বিদেশী ক্রেতারা কতটা দায়িত্বশীল?

সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর

আমেরিকা, জাপান, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতি এখন কভিড-১৯-এর প্রভাবে বিপর্যস্ত। প্রধান বাজার হিসেবে সেই প্রভাবের ঘূর্ণিতে আছে রফতানি আয়ে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত চামড়া, পাদুকা চামড়াজাত পণ্য। বাজারগুলোর সিংহভাগ খুচরা বিক্রয়কেন্দ্র দোকান বর্তমানে বন্ধ। স্বভাবতই শূন্যের কাছাকাছি নেমে এসেছে জুতা চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা। অ্যাডিডাস, নাইকি, ক্লার্কস, মেসিসের মতো বড় ব্র্যান্ডগুলোও ইউরোপ দক্ষিণ আমেরিকার বাজারে তাদের প্রায় সব বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। 

বর্তমান পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ খুচরা বিক্রয়কেন্দ্র বড় ব্র্যান্ডগুলোর কাছ থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করেছে। তাদের কাছ থেকে মোটামুটি তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া আমরা লক্ষ করছি।

. সব ধরনের অর্ডার বা ক্রয়াদেশ বাতিল করে দেয়া হচ্ছে। এমনকি যেসব পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে কিংবা জাহাজীকরণের জন্য প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে, সেগুলোর অর্ডারও বাতিল হয়ে যাচ্ছে।

. প্রতিশ্রুত দাম পুরোটা দিতে চাইছে না। হয় তারা ডিসকাউন্ট নিচ্ছে অথবা দাম পরিশোধের দীর্ঘমেয়াদি সুযোগ চাইছে। যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা একটি ব্র্যান্ড আমাদের কাছে সরবরাহ করা পণ্যের দামে ২০ শতাংশ ডিসকাউন্ট সুবিধা চেয়েছে। যদিও অর্ডারটি সেই প্রতিষ্ঠানের কাছে এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে। ডিসকাউন্ট সুবিধার পাশাপাশি সেই প্রতিষ্ঠান মূল্য পরিশোধের জন্য ২১ দিনের বদলে ২০০ দিন সময় চেয়েছে।

. ক্রয়াদেশে বিরতি দিতে বলার পাশাপাশি মার্চ থেকে সাত মাসের নিশ্চিত হওয়া ক্রয়াদেশগুলো জাহাজীকরণ করতে বারণ করছে। কিছু ক্ষেত্রে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, কেউ কেউ আরো দীর্ঘ সময়ের জন্য কারখানাগুলো উৎপাদন শিপমেন্ট বন্ধ রাখতে বলছে। কখন রফতানি শুরু হবে, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যই মিলছে না। বিষয়গুলো নিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে বার বার যোগাযোগেরও চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে তারা কোনো সাড়া দিচ্ছে না।

ক্রেতাদের কাছ থেকে তিন ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার প্রভাব পড়ছে সরাসরি কারখানাগুলোর রফতানি বাবদ আয়ে। বিক্রি মানেই তারল্য, আর তারল্য মানেই নগদ অর্থ, যা প্রয়োজন কর্মীদের বেতন, ওভারহেড সরবরাহের বিপরীতে অর্থ পরিশোধের জন্য। তৈরি পোশাকের কাঁচামাল আমদানি হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যাক টু ব্যাক এলসি বায়িং-এর মাধ্যমে। আমাদের খাতে কাঁচামাল আসে মূলত চীন থেকে। সাইট এলসি অথবা অগ্রিম অর্থের মাধ্যমে তা ক্রয় করা হয়। দাম পরিশোধের এসব পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় কাঁচামাল ব্যবহার করে প্রস্তুতকৃত পণ্য রফতানির সময়সীমা বজায় রাখতে। অবস্থায় মূল্য পরিশোধের সময়সীমা বাংলাদেশ সরকার বাড়িয়েছে, যা আমাদের আমদানি দায় মেটানোর জন্য অনেক সহায়ক হবে।

একটি ঐতিহ্যবাহী বিশ্বখ্যাত জুতার ব্র্যান্ড এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, ২০২০ সালে তারা আর কোনো মূল্য পরিশোধ করবে না। অর্থাৎ তারা এরই মধ্যে ক্রয় করা পণ্যের দাম পরিশোধ করবে না। এছাড়া ভবিষ্যৎ ক্রয়াদেশ দিলেও বছর সেগুলোর দাম পরিশোধ করবে না, যা কারখানাগুলোর তারল্য সংকট আরো প্রকট করছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশী কারখানাগুলোকে নিশ্চিত করা ক্রয়াদেশের ৫০ শতাংশেরও বেশি বাতিল করেছে যুক্তরাজ্যের আরেকটি ব্র্যান্ড। 

ছোট কারখানাগুলো যারা শুধু ব্র্যান্ড বা রিটেইলারদের জন্যই কাজ করে, তারা একদমই অসহায় অবস্থায় আছে। কারণ বিদেশী ক্রেতাদের সঙ্গে পণ্য নিয়ে তারা কোনো ধরনের দরকষাকষির সক্ষমতা রাখে না। যখনই প্রয়োজন তখনই তাদের বাসের নিচে ছুড়ে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়া ব্র্যান্ডগুলোর জন্য অনেক সহজ। বড় কারখানাগুলোর সমস্যাও একই রকম ভয়াবহ, কারণ তারা মৌসুমভিত্তিক কাজ করে। কিন্তু করোনার প্রভাবে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাদের আর কোনো কর্মসূচি নেই। নমুনা বা স্যাম্পল তৈরি ক্রয়াদেশ নিয়ে আলোচনা স্থগিত অথবা বাতিল হয়ে গেছে। এক্সপো শু রিভা নামের বিশ্বের একটি বড় জুতার প্রদর্শনী মেলা ইতালিতে অনুষ্ঠিত হতো বছরে দুবার। আগামী জুনে অনুষ্ঠিতব্য প্রদর্শনীটি এরই মধ্যে বাতিল করা হয়েছে। রকম আরো কয়েকটি জুতার প্রদর্শনী বাতিল বা স্থগিত হয়েছে। এসব মেলা বা প্রদর্শনীতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক কারখানা ভবিষ্যৎ মৌসুমগুলোর ক্রয়াদেশ পাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

এটা একটি অপ্রিয় সত্য যে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক শিল্প হওয়া সত্ত্বেও বিদেশী ক্রেতাদের সঙ্গে সমান শক্তি নিয়ে কথা বলতে পারে না। তারাই যদি না পারে, বাংলাদেশের অন্যান্য রফতানি খাত কী করতে পারে?

মার্চ ২২, ২০২০ পর্যন্ত এলএফএমইএবির সদস্য ১৬০ সক্রিয় কারখানার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯ কোটি লাখ ডলার বা হাজার ৬১৭ কোটি টাকার বিদ্যমান ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে বিদেশী ক্রেতারা। যার প্রভাবে সরাসরি ১৮ হাজার ২০০ শ্রমিকের চাকরিচ্যুতির সম্ভাব্য ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

মার্চ ২০২০- অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের রফতানি বাবদ বিক্রিতে এরই মধ্যে ৫১ শতাংশ পতন দেখেছি আমরা। ক্রয়াদেশ পরিমাণ এখন পর্যন্ত ২৩ লাখ ৪৭ হাজার জোড়া থেকে ৪০ শতাংশ কমে ১৪ লাখ ১৩ হাজার  জোড়া হয়েছে। রফতানি আয় কমেছে ৪৬ শতাংশ। হাজার ৪৩৭ কোটি টাকার রফতানি আয় হাজার ৫১ কোটি টাকা কমে হাজার ৩৮৬ কোটি টাকায় ঠেকেছে, মার্কিন ডলারে যার পরিমাণ কোটি ৪৪ লাখ।

তাইওয়ানের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে পরিচালিত একটি কারখানার ব্যবসা মার্চেই কমেছে ৩৫ শতাংশ। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাদের ৬৮ কোটি টাকা বা ৮০ লাখ ৯০ হাজার ডলারে ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে।  আরো বেশি উদ্বেগের বিষয় হলো, চূড়ান্ত সমঝোতা হয়ে গেছে এমন ক্রয়াদেশ হারানো। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের জন্য নিশ্চিত হওয়া ক্রয়াদেশের পরিমাণ ছিল ১৬৫ কোটি টাকা বা কোটি ৯৬ লাখ ডলার।

কিছু ব্যতিক্রম আছে, আমরা জানতে পেরেছি ডাইশম্যান, মাইকেল কোর্টস, কোচের মতো প্রতিষ্ঠান যারা বাংলাদেশ থেকে পণ্য ক্রয় করে, তারা  এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে যে কোনো রকম মূল্য হ্রাস হবে না এবং ক্রয়াদেশ বাতিলও হবে না। আরো শুনতে পেয়েছি, সংকটের শুরুতেই কারখানা বন্ধ রাখতে উৎসাহ দিয়ে লোকসান ভাগ করে নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে ডিক্যাথলন। হয়তো তারা জাহাজীকরণের তারিখ পুনর্নির্ধারণ বা কিছু ক্রয়াদেশ পরিমাণ সমন্বয় করবে। এটাই হলো প্রকৃত অংশীদারিত্ব, আমাদের শিল্পের নায়কও তারা। দুঃখজনক হলো ধরনের নায়কদের সংখ্যা যথেষ্ট নয়।

আমরা দেখেছি, জনসম্মুখে নাম উল্লেখের লজ্জার পরই কেবল কিছু বড় ক্রেতা, বলা যায় বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক ব্র্যান্ড রিটেইলার নিশ্চিত ক্রয়াদেশ ফিরিয়ে নেয়া থেকে পিছিয়ে যায়। ক্রয়াদেশ বাতিলের মাধ্যমে তারা যে পরিমাণ অর্থ বাঁচিয়েছিল তার কিছু পেত কারখানা, আমাদের সরবরাহকারী এবং সবচেয়ে বেশি পেত আমাদের শ্রমিক-কর্মচারীরা। আমরা যুক্তরাষ্ট্রে রিটেইল খাতে ছয় লাখ কর্মীর ফরলো অর্থাৎ বিনা বেতনে দীর্ঘ ছুটির কথা জেনেছি, কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে সরকার স্বাস্থ্য বেকারত্ব সুবিধা প্রদান করবে। কিন্তু বাংলাদেশী শ্রমিকরা ধরনের কোনো সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় পড়েন না। কারণেই আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা হওয়া উচিত যেন বাংলাদেশের শিল্প শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। 

এখানে আমাদের অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৫ মার্চ  রফতানি খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের তিন মাসের বেতন পরিশোধের জন্য হাজার কোটি টাকার তহবিল ঘোষণা করেছেন। আমরা তার সহায়তার প্রশংসা করি এবং আমরা নিশ্চিত যে তার সরকার রফতানিকারকসহ গোটা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের পাশে থাকবে, যাতে করে স্বল্প সময়ের মধ্যে আমরা নিজের পায়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারি। কিন্তু সময়ে পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠী ঘরে বদ্ধ। বলা হচ্ছে, ১০০ বছরের সবচেয়ে তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছি আমরা। আমাদের আশঙ্কা, ছয় মাসের মধ্যে আমাদের শিল্প-কারখানাগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা। 

ব্র্যান্ড রিটেইলার যারা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দায়িত্বশীল সোর্সিং, মানবাধিকার সামাজিক কল্যাণের বক্তৃতা দিয়ে আসছিলেন, তাদের পক্ষ থেকে আমরা ধরনের অংশীদারিত্ব নেতৃত্ব প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে দেখেছি তাদের বেশির ভাগই কথা অনুযায়ী কাজ করেন না। দিন শেষে শুধু তালগাছ নয়, মাটি, এমনকি পারলে বাতাসটাও তাদের। টেকসই ব্র্যান্ড, দায়িত্বশীল সোর্সিং, অংশীদারিত্ব ইত্যাদি আমরা ধরনের অনেক সুন্দর কথা শুনেছি, এখন সেগুলোর প্রতিফলন কোথায়? বিদ্রূপ অর্থে শোনা যায় যে বড় ক্রেতাগুলো সাসটেইনেবিলিটি নিয়ে কাজ করে এমন কর্মীদেরই প্রথমে চাকরিচ্যুত করছে। 

ব্র্যান্ড রিটেইলাররা গোটা বিশ্বে তাদের সব পণ্য সরবরাহকারীদের প্রতি কী ধরনের আচরণ করে তার প্রকৃত লিটমাস টেস্ট হবে এখনই। সংকটের পর ব্র্যান্ডগুলোর কোনো ইকুইটি যদি অবশিষ্ট থাকে, তাহলে এখন তাদের অবশ্যই ন্যায়সংগত আচরণ করা উচিত। তাদের অগ্রাধিকার কি শুধুই তাদের মুনাফা, তাদের শেয়ারহোল্ডার-শেয়ারের মূল্য এবং কিছুটা তাদের কর্মীদের কর্মনিরাপত্তা? নাকি সত্যিই তারা বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব কারখানায় যারা দীর্ঘদিন ধরে তাদের জন্য কাজ করে আসছে, তাদের পাশে দাঁড়াবে এবং সঠিক কাজটি করবে? আমরা দেখছি, বাস্তবিকভাবে গোটা বিশ্ব দেখছে। ইতিহাস মনে করিয়ে দেবে।

সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন