আইসোলেশন নিয়ে মহাকাশচারীদের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ

বণিক বার্তা অনলাইন

পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক বাসিন্দা এখন ঘরবন্দি। কেউ কোয়ারেন্টিনে আবার কেউ আইসোলেশনে। কার্যত সবাই বিচ্ছিন্ন। এই ধরনের একটি পরিস্থিতিতে মানুষ নিজেদের অত্যন্ত অরক্ষিত ভাবতে শুরু করে বলে জানাচ্ছেন মনোবিদরা। এমনকি কোনো ধরনের পূর্ব প্রস্তুতি বা কাউন্সেলিং ছাড়া আকস্মিকভাবে দীর্ঘদিনের এই বিচ্ছিন্নতা ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনতে পারে বলেও সতর্ক করছেন তারা।

এ ধরনের পরিস্থিতির সবচেয়ে ভালো অভিজ্ঞতা রয়েছে মহাকাশচারী, দূরবর্তী গবেষণা কেন্দ্রের গবেষক বা সাবমেরিনের নাবিক প্রকৌশলীদের। তাদের সেই অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ হতে পারে কভিড-১৯ এর সময়ে ঘরবন্দি মানুষের জন্য অমূল্য উপদেশ।

সম্প্রতি অনলাইনে অ্যাস্টারয়েড ডে উদযাপিত হলো। এ উপলক্ষেই রোমানিয়ার প্রথম মহাকাশচারী দুমিত্রু প্রুনারিউ তার অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমানে কয়েকশ কোটি কোয়ারেন্টিনবাসীর প্রতি কিছু্ উপদেশ ও কৌশল জানিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন এমন একটি ভয়ঙ্কর পরিবেশে একটি আবদ্ধ স্থানে দীর্ঘদিন পরিবার পরিজন বন্ধু-বান্ধব বিহীন থাকলে কী ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয়। তিনি নিজেও এখন তার স্ত্রীর সঙ্গে নিজ বাড়িতে বন্দি।

এ নিয়ে প্রুনারিউ বলেন, আমরা ভালোই আছি। কিন্তু চারপাশে যা কিছু ঘটছে সত্যিই মাথা খারাপ করার মতো ব্যাপার। এখনকার সময়টা খুব বিপজ্জনক। আপনি যদি একটি বিচ্ছিন্ন স্থানে বেশি দিন থাকেন তাহলে বিভিন্ন জড় বস্তু, গাছগাছালি, কুকুর এসবের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করবেন। তিনি মজা করে বলেন, এসব বস্তু যখন আপনার কথার উত্তর দিতে শুরু করবে তখন বুঝবেন পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে!

সোভিয়েত ইউনিয়ন যুগে সালিউত মহাকাশ কর্মসূচির সঙ্গে ছিলেন প্রুনারিউ। এ কর্মসূচিতে গবেষণার উদ্দেশে মহাকাশচারীদের দীর্ঘ সময়ের জন্য একটি কক্ষপথে রাখা হতো। এ কর্মসূচির একজন মহাকাশচারী ভালেন্তিন লেবেদেভ। লেবেদেভ ১৯৮২ সালে একজন মাত্র ক্রুকে সঙ্গে নিয়ে সালিউত ৭ মহাকাশ স্টেশনে টানা ২১১ দিন কাটিয়েছিলেন। 

একমাত্র সঙ্গী আনাতলি বেরেজোভয়কে নিয়ে ওই দীর্ঘদিনের মহাকাশবাসের সময়কার মানসিক দুর্দশার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন তার ডায়েরি অব কসমোনাট বইয়ে তুলে ধরেছেন লেবেদেভ।

তিনি লিখেছেন, জুলাই ১১: আজ একটা কঠিন দিন। আমার মনে হয় আমরা বুঝতেই পারছি না আসলে আমাদের সঙ্গে কী ঘটছে। আমরা কথা বলছি না। ক্ষুব্ধ লাগছে। পরিবেশটা আরেকটু ভালো করার একটা উপায় আমাদের বের করতে হবে। 

লেবেদেভ সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে বলেন, এমন হয়েছে যে আমরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেউ কারো সঙ্গে কথা বলিনি। কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। গ্রাউন্ড কন্ট্রোল ক্রুদের সঙ্গে কড়া কথা বলেছি এবং শেষ পর্যন্ত পোর্টহোল দিয়ে বাইরে তাকানোই বন্ধ করে দিয়েছি।

নরওয়ের ইউনিভার্সিটি অব বারগেনের মনোসামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা বিষয়ক ডেপুটি ডিন গ্রো স্যান্ডাল বলেন, মহাকাশচারীর এ ধরনের প্রতিক্রিয়া একেবারে স্বাভাবিক।

স্যান্ডাল মার্স৫০০ প্রকল্পের প্রধান পর্যবেক্ষক ছিলেন। এ প্রকল্পে মহাকাশে ৫২০ দিনের কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে ছয়জন মহাকাশচারীকে পরীক্ষামূলকভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। স্যান্ডাল বলেন, এ ধরনের পরিবেশে সামাজিক ও স্নায়বিক একঘেঁয়েমি আমাদের বিষণ্নতা, উদ্বেগ, অনিদ্রা এবং মনোযোগে বিঘ্ন ঘটার মতো সমস্যার দিকে ঠেলে দিতে পারে। এমনকি এ পরিস্থিতি আশপাশের মানুষের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করতে প্ররোচিত করতে পারে।

স্যান্ডাল এখন রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা রোসকসমসে কাজ করছেন। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের এই সময় ও পরিবেশ এবং আমাদের পরীক্ষাধীন মহাকাশচারীদের অবস্থার মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কারণ মহাকাশচারীদের সম্ভাব্য সব পরিস্থিতি সামাল দেয়ার প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা থাকে। তারা অতি উচ্চ মটিভেশন পান এবং বেশ ভালোভাবে প্রস্তুত থাকেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের এ পরিস্থিতি একেবারে আকস্মিক এবং ব্যাপক বিস্তৃত।

অ্যাস্টারয়েড ডের আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন ব্রিটিশ নভোচারী টিম পিক। তিনটি মিশন মিলিয়ে মোট ১৮৫ দিন তিনি মহাকাশে কাটিয়েছেন। তিনি বলেন, অভ্যাস আর রুটিন মেনে চলাটাই আসল কথা। তিনি ও তার সহকর্মীরা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে থাকতে এ কাজটি খুব কড়াকড়িভাবে পালন করতেন। 

তিনি বলেন, এখন আমাদের বাড়িতেও এই কৌশলটি নেয়া দরকার। আমরা একে বলতে পারি ‘অস্বাভাবিকতাকে স্বাভাবিক করে তোলা’। দৈনন্দিন কার্যতালিকাটা ঠিক রাখতে একটা রুটিন তৈরি করতে হবে এবং সেটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করতে হবে। তাহলে দেখবেন এক সময় এটিই আপনার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে এবং সবকিছু ঠিকঠাক চলছে।

আল জাজিরা অবলম্বনে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন