তো এর প্রকোপ কিছুটা হ্রাস করা যেত। আগামীতে যে বিশ্বমন্দা ও খাদ্য সংকট হতে যাচ্ছে, তার মোকাবেলায় বিশ্ব খাদ্য সংস্থার ভাবনাও আমরা এখনো জানি না। শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে বহু দেশে অশান্তি সৃষ্টিকারী ন্যাটো বোধহয় হাইবার নেশনে রয়েছে!

সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর জোট জি-সেভেন নাকি এ সংকট মোকাবেলায় এ পর্যন্ত একটা ভিডিও কনফারেন্সের আয়োজন করতে পেরেছে। বিরাট সাফল্য বটে! মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়া ওআইসির ঘুম ভেঙেছে কিনা, এখনো জানা যায়নি। বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থাগুলো যে রয়েছে, তাও আমরা ভুলে গেছি। অন্যান্য জোট ও সংস্থাগুলোও নীরব দর্শকের ভূমিকায় রয়েছেন। হয়তো ভাবছে, দেখি না কী হয়! আমাদের দক্ষিণ এশীয় সংগঠন সার্কের নেতারা একবার ভিডিও সম্মেলন করেছেন। পরের খবর আর জানা যায়নি।

সংসারে যখন সুসময় থাকে, তখন অনেকেরই ‘পরিবারপ্রধান’ হওয়ার শখ জাগে। কিন্তু দুঃসময়ে কেউ দায়িত্ব নিতে চান না। আজ গোটা বিশ্ব যেন সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। অনেকের বাহ্যিক মোড়ক করোনা ঝড়ে চুপসে গেছে। জাহাজ যখন ডুবতে থাকে, তখন কেউ আর ক্যাপ্টেনের নির্দেশনার দিকে তাকিয়ে থাকেন না। নিজের জান বাঁচানোর জন্য অকূল সাগরে সাঁতার কাটতে থাকেন। কেউ উদ্ধার করতে আসবে না, সেটা জানার পরও মানুষ সাঁতার কাটে।

গোটা বিশ্বের অসহায় নাগরিকরা আজ তেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। বিশ্বের শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকদের ভয়ার্ত মুখ দেখে আমরা ভয় পেতে ভুলে যাই। কারণ যাদের জীবন এত সুরক্ষিত বলে গর্ব করা হতো, তারাই আজ বিপন্ন। সেখানে আমরা এখনো খোদার রহমতে ভালো আছি। খুব শিগগিরই হয়তো করোনাসৃষ্ট দুর্যোগ কেটে যাবে। কিন্তু এই দুঃসময়ে বিশ্ব আবিষ্কার করল—কেউ তাদের দায়িত্ব নিতে চায় না!

পরিশেষে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন বিশ্ববাসীকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করেন। আর আমরা যতটা সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সহযোগিতা করি, কারণ তারা আমাদের কল্যাণেই নিরলস পরিশ্রম করছেন। বিশ্বের সব স্বাস্থ্যকর্মীকে জানাই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, তাদের সীমাহীন চেষ্টা ও ত্যাগের জন্য। 

মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন