কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী দেশে শনাক্ত হওয়ার পর ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। মূলত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ক্ষেত্রে পিপিই ব্যবহার জরুরি হলেও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ এর ব্যবহার শুরু করেছে। আর এ সুযোগ কাজে লাগাতে নানা ধরনের কাপড় সেলাই করে পিপিই হিসেবে বাজারে বিক্রি করছেন একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী। পিপিই হিসেবে ব্যবহারযোগ্য না হলেও বরং এগুলোর ব্যবহারে সংক্রমণের শঙ্কার পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। এমন প্রতারণাকে গুরুতর অপরাধ বিবেচনায় দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সাধারণ ছুটিতে পুরো দেশ প্রায় অচল থাকায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ই-কমার্স সাইটগুলোতে জমে উঠেছে মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের পাশাপাশি পিপিই ব্যবসা। বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে এসব পণ্য। ই-কমার্সের পাশাপাশি বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরেও বিক্রি করা হচ্ছে পিপিই। এসবের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও প্রয়োজন ও পরিস্থিতির কারণে অনেকে সেগুলো ব্যবহার করছেন। চিকিৎসক, নার্স ও হাসপাতালসংশ্লিষ্টরা ছাড়াও জরুরি সেবাসংশ্লিষ্ট অন্য পেশাজীবীদের এখন পিপিই ব্যবহার করতে হচ্ছে। এমনকি নভেল করোনাভাইরাস আতঙ্কে পিপিই ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে অন্যদেরও। এ সুযোগে পানিরোধক কাপড় দিয়ে পোশাক তৈরি করে তা পিপিই বলে বিক্রি করা হচ্ছে।
ফেসবুক ও ই-কমার্সের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে দেয়া বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে পিপিই। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান সব ধরনের পিপিই পণ্য বিক্রি করছে। আবার কেউবা একটি আইটেম বিক্রি করছে। একটি ফেসবুক পেজে দেখা যায় ৮০ জিএসএমের পানিরোধী কাপড় দিয়ে ফ্রি সাইজে তৈরি করা পিপিইর দাম রাখা হয়েছে ১ হাজার টাকা। আবার ৬০ জিএসএম কাপড় দিয়ে তৈরি পিপিই বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকায়। ৪০ জিএসএম কাপড়ে তৈরি পিপিইর দাম ৫০০-৬০০ টাকা।
সাধারণত বাংলাদেশের পোশাক উদ্যোক্তারা পিপিই প্রস্তুত করে না বলে জানিয়েছে পোশাক শিল্প মালিক সংগঠন (বিজিএমইএ)। সংগঠনটি বলছে, পিপিই প্রস্তুত করতে যে ফ্যাব্রিক্স ব্যবহার করা হয়, তার মেডিকেল গ্রেড থাকে ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মান বজায় রেখে তা প্রস্তুত করতে হয়। এ ফ্যাব্রিক্স মূলত চীন থেকে আমদানি করতে হয়। আবার পিপিই পোশাক তৈরির জন্য কারখানাগুলোকে বিশেষ ধরনের মেশিনারিজ ব্যবহার করতে হবে। কারখানায় জীবাণুমুক্ত পরিবেশে উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। এসবের জন্য প্রশিক্ষণও দরকার। সব মিলিয়ে বাংলাদেশী কারখানায় পিপিই তৈরি করতে কমপক্ষে ছয় মাস বা আরো বেশি সময় প্রয়োজন।
সংগঠনটি আরো জানায়, উদ্যোক্তারা বিকল্প উৎস হিসেবে চীন থেকে পিপিইর ফ্যাব্রিক্স আনছেন। এতে করে লিড টাইম ১৫-২০ দিন লাগবে, যেহেতু বিমানপথে এখন দীর্ঘসূত্রতা অনেক বেশি। যে মুহূর্তে এ আমদানীকৃত ফ্যাব্রিক্স উদ্যোক্তাদের হাতে আসবে, তখনই তারা পিপিই তৈরিতে এ ফ্যাব্রিক্স ব্যবহার করা শুরু করবেন। আইএলও, ডব্লিউএইচও, ডব্লিউএফপি ও ইউনিসেফসহ অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাহায্য নিয়ে রফতানি উপযুক্ত পিপিই বানানোর যাবতীয় কারিগরি জ্ঞান অর্জন এবং প্রয়োজনীয় মেশিন ও আনুষঙ্গিক উপকরণ হাতে পেতে এ শিল্পের ছয় মাস থেকে এক বছর সময় লাগবে বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ।
এ ধরনের পিপিই ব্যবহার থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, সরকার অনুমোদিত ও প্রদত্ত পিপিই ছাড়া অন্য কোনো ধরনের পিপিই ব্যবহার নিরাপদ নয়। আর এ সংকটকালীন মুহূর্তে যারা পিপিইর নামে সুরক্ষা পোশাক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ই-কমার্সে বিক্রি করছেন, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুতই অভিযান শুরু করা হবে।
এদিকে মানসম্মত পিপিই নিশ্চিত করতে লিগ্যাল নোটিস পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী। মনিরুজ্জামান লিংকন নামের ওই আইনজীবী নোটিসে আগামী সাতদিনের মধ্যে স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ সরকারের করোনা প্রতিরোধ সেলকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। অন্যথায় পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে নোটিসে আইনজীবী মনিরুজ্জামান লিংকন উল্লেখ করেন, ব্যাপক চাহিদার কারণে আমাদের দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পিপিই তৈরি করছে, যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পিপিইতে সংক্রমণ প্রতিরোধের যেসব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, সেটি নিশ্চিত করা হচ্ছে কিনা? কারণ আমরা এরই মধ্যে লক্ষ্য করেছি, পিপিই ব্যবস্থা নেয়ার পরও চিকিৎসকরা আক্রান্ত হচ্ছেন।
পানিরোধক পোশাক তৈরি করে যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ই-কমার্সে বিক্রি করছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, মানহীন পণ্য পিপিই বলে অনলাইনে বিক্রি করা গুরুতর অপরাধ। এ বিষয়ে পুলিশ কাজ শুরু করেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই এসব অসাধু চক্রকে শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
