কভিড-১৯

ঢাকামুখী ফিরতি ঢলে সংক্রমণের শঙ্কা বাড়ছে?

শামীম রাহমান

নভেল করোনাভাইরাস আতঙ্কে সাধারণ ছুটি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মরিয়া হয়ে ঢাকা ছেড়েছে মানুষ। জীবনের টানে আকস্মিক বাড়ি ফেরা সেই মানুষগুলোই আবার ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছে জীবিকার তাগিদে। গণপরিবহন বন্ধ রেখেও থামানো যাচ্ছে না মানুষের ঢল। হেঁটে, ফেরিতে চেপে ঢাকার পথে ছুটছে তারা, যাদের সিংহভাগই পোশাক খাতসহ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক। সামাজিক দূরত্বের নির্দেশনা স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে ঢাকামুখী মানুষের ফিরতি ঢলে বাড়ছে সংক্রমণের শঙ্কা।

সরকারের সঙ্গে পোশাক খাতসহ বিভিন্ন কারখানা-প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতা, গ্রামেও করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া কর্মসংস্থানের অভাব, অপ্রতুল চিকিৎসা সুবিধাসহ বিভিন্ন কারণে মানুষ ফের ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

নভেল করোনাভাইরাসের ভয় সত্ত্বেও মানুষের ঢাকায় ফেরার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথা বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক . সেলিম রায়হান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, নিয়মিত খাবার পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা, জনবহুল ঢাকায় ব্যাপক হারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ভয় লম্বা ছুটিতে পরিবারের সঙ্গে থাকার আশায় দলে দলে ঢাকা ছাড়ে মানুষ। এখন আবার চাকরি বাঁচাতে কিংবা কাজের খোঁজে ঢাকায় ফিরছে তারা। বিজিএমইয়ের সঙ্গে কোনো ধরনের সমন্বয় না করেই পোশাক কারখানাগুলো খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তটিকে অপরিকল্পিত অপ্রত্যাশিত বলেও অভিহিত করেছেন তিনি।

করোনা মোকাবিলায় ২৬ মার্চ থেকে পরের ১০ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে মানুষকে ঘরে থাকার নির্দেশনা দেয় সরকার। পরে এক সপ্তাহ বাড়িয়ে তা এগিয়ে নেয়া হয়েছে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত। ছুটির ঘোষণা  এসেছিল ২৩ মার্চ বিকালে। ২৩ থেকে ২৫ মার্চতিনদিনে কোটি ১০ লাখ সেলফোন ব্যবহারকারীর ঢাকা ছাড়ার তথ্য জানিয়েছে ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) ১০ দিন যেতে না যেতেই আবার গ্রাম ছাড়তে শুরু করেছে এসব মানুষ। যারা ফিরছেন তাদের বেশির ভাগই তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন কারখানার কর্মী। মাইলের পর মাইল হেঁটে ঢাকার দিকে আসছে মানুষ। ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ফেরিতে গাদাগাদি করে মানুষ আসছে ঢাকায়।

গতকাল দুপুরের পর থেকে কর্মস্থলমুখী মানুষের ঢল নামে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাটে। কর্মস্থলে যোগ দিতে দক্ষিণাঞ্চলের হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ করোনা আতঙ্ক নিয়েই কর্মস্থলে ছুটছে। মানুষের ঢল কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া ঘাট ব্যবস্থাপক আবু আব্দুল্লাহ রণি।

এদিকে বণিক বার্তার মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, যান চলাচল বন্ধ থাকলেও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে কর্মস্থল ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। ট্রাক, পিকআপ ভ্যান, মাইক্রোবাসে চড়ে রওনা দিয়েছে তারা। পাটুরিয়াঘাট, আরিচা উথলী বাসস্ট্যান্ডে অবস্থান করছে কয়েক হাজার মানুষ। প্রশাসন সড়কে চেকপোস্ট বসিয়েও মানুষের ঢল থামাতে পারছে না। প্রশাসনের কোনো হস্তক্ষেপই তারা মানছে না বলে জানিয়েছেন মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক এসএম ফেরদৌস।

শুধু ঢাকা নয়, চাকরি বাঁচাতে চট্টগ্রাম শহরের দিকেও ছুটছেন পোশাককর্মীরা। ৭০ কিলোমিটার পাহাড়ি সমতল পথ হেঁটে পোশাক শ্রমিকরা কর্মস্থলে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন রাঙামাটি প্রতিনিধি। গতকাল সকাল থেকে জেলা শহর বিভিন্ন উপজেলার পোশাক শ্রমিকরা দলে দলে হেঁটে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছেন। পথে পুলিশের বাধা থাকলেও মানবিক কারণে তারাও ছেড়ে দিচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানার কর্মী কুলসুম খাতুন জানান, গার্মেন্টস থেকে জানানো হয়েছে তারিখ কাজে যোগ না দিলে চাকরি থাকবে না।

তবে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরা বলছেন ভিন্ন কথা। মালিকদের দাবি, যেসব মানুষ ঢাকা বা চট্টগ্রামে ফিরছেন, তাদের মধ্যে পোশাক কারখানার শ্রমিকের সংখ্যা হাতে গোনা। অন্য খাতের কারখানা বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীর সংখ্যা বেশি বলে মত দিয়েছেন তারা।

শুধু চাকরি বাঁচাতেই নয়, গ্রামে কর্মসংস্থানের সুযোগ না পেয়েও অনেকে ফের ঢাকার পথে পা বাড়িয়েছেন। বিশেষ করে যারা দৈনিক মজুরি কাজ করতেন, তাদের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটছে বেশি। আটদিন গ্রামের বাড়িতে অলস বসে থেকে জমানো সব টাকা শেষ করে ফেলেছেন শরীয়তপুরের জব্বার মিয়া।

কিছু একটা করে অন্তত পেট চালানো যাবে প্রত্যাশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকার পথ ধরেছেন তিনি।

আর্থিক নিরাপত্তার পাশাপাশি চিকিৎসা সুবিধার বিষয়গুলোও মানুষকে ঢাকামুখী করে তুলছে বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ গ্রামে গিয়ে দেখছে সেখানেও থাবা বসিয়েছে করোনাভাইরাস। গ্রামে, জেলা-উপজেলায় এর তেমন কোনো চিকিৎসাও নয়। এমন পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় থাকলে অন্তত ন্যূনতম চিকিৎসা সুবিধা পাওয়ার আশায় ঢাকার পথ ধরেছেন অনেকে।

এমন অবস্থায় সরকারের ছুটি দেয়ার পদ্ধতিতেই ভুল দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক . নেহাল করিম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, মানুষ বাড়ি যাওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়লে সরকার তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ফেরার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। আতঙ্ক, চাকরি হারানোর ভয়, ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে উঠছে মানুষ।

এদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, লকডাউন কিংবা মানুষকে ঘরে নেয়ার যে উদ্যোগ এর আর্থসামাজিক প্রভাব অনেক বড়। এক ঘোষণার মধ্য দিয়ে এক থেকে দুই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে এসেছে। জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব। ইতিবাচক বিষয় হলো আমাদের খাদ্যের সরবরাহ ঠিকঠাক আছে। তবে খাবার কেনার অর্থ মানুষের কাছে নেই। সরকারের কাজ হলো খাবার মানুষের দ্বারে পৌঁছানো। এছাড়া সেলুন, মুদি দোকান, চায়ের দোকান, কাপড়ের দোকানের মতো লাখ লাখ দোকানির আয়ের পথ বন্ধ। তাদের দোকান ভাড়া অন্তত ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে। যারা ব্যবসা হারিয়েছে বা লোকসানে পড়েছে তাদের ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্প সুদে অর্থায়ন করতে হবে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, এই যে বন্ধ ঘোষণার পর বাড়ি যাওয়ার জন্য ভিড়, এখন আবার ফেরার পথে একই অবস্থা। নিয়ে উন্নত বিশ্বেও কথা হচ্ছে। আসলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সামাজিক দূরত্ব কতখানি সম্ভব? মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা না করতে পারলে, বেতন-চাকরির নিশ্চয়তা দিতে না পারলে কোনো ধরনের সচেতনতামূলক উদ্যোগই বাস্তবায়ন সম্ভব না। কিন্তু আমাদের সরকার সেটি কতটুকু দিতে পারছে?

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন