দাম রেকর্ড সর্বনিম্ন

মাঠেই লবণ ফেলে যাচ্ছেন কক্সবাজারের কৃষক

নিজস্ব প্রতিবেদক চট্টগ্রাম ব্যুরো

কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার নতুন বাজার এলাকার লবণচাষী মো. আবু বকর। নয় বছর ধরে লবণ চাষের সঙ্গে যুক্ত তিনি। কিন্তু গত তিন বছরে অস্বাভাবিক লোকসানে পড়ে প্রায় সব পুঁজিই হারিয়েছেন। দেনা পরিশোধ জীবিকার তাগিদে এবারো ২৫০ কানি জমিতে লবণ চাষ করেছেন। ব্যয় হয়েছে কানিপ্রতি ৩০-৩৫ হাজার টাকা করে। লবণ উৎপাদনও হয়েছে অনেক। কিন্তু দাম অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় বিক্রি করতে পারছেন না। কানিপ্রতি লবণের দাম পাচ্ছেন গড়ে ১০-১২ হাজার টাকা করে। অর্থাৎ এবারো তার বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ মাঠে পড়ে আছে। ক্রেতা না থাকায় এসব লবণ সংরক্ষণের জন্য প্লাস্টিক কিনতে হবে তাকে। এক্ষেত্রেও ব্যয় বাড়বে কানিপ্রতি হাজার টাকা করে। এছাড়া শ্রমিকের মজুরিসহ অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের জন্য নতুন করে বিনিয়োগও করতে হবে। অবস্থায় উৎপাদিত লবণ মাঠেই ফেলে ব্যবসা থেকে সরে যাওয়া ছাড়া গতি নেই তার।

একই অবস্থা মহেশখালীর মো. আবদুল কাদের, এহসান, আবুল হোসেন, জসিমসহ কয়েকশ লবণচাষীর। কক্সবাজারের মহেশখালী চকরিয়ার (বদরখালী) একাধিক লবণচাষী জানিয়েছেন, ক্ষুদ্র পরিসরে যারা লবণ চাষ করেছেন, তাদের অনেকেই উৎপাদিত লবণ বিক্রি করতে পারেননি। পাওনাদারের টাকা ফেরত দিতে না পেরে তাদের কেউ কেউ মাঠে লবণ রেখেই চলে গেছেন। শাহ্ আলম, কবির নামের স্থানীয় দুই কৃষক মাঠে লবণ রেখে সরে পড়েছেন এক সপ্তাহ আগে। অবস্থা চলতে থাকলে আরো অনেক কৃষককে একই পথ ধরতে হবে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের। 

দেশে মাঠ পর্যায়ে লবণের দাম দীর্ঘদিন ধরেই নিম্নমুখী। কভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর কারখানা বন্ধ পরিবহন সংকটে লবণের দাম নেমে এসেছে রেকর্ড সর্বনিম্নে। বিক্রি না হওয়ার পাশাপাশি লোকসানে পড়ে দায়-দেনা এড়াতে মাঠে লবণ ফেলে যাচ্ছেন কৃষকরা। সংকট থেকে উত্তরণে অনেকে মজুদ করে অপেক্ষার পরামর্শ দিলেও কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলার হাজার হাজার কৃষক এখন চরম সংকটে দিন পার করছেন।   

কয়েক বছর ধরেই উৎপাদন খরচের চেয়েও কম দামে লবণ বিক্রি করে লোকসানে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন লবণচাষীরা। অন্যদিকে চলমান নভেল করোনাভাইরাস সংকটের কারণে ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না লবণের। ফলে অনেক কৃষক মাঠে লবণ রেখেই সরে যাচ্ছেন। চলমান তাপদাহের পর যেকোনো সময় বৃষ্টিপাত হলে মাঠের লবণ নষ্ট হয়ে যাবে। এজন্য কৃষকদের হয় এখনই এসব লবণ বিক্রি করে দিতে হবে, নয়তো মাঠেই গর্ত করে প্লাস্টিক আবরণ দিয়ে মজুদ করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো এর জন্যও আরো বিনিয়োগ প্রয়োজন, যে ধাক্কা এখন আর নিতে পারছেন না কৃষকরা। 

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), লবণচাষী ব্যবসায়ী সূত্রে জানা গেছে, দেশে নিবন্ধিত লবণচাষীর সংখ্যা ৩০ হাজার ৬০০। বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ১৪০ টাকা দামে লবণ বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। যদিও বিসিকের হিসাবে গড় দাম হচ্ছে ১৫৩ টাকা। অথচ প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয় প্রায় ২০০ টাকা। সর্বশেষ তিন বছর আগে লাভে লবণ বিক্রি করেছিলেন চাষীরা। সে সময় পণ্যটির দামও উঠেছিল সর্বোচ্চে। কিন্তু এরপর থেকে প্রতিবারই লোকসানে লবণ বিক্রি করছেন তারা। 

বর্তমানেও কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব রোধে সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে যানবাহন চলাচল সীমিত হয়ে পড়া ভাড়া বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন কারখানায় লবণের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। ফলে এবার লবণের দাম নেমে এসেছে অস্বাভাবিক কমে। চাহিদা কমে যাওয়ায় ব্যাপারীরা লবণ ক্রয় করলেও কৃষকদের নগদ টাকা দিতে পারছেন না। কারণেও অনেকে বড় ধরনের লোকসান দিয়েও লবণ বিক্রি করতে পারছেন না। 

বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিক কক্সবাজারের উপমহাব্যবস্থাপক মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, চলমান নভেল করোনাভাইরাসের সংকটে চাষীরা লবণের ভালো দাম পাচ্ছেন না। সারা দেশের শিল্প-কারখানা পুরোদমে চালু হলে লবণের দাম আবারো সহনীয় পর্যায়ে উঠে যাবে। উৎপাদন খরচ তুলে আনা লাভের জন্য দাম বেড়ে যাওয়া পর্যন্ত কৃষকদের অপেক্ষা করতে হবে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে আমরা এরই মধ্যে স্বল্প সুদে কৃষিঋণ এনজিও থেকে ঋণ সুবিধা নিয়ে দিতে তত্পরতা চালাচ্ছি। শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ট্যারিফ কমিশনে লবণের দাম স্ট্যান্ডার্ড পর্যায়ে নির্ধারণের সুপারিশও করা হয়েছে। আশা করছি, চলমান বাণিজ্যিক সংকট কেটে গেলে লবণচাষীরাও লাভের মুখ দেখবেন। 

বিসিক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর দেশে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ লাখ ৫০ হাজার টন। ৫৭ হাজার একর জমি থেকে এরই মধ্যে (২৮ মার্চ পর্যন্ত) লাখ ৮৩ হাজার টন লবণ উত্তোলন হয়েছে। ২০১৯ সালে ৬০ হাজার একর জমিতে ১৮ লাখ টন লবণ

উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু সে সময় উৎপাদন হয়েছিল ১৮ লাখ ২৪ হাজার টন। 

বিষয়ে চট্টগ্রামের চাক্তাই এলাকার মেসার্স লাল মিয়া সল্টের স্বত্বাধিকারী মো. আসাদুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে শিল্প লবণ আমদানির নামে সোডিয়াম সালফেটের অবাধ ব্যবহারের কারণে স্থানীয় উৎপাদনকারী চাষী প্রকৃত মিলমালিকরা লোকসানের মধ্যে রয়েছেন। দেশী লবণ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে না পারলে আমদানিনির্ভরতা বাড়বে, যা নিত্যপণ্যটির বাজারকে মারাত্মক অস্থিতিশীলতার মুখে ঠেলে দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন