সহায়তার টাকা আসবে কোত্থেকে দেয়া হবে কীভাবে?

মামুন রশীদ

সরকার যখন রাজস্ব আয়ের দুর্বলতায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ধার-কর্জ করে বাজেট বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, তখনই এল করোনার আঘাত। লাখো মানুষ অচলাবস্থায়। ফসকে যাচ্ছে বেশকিছু রফতানি আদেশ। প্রাতিষ্ঠানিক থেকে ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত অর্থনৈতিক দুরবস্থার ক্ষেত্র ক্রমেই বাড়ছে। সরকারের সামনে তীব্রতর হচ্ছে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রফতানি খাতের কর্মীদের বেতন-ভাতার জন্য হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিলসহ বেশকিছু প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। পরের ধাপে দিয়েছেন ৩১ দফা নির্দেশনা, যেখানে তিনি সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী, দিনমজুর-কৃষকদের খাবার দেয়া, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখা, খাদ্য উৎপাদন সরবরাহ ব্যবস্থা এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে বলেছেন। রোববার তিনি আগের হাজার কোটি টাকাসহ মোট ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছেন। বহুল আলোচিত ক্ষুদ্র মাঝারি তথা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে অর্থায়নের প্রণোদনা পুরো অর্থনীতিতেই কর্মযজ্ঞ সৃষ্টি করতে পারবে বলে অনেকে মনে করছেন। যদিও কৃষি খাতে প্রণোদনার বিষয়টি বেশ অনুচ্চারিতই রয়ে গেছে। তবে কৃষির ভালো ফলন আকাঙ্ক্ষা এবং অন্য খাতের প্রণোদনার চুইয়ে পড়া সুবিধা সর্বশেষে কৃষিতেও যাবে।

সরকারের সামনে এখন হাজারো খাতের, লাখো শিল্প-সেবা খাতের মন্দা মোকাবেলায় সহায়তার দাবি। সীমিত সম্পদ কাজে লাগিয়ে সরকার কাকে কীভাবে সান্ত্বনা দেবে, আয়-ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য আনবে কীভাবে প্রশ্ন সর্বত্র। পরিস্থিতির বিবেচনায় দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো পুনর্গঠনের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহলে। সরকারের ব্যয় ব্যবস্থাপনায় কৃচ্ছ্রসাধনসহ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প কাটছাঁট করা, উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ আর্থিক সহায়তা নেয়ারও সুপারিশ এসেছে। প্রয়োজনে টাকা ছাপিয়ে ব্যয় মেটানোর সুপারিশও করেছেন এক অর্থনীতিবিদ।

জানা যায়, সরকার রাজস্ব আয়ের দিক থেকে বড় ধরনের ঘাটতির মধ্যে রয়েছে। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে গেল বছরের চেয়ে রাজস্ব আয়ে শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি বেড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। সময়ে লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে মাত্র লাখ ৪৪ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা। অনেকেই বলেছেন, বছর শেষে নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে রাজস্ব ঘাটতি হতে পারে প্রায় লাখ কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার এরই মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বাড়তি ঋণ নিয়েছে। পুরো অর্থবছরে নেয়ার কথা ৪৭ হাজার কোটি টাকা, অথচ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়েই নেয় ৫২ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। করোনার কারণে আশঙ্কা করা হচ্ছে, ঋণের অংক লাখ কোটি পর্যন্ত উঠতে পারে।

করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের রাজস্ব আয় তো হবেই না, বরং যাদের কাছ থেকে শুল্ক-কর আদায় করার কথা, উল্টো তাদের এখন ছাড় দিতে হচ্ছে। রেমিট্যান্সে এরই মধ্যে নেতিবাচক ধারা শুরু হয়েছে। রফতানি খাতেও নেতিবাচক ধারা। এরই মধ্যে প্রায় বিলিয়ন ডলারের রফতানি আদেশ স্থগিত হয়েছে বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় সব খাত। এজন্য রফতানি খাতের পাশাপাশি দাবি উঠেছে কৃষি, আইসিটিসহ প্রায় সব খাতেই প্রণোদনা দেয়ার। রিকশা, ভ্যান, অটোরিকশাচালক, ফুটপাতের হকার, নির্মাণ শ্রমিকসহ বেশির ভাগ শ্রমজীবী মানুষের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। হোটেল, রেস্তোরাঁ, দুগ্ধশিল্প, পোলট্রি শিল্প, পর্যটন খাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে। ৭৩ লাখ ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প ক্ষতির মুখে পড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনীর পরিসর বাড়ানো। যার মাধ্যমে দরিদ্র অসহায়দের সহায়তা করা হবে। এসব খাতের জন্য এখন এই বিপুল অংকের অর্থ কোথা থেকে আসবে, এটিই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আসছে।

সরকার অর্থের জন্য এরই মধ্যে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষদের সহায়তা দেয়ার জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা, এডিবির কাছে হাজার ২৫০ কোটি টাকা, অন্যদিকে চীনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত নতুন এশীয় ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) কাছে চাওয়া হয়েছে হাজার ১২৫ কোটি টাকা। বিনিময় ভারসাম্য বা ব্যালান্স অব পেমেন্ট ঠিক রাখতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে চাওয়া হয়েছে হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। এছাড়া আইডিবির কাছে চাওয়া হয়েছে ৮৫০ কোটি টাকা। আইডিবির আরেক সহযোগী সংস্থা আইটিএফসির কাছে চাওয়া হয়েছে ৪২৫ কোটি টাকা। এছাড়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এডিপির থোক বাবদ যে হাজার ৬৩০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে, সেই টাকাও স্বল্প শ্রমজীবী মানুষের জন্য খরচ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে নভেল করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলায় ২২ হাজার কোটি টাকা পাওয়ার আশা করছে সরকার। তবে বাস্তবে তার কতটুকু পাওয়া যাবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ করোনা মহামারীতে আক্রান্ত বিশ্বের প্রায় সব দেশ। এরই মধ্যে আইএমএফের কাছে ৮৮টি দেশ ঋণ চেয়ে আবেদন করেছে। ফলে সবার চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হবে দাতা সংস্থাগুলোকে।

সরকার করোনার আঘাত মোকাবেলায় এরই মধ্যে পোশাক খাতের কর্মীদের বেতন-ভাতার জন্য হাজার কোটি টাকার তহবিল ঘোষণা করেছে। থেকে উদ্যোক্তারা শতাংশ সুদে তহবিল নিতে পারবেন। এছাড়া জুন পর্যন্ত সব ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়েছে। সময়ে ঋণ শোধ না করলেও খেলাপি হবে না। রফতানি আয় দেশে আনার ক্ষেত্রে চার মাসের পরিবর্তে ছয় মাস সময় দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইডিএফ তহবিল থেকে ছয় মাসের ঋণ নেয়ার সময়সীমা বাড়িয়ে নয় মাস করা হয়েছে। রফতানি আয়ের ৯০ শতাংশ অর্থ দেশে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নেয়ার বিধান সহজ করা হয়েছে। ঋণপত্র খোলার পর শিল্পের কাঁচামাল আমদানির সর্বোচ্চ সীমা দ্বিগুণ করা হয়েছে। ওষুধ চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানিতে গ্যারান্টি ছাড়াই লাখ ডলার পর্যন্ত অগ্রিম পরিশোধ করা যাবে। ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহকদের ৩১ মে পর্যন্ত সব ধরনের জরিমানা মওকুফ করা হয়েছে। এছাড়া সব ধরনের গ্রাহকদের বিদ্যুৎ গ্যাস বিল জুন পর্যন্ত জরিমানা ছাড়া পরিশোধের সুযোগ দেয়া হয়েছে। ঘরে ফেরা কর্মসূচির আওতায় কর্মহীনদের নিজ নিজ গ্রামে সহায়তা, গৃহহীন ভূমিহীনদের বিনা মূল্যে ঘর, ছয় মাসের খাদ্য নগদ সহায়তা ঘোষণা করা হয়েছে। এর বাইরে বিনা মূল্যে ভিজিডি, ভিজিএফ এবং ১০ টাকা কেজিতে চাল দেয়ার কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। এনজিওর গ্রাহকদের কিস্তি প্রদান স্থগিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের বেসরকারি খাত গেল এক দশকে যখন দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছিল, করোনা তার ভিত্তিমূলে শক্ত আঘাত করেছে। পহেলা বৈশাখের উৎসবও বন্ধ হয়েছে করোনার কারণে। উৎসব ঘিরে অন্তত -১০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হওয়ার কথা। ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তারা লক্ষ্যে যা বিনিয়োগ করেছিলেন তা রীতিমতো শেষ। তাই প্রণোদনার দাবি উঠেছে এই মহল থেকেও। দেশের পোলট্রি শিল্পও হুমকির মুখে। খাতে এরই মধ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। ব্রয়লার মুরগির কেজি নেমে এসেছে ৬০ টাকায়। হিমায়িত মত্স্য, চিংড়ি, কাঁকড়া-কুঁচিয়া রফতানি বন্ধ। এতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় হাজার কোটি টাকা। বড় বড় প্রক্রিয়াজাতকারী শিল্পের কাছে বিক্রি করতে না পারায় গ্রামে দুধ বিক্রি হচ্ছে ১৫-২০ টাকা কেজিতে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ বলছে, দেশের মোট শ্রমশক্তি কোটি লাখ। এর মধ্যে ১৪ দশমিক শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, আর বাকিরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। ফলে করোনার প্রভাবে প্রায় পাঁচ কোটি শ্রমজীবী নিদেনপক্ষে বেশ কিছুদিনের জন্য কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে।

পর্যটন খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, খাতে ক্ষতি হতে পারে হাজার ৭০৫ কোটি টাকার ব্যবসা। পাশাপাশি প্রায় লাখ হাজার ৫০০ লোকের চাকরি হারানোরও ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রণোদনা বা সহায়তা প্যাকেজ প্রায় সব খাতেরই কিছুটা হলেও পুনরুজ্জীবন বা ঘুরে দাঁড়ানোকে লক্ষ্য করেই করা। সীমিত সম্পদের দেশের জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি বিরাট অংকের টাকা। তবে ন্যূনতম পর্যবেক্ষণ মূল্যায়নের অভাবে টাকার কোনো উল্লেখযোগ্য অংশ যাতে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পকেটে চলে না যায়, সেটা নিশ্চিত করা একটি দুরূহ কাজ। বর্তমানে প্রচলিত জবাবদিহিতা কাঠামোয় পুরো বাস্তবায়নও প্রায় অসম্ভব। সেক্ষেত্রে অর্থায়ন প্যাকেজ বিতরণ বা কার্যকরণে যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে, তেমনি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর টাকা যথাযথ ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট কিছু এনজিওকেও ব্যবহার করা যেতে পারে। ২০০৭ সালে দক্ষিণ বাংলাদেশ সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনে ছয়টি এনজিও বা ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার মাধ্যমে বিতরণকৃত অর্থ বিরাটভাবে কাজ করেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থার গ্যারান্টির বিপরীতে সেই অর্থের বেশির ভাগ জোগান দিয়েছিল কিছু বেসরকারি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ব্যাংক। সরকারের ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা মোবাইল ব্যাংকিং সেবাকেও বিস্তৃতভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রযুক্তির মাধ্যমে জবাবদিহিতা হতে পারে একটি বিরাট উদাহরণ।

করোনা-পরবর্তী আঘাত মোকাবেলা সরকারের জন্য যেমন একটি চ্যালেঞ্জ, তেমনি সবাই মিলে দুর্নীতির ঊর্ধ্বে কাজ করতে পারলে সংকট মোকাবেলা সরকারের সক্ষমতাও বৃদ্ধি করবে। সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই হতে পারবেন বিরাট কৃতিত্বের দাবিদার।

 

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন