বাংলায় কলেরাক্রান্তি

যে মাসে ছিল পাঁচ শনিবার

মুহিত হাসান

ডেটলাইন যশোর: যে মাসে ছিল পাঁচ শনিবার ও একটি কাটা মুণ্ডু

কলেরা, আপাতদৃষ্টিতে মাত্র তিন শব্দে তৈরি একটি রোগের নাম; কিন্তু তা উনিশ শতকের গোড়ায় সারা বিশ্বকে হাড়হিম ভয়ে রীতিমতো কাঁপিয়ে দিয়েছিল। অনেকে তখন মনে করতেন, তত্কালীন পূর্ববঙ্গের যশোর জেলা থেকেই প্রথম মহামারী আকারে ছড়িয়েছিল রোগটি। এ নিয়ে এক কৌতূহলোদ্দীপক অথচ অদ্ভুত বিবরণ পাই যশোর জেলার তদনীন্তন সিভিল সার্জন ডা. টেইলরের বিবরণীতে। ১৮১৭ সালের আগস্ট মাস। যশোর জেলাজুড়ে কলেরা রোগী বাড়তে বাড়তে ব্যাপক আকার নিয়েছে। যশোর শহর প্রায় জনশূন্য। ডা. টেইলর সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তি খেয়াল করছিলেন মাসের গোড়া থেকেই। বিরূপ পরিস্থিতিতে এমন উদ্বেগ স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু মানুষের মধ্যে অনেক গুজবও তখন ছড়িয়ে পড়ছিল। পরে টেইলর খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলেন, খেয়াল করে দেখা গেছে, এ মাসে মোটমাট পাঁচটি শনিবার রয়েছে। এ কারণে মানুষজনের মধ্যে ধারণা জন্মেছে, এক মাসেই যেহেতু পাঁচ শনিবার, সেহেতু সামনে নির্ঘাত আরো খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে। তারই সংকেত হিসেবে কলেরা উপস্থিত হয়েছে। এ ব্যাপারে সাধু ও জ্যোতিষীরাও তাদের সতর্ক করেছেন। তাদের ব্যাখ্যা এই—একে তো এতগুলো শনিবার ‘শনির দশা’ বা খারাপ কোনো কিছুর জানান দিচ্ছে, আর পাঁচ সংখ্যাটি শিবদেবতার অভিশাপ বা ধ্বংসত্মক কর্মকাণ্ডের প্রতীক হিসেবে উপস্থিত হয়। এ দুই একসঙ্গে যখন মিলেছে, তখনই কলেরার এ ভয়ানক পরিস্থিতি হাজির হয়েছে। টেইলর এমন রটনায় প্রথমে কান দেননি। মাস নিজের গতিতে শেষের দিকে গড়াতে থাকল। কিন্তু ২৯ তারিখ রাতে (মাসের শেষ শনিবারের আগের দিন, শুক্রবার) হঠাত্ই যশোর স্টেশনসংলগ্ন গ্রামগুলোয় এক অদ্ভুত গুজবকে ঘিরে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। গুজবটি এমন—একদল কালো জাদুকর যশোরে মুরুলি এলাকা থেকে একটি মানবদেহের কাটা মুণ্ডুসমেত পালিয়েছে। এলাকার সাধু-সন্ন্যাসীদের মতে, এ কালো জাদুকরের দল কাটা মুণ্ডু হাতে সারা ভারত প্রদক্ষিণ করতে চায়। তারা যত দূর যাবে, তত দূরই শিবের অভিশাপ বা কলেরা ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু যদি তাদের আটকে ফেলে কাটা মুণ্ডুটি মাটিতে ফেলে দিতে বাধ্য করা যায়, তাহলে যে স্থানে কাটা মুণ্ডুটি পড়বে, সেখানেই কলেরা ‘অক্কা পাবে’। এমন খবরে এলাকার লোকজন মরিয়া হয়ে কালো জাদুকরের দলকে ধরতে মধ্যরাতেই গ্রামে গ্রামে তল্লাশি শুরু করে দেয়। কিন্তু বিধি বাম, সেই কথিত কালো জাদুকরের দলটিকে আর পাকড়াও করা গেল না। পরে পুরো যশোর জেলায়ই কলেরা মহামারীর রূপ নিয়ে নিল। বাংলায় তো বটেই, কলেরা ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে ভারতের নানা অঞ্চলে। তখন যশোর জেলার মধ্যে দুই মাসে প্রায় ১০ হাজার কলেরা রোগীর মৃত্যু হয়েছিল, এমন তথ্য সরকারি নথিপত্রেই লেখা রয়েছে।

তবে যশোর জেলায় কলেরার সূত্রপাত আর সেখান থেকেই থেকে পুরো বিশ্বে মহামারীরূপে এর ছড়িয়ে পড়া—এমন মন্তব্যের সঙ্গে পরে কেউ কেউ দ্বিমত করেছেন। ১৮৭২ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত এনালস অব কলেরা বইতে ডা. জন ম্যাকফারসন লিখেছিলেন, যশোরে কলেরা আসার আগেই ১৮১৭ সালের মার্চে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ এলাকায় ব্যাপক আকারে প্রাণঘাতী রোগটি ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন তা নিয়ে কেউ বিশেষ উচ্চবাচ্য করেনি। তারপর ওই বছরের মে-জুনে কৃষ্ণনগর ও ময়মনসিংহ এলাকায়ও কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ঢাকা জেলায়ও জুলাইয়ে কলেরার দেখা মিলেছে। যশোরে কলেরা আগস্টের আগে দেখাও যায়নি। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের ধারণা, নদীয়া জেলার ‘উলা’ এলাকায় প্রথম কলেরা রোগটি ধরা পড়ে। এ কারণেই কলেরার বঙ্গীয় নামকরণ হয় ‘ওলাওঠা’ বা ‘উলাউঠা’। তবে নগেন্দ্রনাথ বসু মনে করেন, কলেরার বাংলা নামটি উলা নামের এলাকার অনুষঙ্গে আসেনি। ‘বিশ্বকোষ’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘ইহাতে পেট নামায় ও বমন উঠে বলিয়া ইহার নাম ওলাউঠা হইয়াছে।’ যা হোক, ম্যাকফারসনের যুক্তি মেনে নিয়েও অবশ্য খেয়াল করলে দেখা যায়, পূর্বোক্ত এলাকাগুলোয় কলেরা চরম মহামারীর রূপ নেয়নি। কলেরার প্রাণঘাতী রূপ কতটা ব্যাপক হতে পারে, সেটি প্রথমবারের মতো লক্ষ করা গিয়েছিল মূলত যশোরেই। 

কলেরায় জনতার হাহাহার ও মৃত্যু

কলেরা তখনকার ইংরেজ কোম্পানি শাসিত বাংলায় এক আতঙ্কের নামে পরিণত হয়েছিল। বিশেষ করে যশোরে মহামারী আকারে দেখা দেয়ার পর ১৮১৭-পরবর্তী বছরগুলোয় কলেরার প্রকোপ না কমে উল্টো আরো বাড়তেই থাকে। নানা উত্সব ও তীর্থযাত্রায় হওয়া বিপুল জনসমাগমের কারণে সে যুগে বাংলায় জলবাহিত রোগ কলেরা বা ওলাওঠার প্রকোপ বেড়েছিল। সেকালের নানা সংবাদপত্রের খবরাখবর এবং সে সময়ের একাধিক স্মৃতিকথায়ও এর প্রমাণ মেলে । ‘সমাচার দর্পণ’-এর ১৮১৯-এর ৬ নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত একটি খবর প্রমাণ হিসেবে উদ্ধৃত করা যাক: ‘গত শনিবার কলিকাতায় মুসলমানদের মহরমে বার জন যুবা ও তিন জন ছোকরা বাদ্যকর কাজ করিতে আসিয়াছিল, পরে তাহাদের সকলের ওলাউঠা এককালে হওয়াতে একজন মরিলে তত্ক্ষণাত্ এক সাহেবের নিকটে সে সমাচার গেল। ঐ সাহেব আসিয়া ঔষধি দ্বারা বাকী চৌদ্দজনকে সুস্থ করিয়াছে।’ আবার একই পত্রিকায় ১৮২৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ছাপা হওয়া একটি খবর থেকে জানা যাচ্ছে, একদিনেই কলকাতা শহরে ৫৭১ জন কলেরা রোগীর মৃত্যু ঘটেছে, বিশেষত বিগত মহররম উপলক্ষে শহরের অনেক সাধারণ মুসলমান গাদাগাদি দশায় তিন-চারদিন একসঙ্গে আনুষ্ঠানিকতা পালন করেছিলেন। এতে তাদের মধ্যে অনেকেই কলেরায় আক্রান্ত হয়েছেন। ১৮২৪-এর ১৭ এপ্রিলের ‘সমাচার দর্পণ’ জানাচ্ছে, কলেরা-ওলাওঠা প্রাণঘাতী হয়ে মেদিনীপুরের ‘দক্ষিণ অঞ্চলের অনেক লোককে সংহার করিতেছে। আরো জানা গেল...মহামহাবারুণীযোগে [মতুয়া সম্প্রদায়ের একটি বিশেষ উত্সব] গঙ্গাস্নান করিয়া ফিরিয়া যাইতেছিল তাহাদের এত লোক মারা পড়িয়াছে যে মড়ার গন্ধেতে পথে চলা অতিকঠিন হইয়াছে।...’ ঢাকায় ফাল্গুন-চৈত্রে কলেরা ব্যাপক আকারে আঘাত হানত, কারো কারো ধারণা ফাল্গুন-চৈত্রে ব্রহ্মপুত্র নদে হিন্দু সম্প্রদায়ের পুণ্যস্নানের কারণেই এমনটি ঘটত। কারণ কলেরা হানা দিত এর ঠিক পর পরই। ১৮৮৬ সালে তখনকার শ্রীহট্ট জেলার হবিগঞ্জে এক বিরাট জনসমাগমের মেলা থেকে গ্রামে গ্রামে কলেরা ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৮৯১ সালে কলকাতার কালীঘাটে গঙ্গাতীরে এক পার্বণে দেড় লাখেরও বেশি মানুষ স্নান করতে এসেছিল। স্নানার্থীদের মলমূত্র নদীতে ছড়াচ্ছিল। এছাড়া ওই সময় গঙ্গায় কলেরায় মৃত এক রোগীর শবদেহও ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল। এতেই কাল হলো। যেসব ব্যক্তি ওই সময় ভক্তিবশত গঙ্গার জল পান করেছিলেন, তাদের মধ্যে ৬২৮ জন মারা যায়। ওই সময় থেকে আরম্ভ করে পরের তিন মাসে কলকাতা শহরে মোটমাট মারা গিয়েছিলে ১ হাজার ৩৬৩ জন।

‘যাহারা কদর্য্য গলির মধ্যে বাস করে তাহারদের মধ্যেও অধিক লোক মরিতেছে যেহেতুক কদর্য্য স্থানের দুর্গন্ধেতে ও মন্দ বায়ুতে এ রোগ জন্মে।...যাহারা বড় রাস্তার ধারে উচ্চস্থানে বাস করে তাহারদের মধ্যে এত লোক মরে নাই...।’ ‘সমাচার দর্পণ’ তখন কলেরা নিয়ে এমন মন্তব্যও করেছিল (৩ সেপ্টেম্বর, ১৮২৫)। কলেরার মহামারীতে রোগে ভুগে প্রাণহানির বেলায় তখন শ্রেণী বিভাজন বেশ সক্রিয় ছিল, এমনটা অবশ্য সত্যি নয়। ১৮২০ সালের ২৯ এপ্রিলের ‘সমাচার দর্পণ’-এর খবর অনুযায়ী, ‘ওলাউঠা রোগে কলিকাতার এই ২ ভাগ্যবান লোক মরিয়াছেন। বাবু সূর্য্যকুমার ঠাকুর ও বাবু মোহিনীমোহন ঠাকুর ও কোম্পানির ত্রেজুরি [ট্রেজারির] খাজাঞ্চি জগন্নাথ বসু ও কলিকাতার এক্সচেঞ্জ ঘরের কর্মচারী শিবচন্দ্র বসু ও ইংলণ্ডীয় সাত জন সাহেব মরিয়াছেন।’ তবে অর্থের জোরে কেউ কেউ কলেরা আক্রান্ত এলাকা থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতেন বলে জানা যায়। ঢাকায় কলেরার উপদ্রব দেখা দিলে অনেকেই নৌকায় করে শহর ছাড়ার চেষ্টা করতেন দেখে ২-৩ টাকার নৌকা ভাড়া ৩০-৪০ টাকা হয়ে দাঁড়াত। ফলে শহর ছেড়ে পালাতে পারত একমাত্র ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই। আবার স্থানীয় জলাশয় বা কলের পানিতে কলেরার জীবাণু থাকতে পারে এমন ভয়ে ঢাকার অনেক অবস্থাপন্ন ব্যক্তি উনিশ শতকে প্রচুর টাকা খরচ করে মেঘনা নদীর পানি আনিয়ে তা পান করত বলেও জানা যায়।

১৮২৫-এর ১৭ সেপ্টেম্বরের ‘সমাচার দর্পণ’-এ আবার মিলছে ঢাকায় কলেরার ভয়াবহ আকারে বিস্তারলাভের বিবরণ: ‘ঢাকার পত্রদ্বারা ওলাউঠা রোগের বিষয় যেরূপ শুনা গেল তাহাতে প্রায় বিশ্বাস হয় না বিশেষত গত মাসের শেষ সপ্তাহে আটশত লোক পঞ্চত্ব পাইয়াছে এবং বর্তমান মাসের প্রথম সপ্তাহে সাতশত লোক মারা পড়িয়াছে।...’ খবরটি থেকে আরো জানা যায়, কলেরার এ মারণ ছোবলের কারণে মানুষের মনে ভয় যেমন দেখা দিয়েছে, তেমনি অভাব দেখা দিয়েছে সত্কারের স্থানের। অনেক মরদেহ দাহ বা দাফন করা যাচ্ছে না। এছাড়া ‘আদালত ও অন্য কার্য্যকর্ম সকল বন্ধ হইয়াছে এবং লোকেরা পলায়ন করিতেছে।...’ ঢাকার অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি। ১৮৮১-৮২ সালে শহর ঢাকায় কলেরা-ওলাওঠা ভয়াবহতম প্রকোপ দেখা দেয়। ওই সময় কলেরায় মৃত্যুর শঙ্কায় থাকা নগরবাসীর আতঙ্ক-উত্কণ্ঠার মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন দীনেশচন্দ্র সেন, তার আত্মজীবনী ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য-এর ‘ঢাকার ওলাওঠা’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে: ঢাকায় তখন যেরূপ ওলাওঠার প্রকোপ হইয়াছিল, সেইরূপ উত্কট অবস্থা বড় দেখা যায় না।...কলেরা তাঁতিবাজার হইতে শুরু করিয়া ধীরে ধীরে বাবুবাজার মুখে রওয়ানা হইল।...ভীতসন্ত্রস্ত বহু শহরবাসী নদীর ঘাটে হাজির হইয়াছে ও প্রাণ লইয়া পলাইতেছে, নৌকা আর পাওয়া যায় না।...রাস্তা দিয়া আসিতে পথে পথে কেবল ‘হরি বোল’ কান্নার রোল, অনাথ ছেলেমেয়েদের চিত্কার, দোকানপাট বন্ধ।...’ ১৮৫০ সালে কুমিল্লা জেলায় কলেরার প্রকোপ এতটাই ছিল যে সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয় পত্রিকায় ১৮৫০ সালের ৩ মে প্রকাশিত খবরে মন্তব্য করা হয়েছিল: ‘কেহ দেহত্যাগ কেহ গৃহত্যাগ করাতে প্রায় এ প্রদেশ নিম্মর্নুষ্য হইল।’ ওই খবরটি থেকে আরো জানা যায়, কলেরায় মৃত হিন্দু সম্প্রদায়ের রোগীদের ১০-১২টি মরদেহ প্রায় প্রতিদিনই গোমতী নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে আর মুসলমান রোগীদের কবর দেয়ার জায়গার অভাব দেখা দিয়েছে। রোগ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কায় জেলার সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট কবর দিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। এরই কাছাকাছি সময়ে ১৮৫২ সালে চট্টগ্রামেও কলেরার মহামারী দেখা দেয়। ওই সময় চট্টগ্রাম জেলায় প্রায় প্রতিদিন শতাধিক রোগীর কলেরায় মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এমনই খারাপ অবস্থা হয়েছিল যে কবর দেয়া বা দাহ করার উপায়ও মিলছিল না। অগত্যা নিরুপায় সরকারি ডোমেরা বেশির ভাগ মরদেহ, বিশেষত স্বজনহীন ও বেওয়ারিশ পরিচয়বিহীন মরদেহগুলো নদীতে ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছিলেন। চট্টগ্রাম শহরের কারাগারেও কলেরা হানা দিয়েছিল। ফলে শহরের পুলিশপ্রধান বেশির ভাগ বন্দিকেই মুক্ত করে দিয়েছিলেন। কারণ কারাগারে কলেরায় মারা যাওয়া বন্দিদের সত্কারের জন্য তখন কাউকে হাজার চেষ্টা করেও খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছিল না (৪ এপ্রিল ১৮৫২, সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়)। ১৮৭৮-৭৯ সালে পাবনা জেলায় কলেরার প্রাদুর্ভাবের কথা নিজের আত্মকথা ‘জীবন-চরিত’-এ লিখেছেন ওই সময়কার পুলিশ কর্মকর্তা আজিমদ্দিন মহাম্মদ চৌধুরী। কলেরায় ভুগে তার নিজের পাবনাবাসী পিতা আর তিন ভাতিজি-ভাতিজার মৃত্যু ঘটেছিল প্রায় একই সঙ্গে।

কলেরা ও গুজব-অন্ধবিশ্বাসের ছড়াছড়ি

মহামারীর প্রকোপ ১৮১৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরের কিছুদিন পর যশোর এলাকায় থামলেও রোগটিকে ঘিরে সেখানকার মানুষের অন্ধবিশ্বাস বা ভুল ধারণার ইতি ঘটেনি। সিভিল সার্জন টেইলর তখন গ্রাম এলাকায় ঘুরতে গিয়ে দেখেছিলেন, একটি নয় বছরের বালিকাকে নেশাদ্রব্য খাইয়ে অজ্ঞান করে শীতলা দেবীরূপে কলেরা থেকে মুক্তির আশায় হিন্দু সম্প্রদায়ের তরফ থেকে অনেকটা লুকিয়ে পূজা দেয়া হচ্ছে। পরে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ওলাবিবির কাছে কলেরা বা ওলাওঠা থেকে আরোগ্যের আশায় প্রার্থনা করতে শুরু করে।

কলেরা বা ওলাওঠা ঠেকাতে যশোরে আরেক সর্বনাশা টোটকা প্রয়োগের উল্লেখ লভ্য ১৮১৮ সালের ২১ নভেম্বর ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরে। হরিতাল নামে পরিচিত এক প্রকার বিষাক্ত খনিজ পদার্থের চূর্ণ খেয়ে মানুষ কলেরা থেকে মুক্তি পাচ্ছে এমন দাবি করা হয়েছিল সেই সংবাদে: ‘যশোহরে যে যে লোকের ওলাউঠা রোগ হইয়াছিল, তাহারা হরিতাল ভস্ম ঔষধি সেবন করিয়া রক্ষা পাইয়াছে এবং যাহারদিগের নাড়ীত্যাগ ও হিমাঙ্গ প্রভৃতি মৃত্যুচিহ্ন হইয়াছিল তাহারাও ঐ হরিতাল ভস্ম দ্বারা রক্ষা পাইয়াছে।’ খোদ শহর কলকাতার লোকেরাও কলেরাসংক্রান্ত এমন অন্ধবিশ্বাস বা গুজবের বাইরে ছিল না। ১৮১৮-এর ১২ সেপ্টেম্বর ‘সমাচার দর্পণ’ জানাচ্ছে, কলেরার ‘আসল উত্স’ জানিয়ে ইংরেজিতে লেখা এক বাঙালি ভদ্রলোকের চিঠি তাদের হাতে এসেছে। সেখানে দাবি করা হয়েছে, কলকাতার লালবাজারের নতুন গির্জার ওপর বায়ুপ্রবাহের দিক নির্ণয়ের জন্য যে হাওয়ামোরগ বসানো হয়েছে, সেটিই আদতে কলেরা-ওলাওঠার প্রকোপের জন্য দায়ী! ওই চিঠিতে লেখা হয়েছিল: ‘যেহেতুক সে মুরগ যে দিকে আপন মুখ ফিরায় সেই দিকের লোক মরে।...’ পত্রলেখক আরো দাবি করেন, তার তিনজন আত্মীয়ের দিকে হাওয়ামোরগটি ‘মুখ করিয়া’ ছিল দেখে তিনজনের মধ্যে দুজনই ‘ওলাওঠা হইয়া সেখানেই মরিল। তৃতীয়জন যুবা ছিল অতএব পলাইয়া রক্ষা পাইল।’ চিঠির শেষে পত্রলেখক আবার এও বলেছেন, তার মনে হচ্ছে, ওই গির্জার হাওয়ামোরগটিকে বন্দি করলে কলেরার বিস্তার ঠেকানো যেতে পারে! এ রকম আজব গুজব সত্যিই বিরল।

বাংলা অঞ্চলে মহামারীরূপে কলেরার আবির্ভাবের ৬০ বছরেরও বেশি সময় পার হলেও যে রোগটিকে ঘিরে মানুষের অন্ধবিশ্বাসের ইতি ঘটেনি, তার প্রমাণ মেলে ১৮৮২ সালে প্রকাশিত ‘ঢাকা প্রকাশ’-এর একটি খবরে; যেখানে জানা যায়, ঢাকার গোঁড়া হিন্দু ও বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরা চিকিত্সা বাদ দিয়ে ধর্মচর্চাকেই কলেরা প্রতিকারের উপায় বলে ধরে নিয়েছেন: ‘এখনো ঢাকা হইতে ওলাওঠা তিরোধান হইল না।...নবাবপুর প্রভৃতি স্থানে উহার প্রকোপ সমধিক পরিমাণেই লক্ষিত হইতেছে; কিছুতেই শান্তি হইতেছে না...নবাবপুরবাসীরা গোঁড়া হিন্দু ও বৈষ্ণব ধর্ম্মাবলম্বী...তাহাদের বিশ্বাস, হরিনাম সঙ্কীর্তন ও দেবার্চ্চনা করিলে পীড়ার শান্তি হইবে। বস্তুত নাম সঙ্কীর্তনে উহাদের ওলাভীতি কিয়ত্ পরিমাণে দমিত হইতেছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর বহুসংখ্যাক লোক দলে দলে মশাল হস্তে করিয়া নিজ নিজ বাটীর নিকটবর্তী প্রশস্ত রাজপথে হরিনাথ সঙ্কীর্তন করিতেছেন।...’

প্রতিরোধের প্রয়াস, জানার চেষ্টা

উনিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকেই কলেরা সম্পর্কে বাঙালির মনে কুসংস্কার ও ভীতির প্রকাশ দেখা গেলেও পরে কলেরার সত্যিকার চিকিত্সা এবং রোগটি সম্পর্কে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক তথ্য বিষয়ে জানার আগ্রহ একটু একটু সমাজে বাড়তে থাকে। ঔপনিবেশিক সরকারও লোক দেখানো হোক বা সত্যিকার কল্যাণের স্বার্থে হোক, কলেরা আক্রান্ত স্থানীয়দের চিকিত্সার ব্যবস্থা অল্প হলেও নিচ্ছিল। ১৮২০-এর দশকে কলকাতায় জন ব্রেটন নামে একজন অভিজ্ঞ ইংরেজ চিকিত্সক ছিলেন। বাংলা-হিন্দি-উর্দু এ তিন ভাষায় পারদর্শী ডা. ব্রেটন ইংরেজ কোম্পানির চিকিত্সা বোর্ডের অনুরোধে কলেরা নিয়ে বাংলা ভাষায় একটি পুস্তিকা রচনা করেছিলেন। ১৮২৫ সালে শহর কলকাতায় কলেরা মহামারী আকারে দেখা দিলে ব্রেটন ও তার ২০ জন ছাত্রসহ কলেরা প্রতিরোধে রাতদিন কাজ করেছিলেন। পাশাপাশি কলকাতা ও এর আশপাশ অঞ্চলে কলেরা নিয়ে বাংলায় লেখা ব্রেটনের পুস্তিকাটি গণহারে বিলি করা হয়েছিল। ফলে সাধারণ পড়তে জানা বাঙালির মনে কলেরা ও এর প্রতিরোধ বিষয়ে ধারণা জন্মে। ব্রেটনের কলেরাবিষয়ক পুস্তিকা পড়ে স্বয়ং রামমোহন রায় খুশি হয়ে তাকে চিঠিতে লিখেছিলেন ‘[ওই পুস্তিকাটি] দেশীয় ব্যক্তিদের নিকট আশীর্বাদস্বরূপ’। কলেরার প্রকোপ অবশ্য ব্রেটনের দাওয়াইতে খানিক কমলেও পরে ১৮৯০-এর দিকে যখন তা আরো গণহারে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন ইংরেজ সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, স্থানীয় জনতাকে কলেরার টিকা দেয়া হবে। ১৮৯৪-এর মার্চে কলকাতায় স্থানীয়দের কলেরার টিকা দেয়া শুরু হয়েছিল। ইংরেজদের উদ্যোগের পাশাপাশি বাঙালি শিক্ষিত সমাজও কলেরার বিস্তার ও প্রতিকার নিয়ে লেখালেখিতে সক্রিয় হয়েছিল। তরুণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৩ সালে ‘সাধনা’ পত্রিকায় ‘ওলাউঠার বিস্তার’ শিরোনামে কলেরার উদ্ভববিষয়ক বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ লিখেছেন; ‘চিকিত্সা সম্মিলনী’ নামের স্বাস্থ্যবিষয়ক মাসিক পত্রিকায় জনৈক বেনামি লেখক ‘কলিকাতার কলেরা ও কলের জল’ নামের লেখায় দূষিত পানি দ্বারা কলেরা বিস্তারের বিজ্ঞানসম্মত কারণ অনুসন্ধান করেছিলেন ১৮৮৮-তে। আর ফরিদপুরের ডাক্তার অভয়কুমার সরকার ১৯২৮-এ লিখেছিলেন ‘ওলাউঠা রোগের প্রতিকার ও চিকিত্সা’ শিরোনামে প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার একটি পূর্ণাঙ্গ বই। এ ঘটনাগুলোকে বাঙালির মনে বিজ্ঞানচেতনা ও আধুনিক চিকিত্সা সম্বন্ধে জানার আগ্রহ বৃদ্ধির লক্ষণ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।

তথ্যসূত্র:

সংবাদপত্রে সেকালের কথা—ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

সংবাদপত্রে সেকালের কলকাতা—হরিপদ ভৌমিক

উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গের সমাজ—মুনতাসীর মামুন

চিকিত্সাবিজ্ঞানের ইতিহাস—বিনয়ভূষণ রায়

স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান—সুন্দরীমোহন দাশ

ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য—দীনেশচন্দ্র সেন

জীবন-চরিত—আজিমদ্দিন মহাম্মদ চৌধুরী

সাময়িকী: পুরনো সাময়িকপত্রের প্রবন্ধ সংকলন—প্রদীপ বসু সম্পাদিত

মুহিত হাসান: নন-ফিকশন লেখক


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন