কভিড-১৯

করোনা বিষয়ে স্বচ্ছ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন

ড. আকতার মাহমুদ

গবেষণা কাজের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, তারা সবাই একটা বিষয়ে একমত হবেন যে বাংলাদেশে সবসময় প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই গুণগত মানসম্পন্ন তথ্য-উপাত্তের অভাব প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়। জাতীয় দুর্যোগের সময় তো ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা আরো কঠিন হয়ে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ১৯৭০ সালের তিন লাখ এবং ১৯৯১ সালে প্রায় দেড় লাখ মারা যাওয়ার মতো দুর্যোগ সংঘটিত হয়েছিল। খুঁজে দেখলে দেখা যাবে এত বড় ঘটনার সরজমিনে কোনো বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত নেই। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষ হিসেবে মাঝে মাঝে খোঁজার চেষ্টা করেছি। ক্রেডিবল কিছু পাওয়া যায় না। এখন দেশে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। শুধু উপযুক্ত তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করেও অসাধারণ তথ্য জোগাড় করা সম্ভব। তবে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করার পদ্ধতি তৈরি করা, তথ্য সংরক্ষণ করা এবং কার্যকরভাবে প্রক্রিয়া করে সেটা উপযুক্তভাবে ব্যবহার করার মুনশিয়ানা থাকতে হবে। এমন নয় যে কাজগুলো করার জন্য উপযুক্ত কারিগরি লোক বাংলাদেশে নেই। প্রচুর দক্ষ ব্যক্তি রয়েছেন, যারা ধরনের স্থানিক সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে জানেন। আগে এই জায়গাটা পরিষ্কার হতে হবে যে রকম তথ্যপ্রবাহ প্রদর্শন উন্মুক্ত হোক, এটা আমাদের দেশ চায় কিনা।

আমরা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) পক্ষ থেকে চেষ্টা করছিলাম বাংলাদেশে করোনাভাইরাস বিস্তারের ম্যাপ নানা ধরনের তথ্যসংবলিত একটি ওয়েবসাইট তৈরি করার। কিছু কাজ আগেই করা ছিল, দরকার ছিল শুধু করোনায় আক্রান্তদের কিছু তথ্যের। মনে করেছিলাম দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আক্রান্ত রোগীদের শারীরিক অবস্থার তথ্য দিয়ে জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেমের (জিআইএস) মাধ্যমে ম্যাপ তৈরি করা হবে, যা সরকারি-বেসরকারি এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষ ব্যবহার করতে পারবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। দেশের কোন এলাকায় করোনার বিস্তারের গতি-প্রকৃতি কী, বিস্তারের হার কেমন, তীব্রতা কত বেশি, আক্রান্তের সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, মৃত্যু রোগমুক্তি ইত্যাদি বিষয়ে ম্যাপে দেখানো হবে। ধরনের ম্যাপ দেখেই সহজে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে কোথায় কোন ধরনের কাজ করতে হবে এবং কোথায় কোন ধরনের কর্মতত্পরতা দেখাতে হবে।

কিন্তু কাজটি করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেল না কোনোভাবেই। অল্প কিছু পাওয়া যায়, তা- আবার পুরনো। বিষয়টির গুরুত্ব বিচারে স্বল্প পরিমাণের পুরনো ডাটা দিয়ে কাজ হয় না। প্রতিদিনই বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি এতই দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে যে দুদিন আগের তথ্য আর কাজে লাগে না। প্রতিদিনের তথ্য প্রতিদিন সংগ্রহ করে প্রতিদিন কাজে লাগাতে হয়। বছরের ২২ জানুয়ারি থেকে বিশ্বে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রথম এক লাখে পৌঁছেছিল ৪৫ দিনে, দ্বিতীয় এক লাখ পার হয় তার পরের ১১ দিনে, তৃতীয় এক লাখ পাঁচদিনে, এবং চতুর্থ, পঞ্চম ষষ্ঠ এক লাখ করে বাড়তে সময় লেগেছিল গড়ে মাত্র দুদিন করে। কথাগুলো এই কারণে বললাম যে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা, তা ব্যবহার উপযোগী করে উপস্থাপন করা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা রোগের বিস্তার কমাতে পারে। তার উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। কোরিয়া হংকং নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরু থেকে সুনির্দিষ্টভাবে রোগীর স্থানিক সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ম্যাপ তৈরি করেছে এবং সেটা সবার জন্য প্রদর্শন ব্যবহারের ব্যবস্থা করেছে। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে যে কয়টি দেশ সাফল্য পেয়েছে, তাদের মধ্যে দুটি দেশও অন্যতম। সাফল্যের পেছনে যে বিষয়গুলো কাজ করেছে, তার মধ্যে আস্থা রাখা যায় এমন স্বচ্ছ তথ্যপ্রবাহ অন্যতম। 

বৈশ্বিক করোনা সংক্রমণ এখন যে পর্যায়ে আছে, তাতে কথাও সত্যি যে করোনা সংক্রমণের তথ্য-উপাত্ত এমন কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে আসতে হবে, যার ওপর আস্থা রাখা যাবে এবং যার আইনি ভিত্তিও আছে। যে কেউ চাইলে এমন তৈরিও যেমন করতে পারেন না, তেমনি উপস্থাপনও করতে পারেন না। বাংলাদেশে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা ইনস্টিটিউট কাজটি করে আসছে। তাদের ওয়েব পেজে কিছু ডাটা পাওয়া যায়, কিছু ডাটা পাওয়া যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে। এছাড়া দুর্যোগ অধিদপ্তরের দৈনন্দিন দুর্যোগ পরিস্থিতি প্রতিবেদনে বিভাগওয়ারি কিছু উপাত্ত পাওয়া যায়। আশান্বিত হয়েছিলাম https://corona.gov.bd/ পেজটি দেখে। দেখলাম এখানে কিছু ডাটা বিশ্লেষণ আছে এবং আছে জেলাভিত্তিক একটা ম্যাপ। কিন্তু পরক্ষণে হতাশ হলাম ম্যাপের সঙ্গে লিংক করা ডাটা সারণি দেখে। শুধু কোয়ারেন্টিন আইসোলেশনে থাকা মানুষের ডাটা আছে সেখানে।

রোগীদের সম্কর্কে নানা ধরনের সঠিক নির্ভরযোগ্য তথ্য সরকারের যেকোনো দুর্যোগে তাত্ক্ষণিক প্রস্তুতির জন্য দরকার। করোনায় আক্রান্ত রোগীর বয়স, তার অন্যান্য রোগের ইতিহাস, আগের অন্তত দুই সপ্তাহের অবস্থানগত ইতিহাস ইত্যাদি থেকে চিহ্নিত করা যায় কোথায় কারা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সুবিধাজনক হয়। আবার চিহ্নিত রোগীকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখা, চিকিৎসা দেয়া, নিরাময় হওয়া, মৃত্যুবরণ করা, সংক্রমণের হার, বিস্তারের হার, কোথায় আশঙ্কাজনক রোগীর সংখ্যা বেশি আছে ইত্যাদির ডাটাবেজ তৈরি করা গেলে কম সময়ে সঠিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। তা না হলে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়ে যায়।   

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য কেন্দ্র থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারি অবকাঠামো রয়েছে। নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে সহজেই প্রয়োজনীয় সব তথ্যই দ্রুত সঠিকভাবে পাওয়া যেতে পারে। দরকার একটি কেন্দ্রীয় তথ্যকেন্দ্র এবং তথ্যকে প্রক্রিয়া করার উপযুক্ত ব্যবস্থা। তবে তার আগে দরকার প্রতিটি জেলা-উপজেলা, সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত মেডিকেল ইকুইপমেন্ট, যা দিয়ে সঠিকভাবে কভিড-১৯- আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা যাবে এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ করার উপযুক্ত সরঞ্জাম, যা তাদের কাজে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেবে। পরিস্থিতি যদি তৈরি করা যায় তাহলে একটি মোবাইল অ্যাপ দিয়ে প্রতিটি জেলা-উপজেলা হাসপাতাল থেকেই প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ভালো মানের একটি ডাটাবেজ প্রস্তুত করা সম্ভব। স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসে জমা হতে থাকবে চাহিদা অনুযায়ী তথ্য-উপাত্ত।

মাঝে মাঝেই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বলতে দেখি, নভেল করোনাভাইরাসের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের কাছ থেকে মেডিকেল ইকুইপমেন্টস নিতে চায়। এতে দোষের কিছু দেখি না, যুক্তরাষ্ট্র অন্য কিছুও আমাদের কাছ থেকে নিতে পারে। কিন্তু মুহূর্তে আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সঙ্গে সংগ্রাম করছেন। সাধারণ মানুষের করোনা উপসর্গ দেখা দিলেও নিশ্চিত হতে পারছে না যে তার আসলে কী হয়েছে। কেউ মারা গেলেও সন্দেহের ডালপালা গজাতে শুরু করে, লোকটা মনে হয় করোনা আক্রান্ত ছিল। এমন মনে হওয়ার সুযোগ থাকবে কেন? ওই রোগীর তো আগেই পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার কথা। এখনো মেডিকেল ইকুপমেন্টসের অভাবে স্বাস্থ্যকর্মীরা ভালো সেবা দিতে পারছেন না। তাই যুক্তরাষ্ট্রে মেডিকেল ইকুইপমেন্টস সরবরাহের আগে আমাদের দেশের মানুষদের ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কাজ করা দরকার।

যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সব দেশের জন্য একটি মাত্র বার্তা, সেটি হলোটেস্ট, টেস্ট এবং টেস্ট। আক্রান্তদের দ্রুতই শনাক্ত করে তাদের উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হলো করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রাথমিক স্তরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অথচ বিশ্বে কভিড-১৯- আক্রান্ত দেশ থেকে আসা কয়েক লাখ মানুষ দেশে ফিরে এসে যে যার মতো করে বিভিন্ন স্থানে তাদের স্বজনদের কাছে চলে গেল। ব্যক্তিগত, পারিবারিক অথবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিজেকে অন্যদের কাছ থেকে স্বেচ্ছায় সঙ্গনিরোধ বা সেলফ কোয়ারেন্টিন না করে সবার সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করল। সেখানেই সবচেয়ে বড় ভয়। এদের অনেকেরই সঠিক তথ্য আমাদের কাছে নেই। টেলিভিশনে দেখছি দেশের বিভিন্ন স্থানে রোগী মারা যাচ্ছে। আর তাদের নভেল করোনাভাইরাসের লক্ষণ ছিল বলে রোগীর স্বজনরা দাবি করছে। সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, দেশে বর্তমানে যথেষ্ট পরিমাণ পরীক্ষা করার কিট আছে। তাহলে কেন এসব রোগীর অবস্থা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না?

ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসআপ ইত্যাদিতে সারা দিন দেখি নানা রকম কাজের-অকাজের তথ্যের আদান-প্রদান। তার বেশির ভাগের কোনো বৈজ্ঞানিক সমর্থন নেই। অমুক গাছের পাতা, তমুক বীজের তেল রোগ নিরাময় করে। ধরনের সেনসেশনাল বার্তাগুলো খুব দ্রুতই ছড়ায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধরনের গুজব, অনুমাননির্ভর তথ্য মানুষকে বিভ্রান্ত করবে আবার কখনোবা মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করবে। গুজব বন্ধের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে অবাধ, স্বচ্ছ বাস্তবভাবে সঠিক তথ্য সবার কাছে তুলে ধরা। এতে মানুষ সহজে তার করণীয় বুঝতে পারবে। ব্যক্তিগত তথ্য নয়, বরং সামষ্টিক তথ্য দিয়ে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে করোনা-সম্কর্কিত শক্তিশালী ডাটাবেজ থাকা প্রয়োজন এবং ডাটা বিশ্লেষণ করে ম্যাপিং হওয়া প্রয়োজন, যা দেখে সহজেই সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। তথ্যের প্রবাহ যত বেশি অবাধ স্বচ্ছ হবে, সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা তত বেশি বাড়বে।

. আকতার মাহমুদ : অধ্যাপক নগর পরিকল্পনাবিদ

প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন