অভিমত

করোনায় আক্রান্ত দেশগুলোয় মৃত্যুহার ভিন্ন কেন?

ড. মো. মিজানুর রহমান

সারা বিশ্বে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা এক মিলিয়ন অতিক্রম করেছে। এর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ। আক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে। ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটেছিল ১৪০ কোটি মানুষের দেশ চীনের উহান প্রদেশে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। চীনে ৮০ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়, মৃত্যু হয় তিন হাজারের বেশি মানুষের। হঠাৎ করে আবির্ভাব হওয়া নভেল করোনাভাইরাস এত দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়বে তা শুরুতে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। এখন পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় সব দেশের মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে।

আক্রান্ত দেশগুলোয় করোনায় মৃত্যুহার একেক জায়গায় একেক রকম দেখা যাচ্ছে। এর প্রকৃত কারণ খুঁজতে গিয়েই লেখা। মৃত্যুহার কীভাবে গণনা করতে হবে, সেখানে বিভিন্ন মত আছে। যদিও বহুল স্বীকৃত পদ্ধতি হলো, মোট আক্রান্তের সংখ্যার সঙ্গে মোট মৃত্যুর সংখ্যার শতকরা হিসাব করে মৃত্যুহার গণনা করা। শুক্রবার পর্যন্ত হিসাবে দেখা যাচ্ছে সর্বোচ্চ আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে মৃত্যুহার ইতালিতে ১২ শতাংশ, স্পেন, ফ্রান্স যুক্তরাজ্যে শতাংশ, অন্যদিকে জার্মানিতে শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ায় শতাংশ। বিভিন্ন দেশের মধ্যে মৃত্যুহারের এই বিশাল তারতম্য কেন? যেখানে ভাইরাসটির মিউটেশন হার একেবারেই নগণ্য, সেখানে প্রতিবেশী দেশ হলেও জার্মানিতে এত কম মৃত্যুহার কিন্তু ইতালি, স্পেন যুক্তরাজ্যে এত বেশি মৃত্যুহারের প্রকৃত কারণ কী?

তাহলে কি ভাইরাসটি একেক দেশে একেক রকম আচরণ করছে? কিন্তু সেটাও বলা যেত যদি রাষ্ট্রগুলো প্রতিবেশী না হতো। আরেকটি বিষয় হলো, তুলনামূলকভাবে ইউরোপের দেশগুলোয় চিকিৎসা ব্যবস্থা বেশ উন্নত। আসল কারণ খুঁজে বের করার আগে আমরা আলোকপাত করি দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে। চীনের বাইরে দেশটির কাছাকাছি সময়ে আক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সবচেয়ে সফল দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। পৃথিবীর ১২০টিরও বেশি দেশ সরাসরি সহযোগিতা কামনা করেছে কোরিয়ার কাছে। কোরিয়া যে কাজটি সফলভাবে করেছে তা হলো, প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে সম্ভাব্য আক্রান্ত এবং সেই আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে জড়িত সবাইকে আলাদা করা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে বিষয়, তা হলো টেস্টিং। কোরিয়া তাদের টেস্টিং ক্ষমতার কারণে সম্ভাব্য সবাইকে টেস্টিংয়ের আওতায় এমনভাবে এনেছে যে তাদের অন্য দেশগুলোর মতো লকডাউন চালু করতে হয়নি। উল্লেখ্য, চীন ১৪০ কোটি মানুষের দেশ হলেও তারা সহজেই কঠিন লকডাউনের মাধ্যমে দ্রুত সাফল্য পেয়েছিল। কিন্তু অন্য দেশগুলো সময়মতো লকডাউনও করতে পারেনি, আবার বিকল্প কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে পারেনি; যা করে দেখিয়েছে একমাত্র কোরিয়া।

এবার আসি জার্মানির দিকে। জার্মানিতেও এত কম মৃত্যুহারের সবচেয়ে বড় কারণ হলো টেস্টিং। জার্মানি সারা দেশে ব্যাপক হারে টেস্ট করছে। ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র জার্মানি তাদের দেশের সম্ভাব্য সব জায়গায় টেস্ট করে যাচ্ছে। জার্মানির অতি কম সময়ে দ্রুততার সঙ্গে টেস্টিংয়ের ক্ষমতা অর্জনের পেছনেও কারণ আছে। জানুয়ারির দিকে চীনের বাইরে যে দু-তিনটি দেশ নির্ভরযোগ্য নভেল করোনাভাইরাস টেস্টিং কিট বানানো শুরু করে, তার মধ্যে অন্যতম জার্মানি। বার্লিনভিত্তিক একটি কোম্পানি ফেব্রুয়ারিতেই দশমিক মিলিয়ন টেস্টিং কিট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠায়। যেহেতু জার্মানি এই মহামারীর শুরু থেকেই টেস্ট করা শুরু করেছে ব্যাপক হারে, সেহেতু উপসর্গ ছাড়া অথবা খুব সামান্য উপসর্গের আক্রান্তদেরও তারা চিহ্নিত করতে পেরেছে। যেখানে ইউরোপের বাকি দেশগুলো বিশেষ করে ইতালি, স্পেন যুক্তরাজ্য শুরু থেকে ব্যাপক হারে টেস্ট না করায় একটা সময়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার কারণে এবং সীমাবদ্ধতার কারণে শুধু প্রকট উপসর্গসম্পন্ন মানুষদের পরীক্ষা করে আসছে। ফলে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা প্রকাশিত বা নির্ণীত সংখ্যা থেকে অনেক ভিন্ন। কারণেই ইতালি, স্পেন বা যুক্তরাজ্যের মোট আক্রান্তের প্রকাশিত সংখ্যা থেকে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি বলেই ধরে নেয়া যায়।

শুরু থেকেই আমরা জানি যে নভেল করোনাভাইরাসের অনেক নীরব বাহক রয়েছে, যাদের মাঝে কোনো রকম উপসর্গ দেখা যায় না, ফলে বিভিন্ন দেশের টেস্টিং সীমাবদ্ধতা বা নীতির কারণে আক্রান্তদের অনেকেই বাদ পড়েন টেস্ট থেকে। সুতরাং একেক দেশের ক্ষেত্রে টেস্টের সংখ্যার কারণেই প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যার তারতম্যের কারণে ভিন্ন ভিন্ন মৃত্যুহার আমরা দেখতে পাচ্ছি। আরেকটা বিষয় এখানে লক্ষণীয়, মোট মৃতের সংখ্যা প্রকাশের ক্ষেত্রেও দেশভেদে ভিন্নতা আছে, এমনকি একই দেশে বিভিন্ন রকম পরিসংখ্যান প্রকাশিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ যুক্তরাজ্যে ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ অ্যান্ড স্যোসাল কেয়ার প্রতিদিনের আপডেটে কতজন মানুষ করোনা টেস্টে পজিটিভ হয়েছে এবং টেস্টে পজিটিভদের মধ্যে কতজন মৃত্যুবরণ করেছে তা প্রকাশ করে। যুক্তরাজ্যের জাতীয় পরিসংখ্যান অফিস প্রতিদিন মৃতদের ডেথ সার্টিফিকেটে কভিড-১৯ লেখা থাকলেই তাদের সংখ্যা প্রকাশ করে, যাদের মধ্যে টেস্টে পজিটিভও আছে আবার সন্দেহজনকও আছে, যাদের টেস্টই করা হয়নি। তাছাড়া কোনো ব্যক্তি যদি আগে থেকেই শ্বাসকষ্ট বা মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত কোনো রোগে ভুগতে থাকেন যা করোনার আক্রমণের কারণে অল্পতেই মৃত্যু ডেকে আনতে পারে, তার ক্ষেত্রে করোনায় মৃত্যু নাকি অন্য রোগে মৃত্যু ধরা হবে, সেটাও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। সুতরাং প্রকৃত মৃত্যুহার এখনই বলা যাবে না এবং তুলনামূলক আলোচনা হয়তোবা সঠিক পরিসংখ্যান না- দিতে পারে। জার্মানির ক্ষেত্রে আরো কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে তাদের দেশেই সবচেয়ে বেশি আইসিইউ আছে। সব ধরনের মানুষের টেস্ট করলেও প্রকৃতভাবে গুরুতর অসুস্থের সংখ্যা এখনো কম হওয়ায় ৭০-৮০ শতাংশ আইসিইউ এখন পর্যন্ত ব্যবহার হয়েছে। প্রতিদিনের আক্রান্তের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, এটা ধরেই নেয়া যায় যে অচিরেই তাদেরও হাসপাতালগুলোয় রোগীর জায়গা হবে না। সুতরাং সার্বিক বিবেচনায় ধরেই নেয়া যায় যে প্রকৃত মৃত্যুহার এখনই গণনা করে সঠিক মৃত্যুহার বের করা মুশকিল। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, যদিও এক মিলিয়নের ওপর আক্রান্তের পরিসংখ্যান আমরা এখনই দেখছি, তবুও প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা হয়তো আরো দশ গুণ বেশি।

 

. মো. মিজানুর রহমান: সহকারী অধ্যাপক, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন