বাংলার লৌকিক দেবী

ওলাবিবি

উদয় শংকর বিশ্বাস

বাঙালি মানসে শাস্ত্রীয় দেবতাদের অবস্থান দৃঢ় বিভিন্ন পারবে বাঙালি মাতে, দেবতাদের তুষ্টি বিধানে নানা আচার পালন করে একই সঙ্গে বিভিন্ন লৌকিক দেব-দেবীর থানে মাথা ঠোকে, নিজেকে সঁপে দেয় এমনই এক দেবী হলেন ওলাবিবি কলেরা রোগের দেবী হিসেবে তিনি সর্বত্র পূজিত গ্রামবাংলায় কলেরা হওয়াকে ওলাওঠা বলে সেজন্য কলেরার দেবীকে ওলাউঠার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওলাবিবি বলা হয়

লৌকিক দেবীদের নানা কীর্তি থাকে তারা ভক্তদের বিপদ থেকে রক্ষা করেন, নিজের মাহাত্ম্য প্রচার করেন হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছে ওলাবিবির গ্রহণযোগ্যতা আছে, যদিও নামে ভিন্ন হিন্দুরা ওলাবিবিকে ওলাইচণ্ডী বলেন নামে ভিন্নতা থাকলেও কর্মকাণ্ড একই জানা যায়, ওলাবিবি একা থাকেন না তিনি তার ছয়ও বোনকে সঙ্গে করে ভক্তদের সামনে দাঁড়ান তার বোনেরা হলেন আসানবিবি, ঝোলাবিবি, আজগৈবিবি, চাঁদবিবি, বাহড়বিবি ঝেটুনেবিবি এদের একসঙ্গে সাতবিবি বলা হয়

অন্যান্য লৌকিক দেবীদের মতো ওলাইচণ্ডী দেখতে কুশ্রী নন লক্ষ্মী-সরস্বতীর মতো দেখতে, তার মাথায় আবরণ সারা গাজুড়ে অলংকার থাকে মুসলমানেরা ওলাবিবিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেন মুসলিম রীতিতে কুমারী বালিকারূপে ওলাবিবিকে সাজানো হয় বস্ত্র সাদাসিধে শুধু তা- নয়, ওলাবিবিকে আসানবিবির মতো চিত্রিত করা হয় ওলাবিবির গায়ের রঙ হলুদ, চোখ দুটি, কখনো কখনো তিনটি দুই হাতে বালা থাকে শাড়ি-ব্লাউজ পরিহিত অবস্থায় ওলাবিবির মাথায় মুকুট থাকে চৈত্রের শেষে ওলাবিবির থানে সাতটি মুদ্রাকৃতি স্তূপ বা ঢিবিতে শিরনি দেয়া হয় মাঘ মাসের প্রতি শুক্রবার রাতে বিবির জন্য জাগরণের পালা গাওয়া হয় ভক্তরা তাতে শামিল হয় মুসলমান মেয়েরা সারা রাত ধরে জাগরণের গান গায় শ্রোতা হিন্দু-মুসলিম সবাই, এখানেও সম্প্রীতির মেলবন্ধন ভক্তদের কলেরার হাত থেকে রক্ষার আর্তি থাকে পীরের নৈবেদ্য সাধারণ বাতাসা, পান-সুপারি ইত্যাদি মন্ত্র নেই, পুরোহিতেরও প্রয়োজন পড়ে না সবটাই অতি সাধারণ সারা বছর থান একাকী থাকলেও সময় ভক্তদের কলরবে মুখোর হয়ে ওঠে রোগমুক্তির আশায় থানের গাছের ডালে ঢিল বাধা হয় এসব লৌকিক রীতি

সাতবিবিকে বীরভূম অঞ্চলে সাত বাউনীত এবং বাঁকুড়ায় সাত বনবিবি বলে বোঝা যাচ্ছে, এরা সাত বোন একসঙ্গে থাকেন, সবার মধ্যমণি ওলাবিবি

বাংলায় কলেরা মহামারী আকার প্রায় প্রতি বছর দেখা দিত এজন্য অপদেবতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আশায় প্রায় প্রতি মাসে ওলাবিবির থানে মানত করে সমবেত গ্রামবাসী এজন্য লৌকিক দেবীদের মতো ওলাবিবিকে অস্থায়ী মণ্ডপ বা থানে পূজা করা হয় হিন্দু ভক্তরা নিত্যপূজা অনাড়ম্বরভাবে করে তবে যেদিন ছাগ বলি হয়, সেদিন আড়ম্বরের মাত্রা কিছুটা বাড়ে এছাড়া বছরে একবারের জন্য হলেও বিশেষ পূজা করে গ্রামবাসী সমবেতভাবে বিশেষ পূজার সময় মাঙন করার রীতি দেখা যায় মাঙন হলো সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে পূজার জন্য ফুল-ফল ভিক্ষা করার লৌকিক রীতি মাঙনে গ্রামের যুবারা অংশ নেয় মাঙনে প্রাপ্ত ফল-ফুল দিয়ে ওলাইচণ্ডীর পূজা করা হয় পূজার পূর্ব রাত্রে ওলাইচণ্ডীকে নিয়ে গান গাওয়া হয় এসব অনুষ্ঠানে হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুক্ত হন অসাম্প্রদায়িক বাংলায় ক্ষুদ্ররূপে ওলাইচণ্ডীর পূজা দেখা যায়

কলেরার মতো অতি সংক্রমণ রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আশায় প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার মানুষ ওলাবিবি বা ওলাইচণ্ডীকে পূজা দিয়ে আসছে এর মাধ্যমে কলেরার প্রাদুর্ভাব কম হয় কিনা তা যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই তবে কথা বলা যেতে পারে, এমন লোকাচার লোকমানুষের বিশ্বাসে অনেক গভীরে প্রথিত হয়ে আছে তাকে সহসা উপড়ানো যাবে না প্রতি শনি মঙ্গলবার নিত্যপূজা হয় চৈত্র-জ্যেষ্ঠ মাসে বার্ষিক পূজা হয় ওলাবিবির চুল খোলা থাকে, হাতে থাকে আশাবারি বা কোথাও ঝাঁটা অর্থাত্ তিনি যেন রোগজীবাণু সমস্ত নিজ হাতে পরিষ্কার করে দেন লৌকিক দেবী সাধারণত শীতলা মন্দিরে পূজিত হন কোথায় স্বতন্ত্র থান দেখা যায় ওলাবিবি গৌণ দেবীরূপেই পূজিত হন যখন কলেরা প্রবল আকারে দেখা দেয়, তখন ভক্তরা জলপড়া, তেলপড়াসহ শিশুদের ঝাড়ানোর ব্যবস্থা করে কাজটি মৌলভী বা পুরোহিত উভয়ই করেন বাংলার গ্রামীণ মানুষের বিশ্বাস, ওলাবিবি বা বিবিমা সব দিক দিয়ে যে গ্রামে অধিষ্ঠান করেন, সেই গ্রামকে রক্ষা করেন সত্যিকার অর্থেই ওলাবিবি কলেরা বা মহামারীর দেবী

হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে ওলাইচণ্ডী যেন চণ্ডীরই লৌকিক রূপ বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন নামে চণ্ডীর থান দেখতে পাওয়া যায় চণ্ডীর লৌকিক রূপের মধ্যে আছে জয়চণ্ডী, মাকালচণ্ডী, বড়ামচণ্ডী, বিজয়চণ্ডী, ফিরাইচণ্ডী, বেতীচণ্ডী, ললাটচণ্ডী, ভেতীচণ্ডী, বল্লুকচণ্ডী, ভাণ্ডারচণ্ডী, মগবাচণ্ডী, গজাইচণ্ডী, যুগলচণ্ডী, শুভচণ্ডী, কল্যাণচণ্ডী, বারাহীচণ্ডী, হাটচণ্ডী প্রভৃতি এরা সবাই গ্রামে গ্রামদেবী বা বনদেবীরূপে কল্পিত বিবর্তনের মাধ্যমে এসব নানা নামের লৌকিক চণ্ডী কালক্রমে কোথাও কোথাও পৌরাণিক চণ্ডীর সঙ্গে পূজিত হতে শুরু করেছেন আবার গ্রামের আস্তানা ছেড়ে শহরে নতুন ঠিকানা গড়েছেন খোদ কলকাতা শহরে ওলাবিবির মন্দিরের হদিস দিয়েছেন লৌকিক দেব-দেবী নিয়ে গবেষণাকারী গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু তিনি তার বাংলার লৌকিক দেবতা গ্রন্থে বলেছেন, সুরেন্দ্র ব্যানার্জি স্ট্রিটের শীতলা মন্দিরে বাঞ্ছারাম অত্রূদ্ধর লেনের বাঁকা রায় বা ধর্মঠাকুর মন্দিরে ওলাবিবির মূর্তি আছে এমনকি উত্তর-পূর্ব কলকাতার বেলগাছিয়ায় ওলাবিবি বা ওলাইচণ্ডীর খ্যাতি অনেক দিনের যদিও তা অভিজাত শ্রেণীর কাছে নয় অব্রাহ্মণ দিয়ে ওলাইচণ্ডীর পূজা করা যায় আর থেকে বোঝা যায়, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ কলেরার মতো ভয়াবহ রোগের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে তাদের ওলাবিবি অবশ্য পাশে দাঁড়িয়েছেন

ওলওঠা বা কলেরা রোগ দেখা দিলে বহুদূর থেকে গ্রামের মানুষ ওলাবিবির থানে এসে পূজা বা হাজোত দিয়ে থাকে সেজন্য তার কোনো মূর্তি কিংবা বিগ্রহের প্রয়োজন হয় না ঢেলা বা পাথরের টুকরাকেই ওলাবিবি মনে করে নেন তারা বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে, বিশেষত বৃহত্তর দিনাজপুর দক্ষিণাঞ্চলে রকম অনাড়ম্বর বহু থান দেখা যায় কোনো কোনো থান ঢেলা পীরের থানে রূপান্তরিত হয় সন্তান লাভের আশায় বন্ধ্যা নারীরা ঢেলা বেঁধে মানত করেন মনোস্কামনা পূর্ণ হওয়ার পর তারা সেই ঢেলার বাঁধন খুলে দেন ওলাবিবির সঙ্গে মা শীতলার অনেক সামঞ্জস্য রয়েছে শীতলা হলেন বসন্ত রোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সাধারণত প্রাচীন বট, অশ্বত্থ বৃক্ষের তলে শীতলার থান দেখা যায় ওলাবিবির মতো কোথাও একখণ্ড শিলা বা ঘটের প্রতীকে তিনি পূজিত হন তার ডান হাতে ওলাবিবির মতো ঝাঁটা থাকে বাম হাতে কলস বসন্ত-হাম ইত্যাদি রোগের প্রাদুর্ভাব হলে চৈত্র-জ্যৈষ্ঠ মাসে শীতলার পূজা করা হয় সময় ওলাবিবিকে স্মরণ করা হয় এমনি করে ওলাবিবি নিত্যস্মরণীয় লোকসমাজে ওলাবিবির প্রভাব প্রতিপত্তি এতটুকু কমেনি শত প্রতিকূলতার মাঝেও অন্যান্য লৌকিক দেবীর মান্যতা কমে গেলেও ওলাবিবি রয়েছেন স্বমহিমায় এবং থাকবেন বহুদিনশতাব্দীব্যাপী

উদয় শংকর বিশ্বাস: শিক্ষক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন