পর্যাপ্ত আমদানি সত্ত্বেও অস্থিতিশীল গমের বাজার

সুজিত সাহা চট্টগ্রাম ব্যুরো

 দেশে গমের আমদানি হয়েছে পর্যাপ্ত। মজুদও যথেষ্ট। খাদ্য শিল্প রেস্তোরাঁগুলোয় চাহিদাও তেমন একটা নেই। যেটুকু রয়েছে, প্রান্তিক পর্যায়ে। অভিযোগ রয়েছে, প্রান্তিক পর্যায়ের চাহিদা বৃদ্ধির সুযোগ নিয়েই কৃষিপণ্যটির দাম বাড়িয়ে তুলছেন মজুদদার আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশে গম আমদানি হয়েছে ৫০ লাখ টন। স্থানীয় উৎপাদন সরবরাহ ছাড়াও স্থলবন্দর দিয়েও ভারত থেকে গম আমদানি অব্যাহত ছিল। ছিল আগের মজুদও। সময় দেশে গম আমদানি বেড়েছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ। এর পরেও সংকটের অজুহাত তুলে গত এক সপ্তাহে নিয়মিতভাবেই পণ্যটির দাম বাড়িয়েছেন আমদানিকারকরা।

দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সপ্তাহ ধরেই খাতুনগঞ্জে ডিও পদ্ধতিতে কেনাবেচা হওয়া গমের দাম বাড়তির দিকে। আমদানি বেশি হওয়ায় দেশে মুহূর্তে গমের কোনো সংকট নেই। তার পরেও মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ৭০-৮০ টাকা করে দাম বেড়েছে আটা-ময়দা তৈরির মূল উপাদানটির। ফলে ফ্লাওয়ার মিলগুলোও এখন আটা-ময়দার দাম বাড়িয়েছে। অন্যদিকে প্রান্তিক সাধারণ মানুষের মধ্যে আটার চাহিদা বাড়তির দিকে থাকায় দেশে গমের বাজার আরো অস্থির হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ব্যবসায়ীদের দাবি, খাতুনগঞ্জে বর্তমানে খুচরায় প্রতি কেজি প্যাকেট আটা বিক্রি হচ্ছে ৩২-৩৫ টাকায়, প্যাকেট ময়দা কোম্পানিভেদে ৪২ থেকে ৪৮ টাকায়। এছাড়া খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে ২৬ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে এবং ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৩২ থেকে ৩৮ টাকা দরে। খোলা আটা-ময়দার দাম কেজিপ্রতি থেকে টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছে মিলগুলো।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দেশের সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষ আপত্কালীন আটার ওপর নির্ভরশীল থাকে। দেশে শতাধিক ব্র্যান্ডের প্যাকেটেড আটা-ময়দা বিক্রি হলেও খোলা আটা-ময়দাই ভরসা গরিব শ্রমজীবী মানুষের। বর্তমান সংকটকালে আটা-ময়দার দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে চরম বিপদে রয়েছে নিম্নবিত্তের মানুষ।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রথম আট মাসে দেশে গম আমদানি হয়েছে ৫০ লাখ টন। গমের আমদানি মূল্য ১০ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি টন ( হাজার কেজি) গম আমদানিতে ব্যবসায়ীদের ব্যয় করতে হয়েছে গড়ে ২০ হাজার ৩১৪ টাকা করে। অন্যদিকে গত অর্থবছরের (২০১৮-১৯) প্রথম আট মাসে দেশে গম আমদানি হয়েছিল ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টন, যার আমদানি মূল্য ছিল হাজার ২৭৮ কোটি টাকা এবং টনপ্রতি আমদানি মূল্য ছিল গড়ে ২২ হাজার ৭৫ টাকা করে। অর্থাৎ আমদানি বাড়ার পাশাপাশি চলতি অর্থবছরে ব্যবসায়ীদের পণ্যটির টনপ্রতি মূল্য কম পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় হাজার টাকা করে। এর পরেও শূন্য শুল্কের পণ্যটির দাম হঠাৎ বাড়িয়ে বাজার থেকে বাড়তি মুনাফা তুলে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

খাতুনগঞ্জের আমদানিকারক ব্রোকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি বাজারে আটা-ময়দার বিক্রি এখন বেশি। প্যাকেটজাত পণ্যের পাশাপাশি খোলা আটারও চাহিদা বেশি। হঠাৎ করেই অতিরিক্ত চাহিদার কারণে সরবরাহ চেইনে ঘাটতি দেখা দেয়। এতে দাম বাড়লেও সংকট কাটেনি বাজারে।

অন্যদিকে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে সরবরাহ সংকটের কথাই বলছেন আমদানিকারকরা। খাতুনগঞ্জে গমের ব্রোকার ব্যবসায়ী মো. এমরাজ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের বিভিন্ন ফ্লাওয়ার মিলে ডিও পদ্ধতিতে পণ্য সরবরাহ করছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু গত কয়েক দিনে খাতুনগঞ্জে গমের সংকট দেখা দিয়েছে। এতে গমের দাম কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। ফ্লাওয়ার মিলগুলো থেকেই বাড়তি চাহিদা রয়েছে। ক্রেতাদের বাড়তি দামে কিনতে আপত্তি না থাকলে বর্ধিত দামই স্থিতিশীল হয়ে যায়। এতে ব্যবসায়ীদের কিছুই করার নেই।

তবে চট্টগ্রামের বিভিন্ন গুদামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে পণ্যটির মজুদ পর্যাপ্ত। এছাড়া আমদানি প্রক্রিয়ায় থাকা প্রচুর গম এরই মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে। খাতুনগঞ্জে বর্তমানে প্রতি মণ কানাডীয় গম বিক্রি হচ্ছে হাজার ১০০ টাকা দরে। এছাড়া রাশিয়া থেকে আমদানি করা গম মানভেদে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৯০০ টাকায়। উভয় দেশ থেকে আমদানি করা গমের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে মণে ৭০-৮০ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, কভিড-১৯ প্রতিরোধে বিচ্ছিন্নতার কর্মসূচি জোরালো হওয়ার পাশাপাশি প্রান্তিক পর্যায়ে আটার চাহিদা বাড়ায় পণ্যটির দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা করছেন আমদানিকারকরা।

এদিকে বিশ্ববাজারেও গমের দাম নিম্নমুখী রয়েছে। কয়েক মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কম থাকায় গত অর্থবছরের চেয়েও টনপ্রতি প্রায় হাজার টাকা কম দামে গম আমদানি করছেন ব্যবসায়ীরা। ইনডেক্স মুন্ডির তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের অক্টোবরে বিশ্ববাজারে গমের টনপ্রতি দাম ছিল ১৯৯ ডলার ৫২ সেন্ট। এরপর নভেম্বরে কিছুটা বেড়ে হয়েছিল ২০৩ ডলার ১৯ সেন্ট, ডিসেম্বরে ২১০ ডলার ৯১ সেন্ট। এরপর দাম আরো বেড়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে পণ্যটি বিক্রি হয় টনপ্রতি ২২৪ ডলার ৫০ সেন্টে। ফেব্রুয়ারিতে দাম কমে তা নেমে আসে ২১৫ ডলার ৩২ সেন্টে। বিশ্ববাজারে এক মাসের ব্যবধানে শতাংশের বেশি দাম কমলেও দেশের বাজারে আমদানিকারকরা শূন্য শুল্কের নিত্যপণ্যটির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।

বিষয়ে জানতে চাইলে সেনা কল্যাণ সংস্থার ডায়মন্ড ব্র্যান্ডের ফ্লাওয়ার ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে গমের আমদানি পর্যাপ্ত। কয়েক মাস ধরেই গমের দাম সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বিচ্ছিন্নতার নীতি কার্যকরের পর পরই গমের দাম হঠাৎ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য উৎপাদিত গম, বিশেষত রাশিয়া থেকে আমদানি করা গমের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। এতে চাহিদা তুলনামূলক কম হলেও পণ্যের (আটা-ময়দার) দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই।

চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে গম আমদানি হয়েছিল ৩৬ লাখ ১৪ হাজার ৪২২ টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৫১ লাখ ৯১ হাজার ১১৮ টন এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৫০ লাখ ২০ হাজার ৩৪৮ টন। অর্থাৎ দেশে নিয়মিত গড়ে ৫০ লাখ টনের মতো আমদানীকৃত গমের চাহিদা থাকলেও চলতি অর্থবছরের শুধু ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫০ লাখ টন গম আমদানি করেছে ব্যবসায়ী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। চাহিদার তুলনায় বাড়তি মজুদ সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা সাম্প্রতিক করোনাভাইরাসের কারণে বাজারে গমের দাম বাড়িয়ে অস্থিতিশীলতা তৈরি করছেন বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্ট ফ্লাওয়ার মিল মালিকরা।  

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন