নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় নতুন চারটিসহ পাঁচটি প্যাকেজে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন থেকে ঘোষিত এ প্রণোদনাকে স্বাগত জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন ও খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে ঘোষিত প্রণোদনার বিষয়ে এসব প্রতিক্রিয়া জানায় তারা।
প্রণোদনা ঘোষণা করায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমইএ)। সংগঠনটির সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রাণঘাতী মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বাংলাদেশসহ বৈশ্বিক এ দুর্যোগের সময়ে একজন মমতাময়ী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জাতির জনকের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুনির্দিষ্ট ব্যবসাবান্ধব কতিপয় বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করায় বিসিএমইএর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। চলমান এ সংকট থেকে উত্তরণে দেশের জনগণ ও অর্থনীতিকে রক্ষা করতে এখন পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গৃহীত সব পদক্ষেপের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা, সমর্থন ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
আমরা আশা করছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ উদ্যোগের ফলে দেশের অন্যান্য খাতের মতো সম্ভাবনাময় সিরামিক (টেবিলওয়্যার, টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যার) খাতেও নেমে আসা বিপর্যয় মোকাবেলা করা সহজ হবে। এতে করে সিরামিক শিল্প মালিকদের কিছুটা হলেও আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে সিরামিক শিল্পগুলোর তারল্য সংকট কাটিয়ে সুষ্ঠুভাবে ব্যবসা পরিচালনা করা সম্ভব হবে।
দেশের অর্থনীতিতে সিরামিক খাতের অবদানের বিষয়টি উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, রফতানি ও আমদানি-বিকল্প পণ্য হিসেবে দেশে এরই মধ্যে দেশী-বিদেশী প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে ৬৮টি সিরামিক (টেবিলওয়্যার, টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যার) শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাঁচ লাখের বেশি লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দেশীয় উৎপাদকরা সিরামিক পণ্য রফতানি করে যেমন বছরে চার শতাধিক কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সক্ষম হচ্ছেন, তেমনি স্থানীয় বাজারে পাঁচ হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হওয়ায় ক্রমান্বয়ে তৈরি পণ্যের আমদানি হ্রাস পাওয়ায় কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়/অপচয় রোধ হচ্ছে।
প্রণোদনার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) বলছে, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত এ প্রণোদনা দেশের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পকে সচল রাখবে এবং এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি অব্যাহত থাকবে বলে বিশ্বাস করে বিএবি।
প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজের উচ্চপ্রশংসা করেছে বেসরকারি খাতের থিংকট্যাংক বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)। এ পদক্ষেপ সময়োপযোগী ও অর্থনৈতিক শ্লথগতি মোকাবেলায় সহায়ক হবে বলে জানিয়েছে বেসরকারি খাতের এ থিংকট্যাংক।
বিল্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফেরদৌস আরা বেগম স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, কভিড-১৯-এর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব ঠেকাতে আজ (গতকাল) ‘অর্থনৈতিক প্রভাব ও অ্যাকশন প্ল্যান’
ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঘোষণায় কভিড-১৯-এর কিছু অর্থনৈতিক প্রভাবের ওপর গুরুত্বারোপ করেন প্রধানমন্ত্রী, যেগুলো কিনা বর্তমান প্রবৃদ্ধির ধারা ও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে ব্যাহত করতে পারে। এর প্রভাবে হোটেল, রেস্তোরাঁ, এভিয়েশন ও পরিবহন খাতে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে জানান তিনি। প্রথমে লকডাউনের কারণে এসএমই ও বৃহৎ শিল্পের রফতানিতে পতন এবং স্থানীয় বাজার, রেমিটেন্স ও ক্রয়ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে আসার বিষয় উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া সাপ্লাই চেইনে বিঘ্ন ঘটার বিষয়ও উল্লেখ করেন তিনি।
সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রভাবের বিষয় উল্লেখ করার পর ক্ষতিগ্রস্ত সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর জন্য ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার (৭২৭ দশমিক ৫০ বিলিয়ন) আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন তিনি, যা কিনা জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ। এর আগে রফতানি খাতের জন্য ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজসহ আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজের সর্বমোট আকার দাঁড়িয়েছে ৭৭৭ দশমিক ৫০ বিলিয়ন টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবর্তিত রফতানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) সুবিধা বর্ধিতকরণ, সুদের হার হ্রাস এবং ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতের জন্য সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করায় এ প্রণোদনা প্যাকেজটি নিঃসন্দেহে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের ধারা অব্যাহত রাখবে বলে আশা করা যায়।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) পূর্বাভাস অনুযায়ী, কভিড-১৯-এর কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৩০২ কোটি মার্কিন ডলার হারাতে পারে। একই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে এ ক্ষতির পরিমাণ আরো ব্যাপক বাড়তে পারে।
১ এপ্রিল ‘অ্যাকশন প্ল্যান টু ফাইট অ্যাগেইন্সট কভিড-১৯ ইন বাংলাদেশ’
শিরোনামে একটি নীতিগত পত্র প্রকাশ করে বিল্ড। এতে এসএমই এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতের জন্য ৫০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ অর্থনৈতিক সহায়তা তহবিল ঘোষণার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া কিছু নির্দিষ্ট খাতের জন্য কর ও মূসক অব্যাহতির সুপারিশও আনা হয়।
বিল্ড মনে করে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে এ তহবিলের অর্থ পৌঁছানোই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ইকোনমিক স্ট্র্যাটেজি কমিটি গঠন করা যেতে পারে বলে মনে করে বিল্ড। বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদেরও এ কমিটিতে যুক্ত করা যেতে পারে। বেসরকারি খাতের চেম্বার বা সংগঠনগুলোও এ কমিটিকে তথ্য প্রদানের মাধ্যমে সহায়তা করতে পারে। এর মাধ্যমে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত খাত ও শিল্পের কাছে সহায়তা পৌঁছানোর সম্ভাবনা বাড়বে। পাশাপাশি কিছু নির্দিষ্ট খাতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কর ও মূসক অব্যাহতিও বেসরকারি খাতের জন্য সহায়ক হবে বলে মনে করে বিল্ড।
প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজকে অত্যন্ত সময়োচিত ও বিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়কোচিত পদক্ষেপ বলে মনে করছে মিল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। সংগঠনটির সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, সাধারণ জনগোষ্ঠীসহ খেটে খাওয়া মানুষ এবং বিশ্বব্যাপী করোনার বিস্তারে সম্ভাব্য বিশ্ব মন্দার প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার লক্ষ্যে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের বিভিন্ন বিভাজনকে আমরা ইতিবাচক মনে করছি। প্রণোদনা প্যাকেজের বিভিন্ন বিভাজনে যে পদক্ষেপ তথা সরকার কর্তৃক গৃহীত ঋণের অর্ধেক সুদ প্রদান বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ও যুগান্তকারী। এর জন্য আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিলের মধ্য থেকে বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ সুবিধা প্রদান করায় তা টেক্সটাইল খাতসহ বিটিএমএর বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র এবং অন্যান্য ক্যাপিটাল ইনটেনসিভ ইন্ডাস্ট্রি বিদ্যমান আর্থিক সংকট কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। অন্যদিকে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় রফতানি উন্নয়ন তহবিলের সুদের হার হ্রাস করে ২ শতাংশ নির্ধারণ বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অত্যন্ত সময়োচিত বলে আমরা মনে করি।
বিটিএমএর প্রতিটি রফতানিমুখী সদস্যের অনুকূলে বরাদ্দকৃত রফতানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের তহবিল এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, এক্ষেত্রে কোনো কোনো মিল তা পরিশোধ করতে না পারায় বিদ্যমান ঋণ ওভারডিউ হয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য মিলগুলোর অনুকূলে এরই মধ্যে ইডিএফের আকার ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করা হয়েছে। বিটিএমএ মনে করে, বর্ধিত ইডিএফ ফান্ডের কারণে ইডিএফ ব্যবহারকারী রফতানিমুখী টেক্সটাইল মিলগুলো আরো বর্ধিত আকারে ইডিএফ পাবে। ফলে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে আরো উপকৃত হবে।
বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এবং বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন (বিইএফ)। কভিড-১৯-এর কারণে দেশের অর্থনীতিতে অবশ্যম্ভাবী প্রভাব কমাতে এটি একটি সময়োপযোগী ও সাহসী পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করে সংগঠন দুটি।
প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করায় প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়েছে পাবলিক কি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফোরাম বা পিকেআই ফোরাম। সংগঠনটি বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে যেমন বেকারত্ব ও শ্রমিক ছাঁটাই রোধ করতে প্রণোদনা প্যাকেজ সহায়তা করছে; তেমনি বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোও তাদের লোকবল ধরে রাখতে সক্ষম হবে।