দক্ষিণ এশিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে দ্রুতগতিতে

বণিক বার্তা ডেস্ক

দক্ষিণ এশিয়ায় গতকাল নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা হাজার অতিক্রম করেছে। অঞ্চলের আট দেশের (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, নেপাল ভুটান) বড় একটি অংশ এরই মধ্যে লকডাউনে। বিচ্ছিন্নতার নীতি পরিপালন করা হচ্ছে অন্যান্য অংশেও। তার পরও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারি প্রশাসনের পক্ষে মহামারীর প্রকোপ ঠেকানো মুশকিল হয়ে পড়েছে। প্রকাশিত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অঞ্চলে নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমণের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সপ্তাহে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় কভিড-১৯- আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। বিশ্বব্যাপী মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ অঞ্চলের দেশগুলোর নাগরিক। অঞ্চলে রোগটির প্রাদুর্ভাব মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পরিস্থিতি কতটা সামাল দিতে পারবে, সে বিষয় নিয়েও বড় ধরনের শঙ্কা রয়েছে।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারি তথ্য বলছে, দক্ষিণ এশিয়ায় গতকাল পর্যন্ত নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে হাজার ১৬৯ জনের। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে মোট ১২৮ জনের।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত বাংলাদেশে নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে ৭০ জন। মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে নয়জনে।

নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে বর্তমানে দেশে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার নীতি প্রয়োগ করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিচ্ছিন্নতার নীতির যথাযথ পরিপালন নিশ্চিত করতে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। এর পরও অনেক স্থানে অনেককেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গিয়েছে। এছাড়া কারখানা চালুর ঘোষণা দেয়ায় গতকাল দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রচুর মানুষ ঢাকার দিকে রওনা দেয়। ট্রাক-পিকআপ-ফেরিসহ বিভিন্ন যানবাহনে একসঙ্গে এতজন মানুষ ভিড় করে আসার কারণে দেশে কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব নিয়ে শঙ্কা বেড়েছে। 

এছাড়া দেশের রফতানিমুখী শিল্প খাত নিয়েও তৈরি হয়েছে বড় ধরনের শঙ্কা। বিশেষ করে পোশাক খাত নিয়ে। বিশ্বব্যাপী বড় বড় ব্র্যান্ড রিটেইলার ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মোট ২৮০ কোটি ডলারেরও বেশি মূল্যের রফতানি অর্ডার বাতিল করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরই মধ্যে রফতানি গন্তব্যের পথে থাকা পণ্যের মূল্য পরিশোধে অস্বীকৃতি জানানোর ঘটনাও ঘটছে।

দেশে রফতানিমুখী পোশাক শিল্প খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেয়ার জন্য হাজার কোটি টাকার ঋণসহায়তার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। যদিও সহায়তা প্রদানের যে প্রক্রিয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটি নিয়ে আপত্তি তুলেছেন শিল্প মালিকরা। অন্যদিকে দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত কোটি দিনমজুরের জীবন-জীবিকা নিয়েও তৈরি হয়েছে বড় ধরনের শঙ্কা।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত কভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি শনাক্ত হয়েছে ভারতে। দেশটিতে গতকাল পর্যন্ত মোট আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে হাজার ৯০২ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৬৮ জনের।

বর্তমানে ভারতে লকডাউন কার্যকর রয়েছে। লকডাউন কার্যকর করা হচ্ছে বেশ শক্তভাবেই। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের অর্থনৈতিক শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ২৪ মার্চ আরোপিত লকডাউন সম্পর্কে দেশটির সরকারের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সেখানকার জনগণ ওষুধ, খাদ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় গৃহস্থালি পণ্য ক্রয় করা ছাড়া আর কোনো উদ্দেশে ঘর থেকে বেরুতে পারবে না। বর্তমানে দেশটিতে দূরপাল্লার সব ধরনের যান চলাচলও বন্ধ।

ভারতের স্বাস্থ্য খাতে মুহূর্তে সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকারের বিষয় হলো সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে দ্রুত নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো। ১৩০ কোটি মানুষের দেশটি কভিড-১৯-এর পরবর্তী হটস্পট হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিষয়টি মাথায় রেখে কভিড-১৯- আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার উদ্দেশ্যে দেশটিতে কমপক্ষে পাঁচ হাজার রেলওয়ে ওয়াগনকে পরিণত করা হয়েছে আইসোলেশন ওয়ার্ডে। দেশটির স্বাস্থ্য খাতের চিকিৎসক, সেবাদাতা, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বর্তমানে আসন্ন ঝড় মোকাবেলায় বেশ তত্পর হয়ে উঠেছেন। যদিও মুহূর্তে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ, টেস্টিং কিট ভেন্টিলেটরের অভাব।

বর্তমানে দেশটিতে সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধই বলা চলে। দেশটির অর্থনীতিতে গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ১১ বছরের সর্বনিম্নে। শ্রম খাতের কর্মহীন হয়ে পড়া ব্যক্তিদের জন্য হাজার ২৫০ কোটি ডলারের একটি রিলিফ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে দেশটির সরকার। কিন্তু সহায়তা তহবিলের অর্থ যাদের প্রকৃত সুবিধাভোগী হওয়ার কথা, তাদের সবার হাতে পৌঁছবে কিনা, সে বিষয়ে কিছুটা সংশয় এখনো থেকে গেছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশনসের (সিএফআর) এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে সন্দেহ পোষণ করা হয়েছে।

অবস্থায় দেশটির অভাবগ্রস্ত জনগণকে বিচ্ছিন্নতার নীতি পরিপালন করানোই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের জন্য। দেশটিতে বর্তমান করোনা সংকটে সবচেয়ে বেশি ভুগছে মহারাষ্ট্র রাজ্য। এখন পর্যন্ত রাজ্যটিতে ৫১৬ জনের সংক্রমণ নিশ্চিত হয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৬ জনের।

এখানকার প্রাদেশিক সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজেশ টোপি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বিষয়ে বলেন, যদি জনগণ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়মকানুন না মেনে চলে এবং সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তাহলে লকডাউন দীর্ঘায়িত করা ছাড়া আর কোনো গতি থাকবে না। সেক্ষেত্রে মুম্বাইসহ মহারাষ্ট্রের নগরাঞ্চলগুলোয় লকডাউনের মেয়াদ দুই সপ্তাহ বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স আরো জানায়, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু দিল্লির মতো বড় শহরে লকডাউন শেষে গণপরিবহন জনগণের জন্য খুলে দেয়া হবে ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে।

সংক্রমণের দিক থেকে ভারতের পরের অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান।  দেশটিতে গতকাল বিকালে হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, আক্রান্তের সংখ্যা ছিল হাজার ৭১৪। মৃতের সংখ্যা ৪০। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ডনে প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে, দেশটিতে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে পাঞ্জাব সিন্ধু প্রদেশে।

দেশেও বর্তমানে বিচ্ছিন্নতার নীতি প্রয়োগে পুলিশ-সেনাবাহিনী মাঠে নিয়োজিত রয়েছে। নীতির কঠোর প্রয়োগ করতে গিয়ে দেশটির নাগরিকদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কভিড-১৯ আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে। গতকাল পর্যন্ত দেশটিতে মোট ২৮১ জন করোনা রোগী পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ছয়জনের।

দ্বীপদেশ শ্রীলংকায় মোট আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে ১৫৯ জন। এর মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে দেশটির সরকার। অঞ্চলের অন্য তিন দেশ মালদ্বীপ, নেপাল ভুটানে এখন পর্যন্ত সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে যথাক্রমে ৩২, ছয় পাঁচজনের। তবে এই তিন দেশ থেকে এখন পর্যন্ত কভিড-১৯- আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন