প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা

যথাসময়ে কার্যকর ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করুন

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন গতকাল। নভেল করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতির প্রভাব থেকে উত্তরণের পরিকল্পনা এটি। অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ এখনো পরিমাপ করা সম্ভব হয়নি বলে হিসাব সাময়িক। ক্ষতি পরিমাপের পর সহায়তা প্যাকেজের আকার বাড়তে বা কমতে পারে। কীভাবে এটি বণ্টন করা হবে, তাও নির্ধারণ করা হবে ধাপে ধাপে। করোনার প্রভাবে দেশে কর্ম হারানোর সংখ্যা বেড়ে যাবে। ফলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর বেশি জোর দেয়া হবে। লক্ষ্যে বড় শিল্পগুলোকে নতুন নতুন ইউনিট স্থাপন করে কর্মসংস্থান তৈরিতে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করা হবে। দেশে সরাসরি ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয়। এছাড়া পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে সারা দেশে কর্মসংস্থান ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি অর্থপ্রবাহ বেড়ে যায়। কারণে দুটি খাতকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। দুটি খাতে ঋণপ্রবাহ, অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়ানোসহ অন্যান্য সুবিধা দেয়ার বিষয়টিও বিবেচনায় নিয়েছে। এরই মধ্যে সব খাতে ঋণের কিস্তি পরিশোধের সীমা বাড়ানো হয়েছে। এটি আরো বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।

বর্তমানে কৃষিপণ্যের বিপণনে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কারণে কৃষিতে যাতে উৎপাদন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য খাতে টাকার প্রবাহ বাড়ানো হবে। টাকার অভাবে যাতে কোনো জমি চাষের বাইরে না থাকে, সেদিকে বিশেষ নজর রাখা হবে। খাতে অন্যান্য প্রণোদনাও দেয়া হবে। বাংলাদেশও করোনা সৃষ্ট সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। আইএলও বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর পৌতিয়াইনেন বলেছেন, বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের ক্রয়াদেশ এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে। স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তো রয়েছেই। ভাইরাস একই সঙ্গে প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমিকের অর্থনৈতিক অবস্থা জীবনযাত্রায়ও প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বিশাল অনানুষ্ঠানিক খাতকে ভুলে গেলে চলবে না। স্থবির হয়ে গেছে ক্ষুদ্র মাঝারি ব্যবসায়ীদের কর্মকাণ্ড। বয়স্ক কর্মীদের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি রয়েছে ছাঁটাই হওয়ার ভয়। অর্থনীতিবিদরা যথাসময়ে টাকা ছাড় করার তাগাদা দিয়েছেন। তারা বলেন, কারা অর্থ পাওয়ার যোগ্য, তাদের চিহ্নিত করতে হবে। এক্ষেত্রে যাতে অনিয়ম না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। সরকারের উদ্যোগকে ইতিবাচক উল্লেখ করে তারা সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে প্রণোদনার অর্থের যথাযথ ব্যবহারের ওপর জোর দেন। তবে অন্যান্য দেশের মতো পরিস্থিতি ভয়াবহ হলে তখন আরো ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে সরকারকে।

দিনমজুর, ফেরিওয়ালা, সাধারণ দরিদ্র মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা দিতে সরকার তহবিল গঠন করেছে। ক্ষুদ্র মাঝারি খাতের জন্য তহবিলের কথাও বলা হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে শিল্প-কলকারখানার শ্রমিক ছাড়াও এগুলো সরবরাহ, বাজারজাতসহ পরিবহন এবং অন্যান্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরাও সংকটে আছেন। ধরনের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহযোগিতার জন্য অতি অল্প সুদে আপত্কালীন ঋণের ব্যবস্থা করা যায়, যা পরবর্তী দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে তারা শোধ করতে পারবেন। তাহলে শিল্পগুলো হয়তো বেঁচে যাবে এবং এগুলোয় কর্মরত শ্রমিকরাও তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন। যারা আসলে ব্যাংকঋণ নেয়ার মতো অবস্থায় থাকেন না কিংবা যাদের ব্যবসাটা অনানুষ্ঠানিক খাতে, তাদের জন্য মূলত দরকার বাজারে পণ্যের চাহিদা তৈরি হওয়া বা সামষ্টিক চাহিদার অগ্রগতি। এক্ষেত্রে সরকারের যে বিভিন্ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন, সেগুলো করতে হবে যতটা সম্ভব এবং এসব ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অপচয় যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। সরকারের এসব ব্যয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা তৈরি হয়ে অর্থনীতির চাকা ঘুরতে থাকবে। তখন মানুষের হাতে আয় থাকলে তারা আবার অনেক পণ্য কেনাকাটা করবে। ফলে অনানুষ্ঠানিক খাতের উদ্যোক্তা যারা আছেন, সুফলটা তাদের কাছেও পৌঁছবে। সরকারের ব্যয় করা ছাড়াও যারা দেশের বড় শিল্পপতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় উদ্যোক্তা, তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তারা যেন তাদের প্রতিষ্ঠানের কোনো শ্রমিক-কর্মচারীকে ছাঁটাই না করেন; বরং নিজেদের প্রতিষ্ঠানের সঞ্চয় থেকে হলেও শ্রমিকদের যথানিয়মে বেতন-ভাতা দেন।

বর্তমানে দেশে প্রায় তিন কোটি মানুষ দরিদ্র চরম দরিদ্র। যারা দিন আনে দিন খায়। এদের রক্ষা করতে হবে প্রয়োজনীয় সহায়তার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের উদ্যোগ স্মরণীয়। পশ্চিমবঙ্গে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রেশনে রুপি দরে চাল বিক্রি করা হবে বলে জানিয়েছেন রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী। একই সঙ্গে রেশনে বিনা মূল্যে আটাও দেয়া হবে বলে গত ২০ মার্চ ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে পশ্চিমবঙ্গের কোনো মানুষ যেন অভুক্ত না থাকে, তার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। আমাদের দেশেও ন্যায্যমূল্যের খাদ্যদ্রব্যের মূল্য আপাতত অর্ধেক এবং ভিজিডি ভিজিএফের পরিধি বৃদ্ধি করা যেতে পারে। তাহলে মানুষের অনেক কল্যাণ হবে। উল্লেখ্য, দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে তথা সরকারি-বেসরকারি মিলে প্রায় ১৯ লাখ টন খাদ্য মজুদ আছে বলে জানা গেছে। উপরন্তু, আগামী এক মাসের মধ্যে নতুন করে বোরো ইরি ধান কাটা শুরু হবে। তাই খাদ্যের অভাব হবে না। সমস্যা শুধু মূল্য নিয়ে। তাই মূল্য কমানো আবশ্যক। অন্যদিকে সব ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ওয়ান স্টপ সিস্টেম চালু, উৎপাদনশীল সব খাতে সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষি এবং ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পোন্নয়নে, আইটি খাতের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। ঘোষিত প্রণোদনা সুবিধা যেন সঠিকভাবে ব্যবহার হয়, কোনো প্রকার অনিয়ম-দুর্নীতি-দলীয়করণ যেন না হয়, সেদিকে কড়া নজর রাখা দরকার। সেবা খাতগুলোয় ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি এবং এডিপির অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেয়া প্রয়োজন। সর্বোপরি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর ঋণ, অনুদান সমন্বিতভাবে ব্যবহার করা দরকার।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সরকারিভাবে দেশের সব শ্রেণীর মানুষের দুর্দশা লাঘব করাই আমাদের দায়িত্ব। প্রণোদনা প্যাকেজের সুফল সবাই পাবেন, তবে কেউ কোনো অসততার আশ্রয় নেবেন না। আমরা আশা করব, তার কথার যথাযথ বাস্তবায়ন হবে। অতীতে আমাদের প্রণোদনা ব্যবহারের ইতিহাস ভালো নয়। যাদের প্রণোদনা প্রয়োজন, তারা সবসময় এটা থেকে লাভবান হননি। তাই এবার প্রণোদনার উপকারভোগী কারা হবেন, সেটা সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। তা না হলে এটি মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে চলে যেতে পারে। ২০০৮ সালে মন্দার সময় আর্থিক প্রণোদনা নিয়ে নয়ছয় হয়েছে। যাদের জন্য প্রণোদনা, তারা সেটা সামান্যই পেয়েছেন। সাধারণ মানুষের উপকারে আসেনি। প্রণোদনা সুনির্দিষ্ট হতে হবে। যার জন্য প্রণোদনা, তিনি যাতে তা পান, সেটি মনিটরিংয়ের পাশাপাশি এক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনতে হবে। প্রণোদনা হতে হবে শর্তযুক্ত। নয়তো এটা কিছু মানুষের পকেটে যাবে। পাচার হয়ে যেতে পারে প্রণোদনার অর্থ। যেকোনো উপায়ে এর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। যার জন্য প্রণোদনা, তার পাওয়া নিশ্চিত না করা গেলে এটা খুব বেশি কাজে আসবে না। প্রণোদনা প্যাকেজ যথাসময়ে কার্যকর করাও জরুরি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন