করোনা সংকট ও বিশ্ব অর্থনীতি

সেলিম জাহান

করোনা সংকট বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের অর্থনীতির কথা স্বাভাবিকভাবে উঠে আসছে। বৈশ্বিক সংকট বিশ্ব অর্থনীতিতে তার প্রভাব বিষয়ে ২০০৮ সালে  অর্থনৈতিক সংকটের কথা উঠে আসছে নানাভাবে। কিন্তু আমি মনে করি, তুলনা প্রাসঙ্গিকও নয়, যথার্থও নয়। অন্তত তিনটে বিষয় বলা যায় প্রসঙ্গে।

এক. বর্তমান সংকটের সঙ্গে যুক্ত ব্যাপক প্রাণহানি, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটে সেটা প্রাসঙ্গিক ছিল না। সেই সঙ্গে ২০০৮ সালে জনমানুষের গৃহবন্দি হওয়ার ব্যপারটি ছিল না, ২০২০- সেটাই বর্তমান সময়ের সংকটের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রিকতা এবং এর অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়াও আছে। দুই. ২০০৮-এর সংংকট উত্তরণের মোটামুটি একটি সময় প্রাক্কলন করা গেছে। কিন্তু বর্তমান সংকট উত্তরণের কোনো সময় বা সময়সূচি কেউ বলতে পারে না। তিন. ২০০৮ সালে সংকট উত্তরণের কলাকৌশল নীতিনির্ধারকদের জানা ছিল, কারণ অমন অর্থনৈতিক সংকট আগেও হয়েছে নানান দশকে।

করোনা সংকটের বৈশ্বিক প্রভাবকে তিনটি সময়সীমার পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যায়ন করা যেতে পারেস্বল্পকালীন, মধ্যমেয়াদি দীর্ঘমেয়াদি। স্বল্পমেয়াদে তিনটে বিরূপ অর্থনৈতিক প্রভাব পড়তে পারে বর্তমান করোনা সংকটের। প্রথমত. যেহেতু সবকিছু বন্ধ করে দেয়ার ফলে বেশির ভাগ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর বিধি-নিষেধ আছে। ফলে নানা প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা অসহায়ভাবে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। ফলে তাদের কর্মসংস্থান, আয় জীবনযাত্রার মানের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। বিরূপ প্রভাবের মূল শিকার হচ্ছেন তারাই, যারা অদক্ষ শ্রমিক, সেবা খাতে কর্মরত এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন।

দ্বিতীয়ত, খাদ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জোগান কমে যাওয়ায় খাদ্যসামগ্রীর লভ্যতা একটা বিরাট সমস্যায় পরিণত হয়েছে। শিশুরা এর এক বিরাট শিকার। খাদ্যসামগ্রীর আকালে দরিদ্র মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিঃসন্দেহে।

তৃতীয়ত, এরই মধ্যে বিশ্ব অর্থবাজারে বেশ টালমাটাল অবস্থা দেখা দিয়েছে। নানা বিনিময়পত্রের দাম পড়ে গেছে। আর্থিক বাজারের গতিবিধি নিম্নমুখী, যাকে সামাল দেয়া যাচ্ছে না। দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পুরো স্তব্ধ হয়ে আছে।

মধ্যমেয়াদে আবারো তিনটে প্রবণতার দিকে দৃষ্টি ফেরানো যেতে পারে। প্রথমত, বৈশ্বিক একটি মন্দা দেখা দেবে। তার ব্যাপ্তি গভীরতা হয়তো অভাবনীয় হবে। মন্দার ফলে দরিদ্র দেশগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেশি। ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেবে। দ্বিতীয়ত, দেশের মধ্যে উৎপাদন কাঠামো আরো বিপর্যস্ত হবে। ফলে উৎপাদন কর্মসংস্থান আরো সংকুচিত হবে। শ্রমজীবী মানুষ সেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জালে নিষ্পেষিত হবে। তৃতীয়ত, বহু ক্ষুদ্র মাঝারি ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে যাবেন। যুক্তরাজ্যে প্রাক্কলন করা হচ্ছে যে প্রায় আট লাখ ক্ষুদ্র মাঝারি ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা হারাবেন।

দীর্ঘমেয়াদে বছর কৃষিকাজে কর্মযজ্ঞ না হওয়ায় আগামী বছর বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আকাল বা দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সেই সঙ্গে করোনা-মৃত্যুর আপাতন যদি বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর ওপর পড়ে, তাহলে জনমিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন দেশের নির্ভরতার হার কমে যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এমনও হতে পারে যে কর্তৃত্ববাদী অর্থনীতিগুলোই হয়তো সমস্যার সমাধান দ্রুত অল্প আয়াসে করতে পারবে। সেটা যদি হয় তাহলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন হতে পারে।

শেষের কথা বলি। ঠিক সময়ে সংকটের একেবারে মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের কথা বলা বড় কঠিন। কোনো রকম পরিমাণগত প্রাক্কলন তো দুঃসাধ্য। তাই মোটাদাগের কিছু প্রবণতার কথাই উল্লেখ করা হলো। এগুলোই একমাত্র কথা নয়, শেষ কথা তো নয়ই।

 

সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন