১৮৮১ সন। ঢাকায় তখন যেরূপ ওলাউঠার প্রকোপ হইয়াছিল, সেরূপে উত্কট অবস্থা বড় দেখা যায় না। প্রথমতঃ তাঁতীবাজারের পথে যাইতে ‘হরিবোল’ শব্দে বহু মৃতব্যক্তিকে লইয়া যাইতে দেখিতাম, তখন মড়াটা ডানদিকে কি বামদিকে দেখিলাম, তাহাই লইয়া মনে বিতর্ক করিয়া যাত্রার শুভাশুভ নির্ণয় করিতাম। কচি প্রাণে তখনও ভয়ের সঞ্চার হয় নাই। তখন থাকিতাম বাবুরবাজারে দীননাথ মুন্সীর হাবিলিতে মেস করিয়া! সেই মেসে মামাদের গ্রামের বহু ছেলে থাকিত, অবনীশ, মহেন্দ্র, অবিনাশ প্রভৃতি। মহেন্দ্র এখন ঢাকা জেলা কোর্টের ফৌজদারী বিভাগের সর্বশ্রেষ্ঠ উকিল।
আমাদের বাড়ীর কাছে ছিল রামপ্রসন্ন রায়ের বাসা! তিনিও আমাদের গ্রামের লোক, ডেপুটি-ম্যাজিস্টেটি করিতেন। তাঁহার ছোট ভাই উমাপ্রসন্ন আমাদের সঙ্গে জগন্নাথ স্কুলে পড়িত, তাহার চেহারা ছিল কালো খর্ব স্থূল। কলেরা তাঁতীবাজার হইতে শুরু করিয়া ধীরে ধীরে বাবুরবাজার মুখে রওনা হইল। স্কুলে যাইয়া দেখিতাম ক্রমশঃ ছেলে কমিয়া যাইতেছে, তাহারা ভয়ে ঢাকা ছাড়িয়া যাইতেছে। পথে দোকানপাটে শুষ্ক ভীতনেত্র লোকগুলি দাঁড়াইয়া কেবল ঐ ব্যারামের কথাই বলিতেছে—সেরূপ ভয় কলিকাতার মত স্থানে হইতেই পারে না। কলিকাতায় কোথায় কি হইতেছে—কে খবর রাখে? শুধু সংবাদপত্র পড়িয়া জানা। কিন্তু ঢাকার মত ক্ষুদ্র শহরে সে যে কি ভয়—তাহাও কলেরা আবার সংক্রামক! সমস্ত শহরটির উপর একটা মৃত্যুর ছায়া পড়িয়াছিল—সকলের মুখে কালিমা। একদিন সন্ধ্যাকালে মেসে বসিয়া আছি, উমাপ্রসন্ন আসিয়া বলিল, ‘আমাদের পায়খানাটা ভাল নয়, তোদের এখানে যাব’। সে ঘটী হাতে গেল; কিন্তু প্রায় এক ঘন্টার মধ্যে ফিরিল না দেখিয়া আমরা যাইয়া দেখি, সে পায়খানার উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া অজ্ঞান হইয়া আছে, তাহাকে ধরাধরি করিয়া উঠাইয়া আনিয়া বাড়িতে পৌঁছাইয়া দিলাম। আমরা সারা রাত্রি তাহার সেবা করিতে লাগিলাম; রাত্রি একটা দুইটা পর্যন্ত, কাগজী লেবু, ঔষধ, বরফ প্রভৃতির জন্য বাজারে হাঁটাহাঁটি করিতে লাগিলাম। তাহার পরদিন ভয়ে আমরা কিছু খাইলাম না, বেলা ৪টার সময় উমার অবস্থা অতি খারাপ হইল, একে তো সে কালো ছিল, তাহার উপর চোখ দুটি শিবচক্ষুর মত হইল, চুলগুলি চাঁছিয়া ফেলা হইল, গণ্ডের কঙ্কাল উঁচু দেখা যাইতে লাগিল, একটি নেংটি পরা—সে কি ভয়ানক দৃশ্য। আজগর মিঞা হোমিওপ্যাথি চিকিত্সা করিতেছিলেন, তিনি সেই অবস্থায় ফুট বাথের ব্যবস্থা করিলেন। কিন্তু, যেই তাহার পা-দুখানি গরম জলে ডুবানো হইল অমনই প্রাণবায়ু নির্গত হইয়া গেল। সে কি শোকাবহ দৃশ্য! তাহার মাতা প্রায় ৫ সের পরিমিত বরফখণ্ড হাতে লইয়া উন্মত্তভাবে আজগর মিঞাকে ছুঁড়িয়া মারিতে যাইতেছেন—আজগর মিঞা কোটের বোতাম খুলিয়া উন্মুক্ত বক্ষে বলিতেছেন ‘মা মারুন—আমি আপনার ছেলের প্রাণের জন্য দায়ী, আমাকে মারিয়া যদি শোক নিবারণ হয় তাহাই করুন’। উমাপ্রসন্নের মাতা তখন বরফখণ্ড ছুঁড়িয়া ফেলিয়া অজ্ঞান হইয়া পড়িলেন। আমরা উমাকে দাহ করিয়া রাত্রি ১১টার সময় মেসের বাসায় ফিরিলাম, সেদিন কেহ জল-স্পর্শ করি নাই। রাত্রি দুইটার সময়—অবনীশ কাঁদিয়া উঠিল, আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম কি হইয়াছে, সে বলিল ‘কলেরা’। ‘কিরূপে হইল, তাহার তো কোনো লক্ষণ দেখিতেছি না?’ সে কাদিয়া বিলল, ‘আমি সারাদিন কিছু খাই নাই, তবু পেটের মধ্যে কেমন অসোয়াস্তি বোধ করিতেছি।’ আমি হাসিয়া উঠিলাম। আমরা কেহই এখন পর্যন্ত ঘুমাই নাই, ঘুমের ভান করিয়া চক্ষু মুদিয়া পড়িয়া ছিলাম, প্রত্যেকের মনে হইতেছিল ‘আমার কলেরা হইল’—কারণ পেটের ভিতর একটা অসোয়াস্তির ভাব সকলেই অনুভব করিতেছিলাম। রাত্রি কোনরূপে কাটিয়া গেল। পরদিন বেলা ৮টার সময় তৈল গায়ে মাখিয়া আমরা বুড়িগঙ্গায় স্নান করিতে গেলাম। সেইখানেই নৌকা করিয়া সুয়াপুর রওনা হইয়া যাইব, নৌকাতে রান্না করিব, এই সঙ্কল্প করিলাম। কিন্তু নদীর ঘাটে যাইয়া দেখিলাম, ঢাকা হইতে সুয়াপুরের ভাড়া ২ টাকা ২\০ টাকার স্থলে ৩০্। ৪০্ টাকা হইয়াছে। ভীতসন্ত্রস্ত বহু শহরবাসী নদীর ঘাটে হাজির হইয়াছে ও প্রাণ লইয়া পলাইতেছে; নৌকা আর পাওয়া যায় না; আমাদের মাথায় বজ্রাঘাত হইল। শেষে ঠিক করলাম, ৩০। ৪০ টাকা দিয়াই নৌকা ভাড়া করিব। এমন সময় বাহির হইতে বুড়িগঙ্গা বাহিয়া একখানি নৌকা আসিল, মাঝিরা শহরের এই উত্পাতের কথা জানিত না। আমরা সাগ্রহে সুয়াপুর যাইতে ভাড়া কত জিজ্ঞাসা করিলাম, তাহারা বলিল, ৩ টাকা। আর দরদস্তুর না করিয়া তখনই মেসের বাড়ীতে তালা লাগাইয়া সকলে একত্র নৌকায় উঠিয়া পড়িলাম। ইতিমধ্যে কোথা হইতে শ্যেন-পক্ষীর ন্যায় আমার ভগিনীপতি নব রায় মহাশয় আসিয়া উপস্থিত হইয়া বলিলেন, ‘দীনেশ, আমি তোমাকে কিছুতেই বাড়ী যাইতে দিব না, চল আমাদের বাসায়। এবার তোমার পরীক্ষার বত্সর।’ আমার বয়স তখন চৌদ্দ। কাঁদিতে কাঁদিতে নব রায়ের বাড়ীতে তাঁতীবাজার গেলাম, পথে বলিলাম ‘রায়জী আপনি কি জানেন না, আমি মা বাপের এক ছেলে?’ তিনি তাঁহার দন্তপঙিক্ত বাহির করিয়া উপেক্ষাভরে হাসিলেন। আমি ভাবিলাম ‘মরিবার সময় মায়ের কাছে শুইয়া মরিতে পারিব না, এই আমার অদৃষ্টের লেখা।’ সে দিন যে কিভাবে কাটিল, তাহা আর কি বলিব? একটা উত্কট দুঃস্বপ্নের মত দিনটা চলিয়া গেল। স্কুলে গেলাম, দেখিলাম সহপাঠীরা প্রায় সকলে পলাইয়া গিয়াছে, মাষ্টারবর্গও প্রায়ই অনুপস্থিত। রাস্তা দিয়া আসিতে পথে পথে কেবল ‘হরিবোল’, কান্নার রোল, অনাথ ছেলেমেয়েদের চিত্কার, দোকানপাঠ বন্ধ। ‘বলহরি’ মিষ্ট কথাটা বুকের মধ্যে বজ্র নিনাদের মত বাজিতে লাগিল। সন্ধ্যায় মনে হইত সমস্ত শহরটি ঘিরিয়া ছায়ার মত কে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। মানুষ দেখিয়া ভূত বলিয়া ভয় হইতে লাগিল। রাত্রে আসিয়া বাসায় দেখিলাম কৈলাসবাবু চিত্ হইয়া পড়িয়া আছেন, তিনি 3rd Year-এ পড়িতেন, নব রায়ের আত্মীয়। এখন তিনি ফরিদপুর জেলা কোটের উকিল-সরকার। নব রায়ের ভৃত্য ডেঙ্গু ও দাসী বামা আমার ও কৈলাসবাবুর কাছেই দুইটি পেয়ালা ভাঙের সরবত্ লইয়া আসিল। কৈলাসবাবু এক পেয়ালা খাইলেন, নব রায় এক পেয়ালা পূর্বেই খাইয়াছিলেন। আমি ব্রাহ্মের পুত্র, বলিলাম—‘ভাঙ বা কোন নেশা প্রাণান্তেও খাইব না। কলেরা হইলেও নয়।’ বাহিরে এই বিক্রম দেখাইয়া মাঝের ঘরটায় একা শুইয়া পড়িলাম। তখন আমার ভগিনী সেখানে ছিলেন না। রাত্রি দুই প্রহরের সময় পাশের বাড়ীতে উত্কট ‘বলহরি’ চিত্কারে আমার ঘুম ভাঙিয়া গেল। ভয়ে আমার ঘুম হয় নাই, একটু তন্দ্রা আসিয়াছিল মাত্র। আমি সেই তন্দ্রার মধ্যে স্পষ্ট দেখিতেছিলাম, নেংটি পরিয়া উত্কট শিবনেত্রে, মুণ্ডিত মস্তক দোলাইয়া একটা আঙুল নির্দেশ করিয়া গাঢ় কৃষ্ণ ছায়ার মত উমাপ্রসন্ন আসিয়া আমার পাশে দাঁড়াইয়াছে ও বলিতেছে ‘দীনেশ, চল্ আমার সঙ্গে যাবি?’
নিদ্রাভঙ্গের পর দেখিলাম, আমার সমস্ত শরীর হিমের মত ঠান্ডা হইয়া গিয়াছে, ভয়ে বাকেরাধ হইয়াছে, হাত-পা নাড়িবার শক্তি নাই। প্রায় আধ ঘন্টা পরে হাতে পায়ে একট শক্তি হইলে আমি হামাগুড়ি দিয়া অতি কষ্টে নব রায়ের ঘরের দরজায় কড়া নাড়া দিয়া তাঁহাকে জাগাইলাম। তিনি আমার অবস্থা দেখিয়ে ভীত হইলেন এবং কৈলাসবাবুর ঘরে আমার থাকিবার ব্যবস্থা করিয়া দিয়া নিজে শুইয়া পড়িলেন। কৈলাসবাবু দেখিলেন—আমার হাত পা একেবারে ঠান্ডা, আমার মুখে কথা বাহির হইতেছিল না, জিভটা শুকাইয়া কাঠ হইয়াছে। তিনি লেপ মুড়ি দিয়া আমার হাতে পায়ে নিজের হাত পা ঘষিয়া গরম করিলেন। প্রভাত বায়ূর স্পর্শে আমি যেন নূতন জীবন পাইলাম এবং সেই দিনই সুয়াপুর রওনা হইয়া গেলাম। বুড়িগঙ্গার হাওয়ার স্পর্শে আমার সমস্ত ভয় দূর হইল। পল্লীমায়ের অঞ্চলের বাতাস আমার গায়ে লাগিল।
সুয়াপুর আসিয়া ভয় দূর হইল, খুব স্ফুর্তির সঙ্গে কয়েক দিন কাটিল। পূজার কিছু পূর্বে ঢাকার চিঠিতে জানিলাম, ঢাকার কলেরার প্রকোপ কমিয়াছে। টেস্ট পরীক্ষা নিকটবর্তী, উহা তখন পূজার পূর্বেই হইত। সুতরাং ঢাকায় ফিরিয়া আসিতে হইল, কিন্তু ঢাকায় আসিয়া কলেরার ভয় আবার আমায় পাইয়া বসিল, ‘হরিবোল’ শব্দ রাস্তায় শুনিলেই চমকিয়া উঠিতাম, পেটের ভিতর সর্বদাই একটা অসোয়াস্তির ভাব অনুভব করিতাম এবং রোজ সন্ধ্যার পর শুইয়া মনে হইত, সেই রাত্রের কলেরা রোগে মরিয়া যাইব। এই ভয়ে দিনরাত ঔষধ পড়িয়া আমার অনেক আলপাকা ও গরদের জামা জ্বালিয়া গিয়াছে। শুধু সালফিউরিক এসিড নয়, পিপারমেন্ট, বিসমাথ, ভুবনেশ্বর, ক্লোরোডাইন, স্পিরিট ক্যাম্ফার প্রভৃতি ঔষধ খাইতাম। সালফিউরিক এসিড ডিল পকেটেই থাকিত, শিশির ছিপি খুলিয়া ঔষধ খাইয়া এমনই পেটের অবস্থা দাঁড়াইয়াছিল যে প্রায়ই আমার কোষ্ঠবদ্ধ হইয়া থাকিত। এইভাবে ২/৩ বত্সর ঢাকায় কাটাইয়া আমার শরীর একেবারে মাটি করিয়া ফেলিয়াছিলাম। ভয়-জনিত মস্তিষ্কের বিকার, স্নায়বীয় দুর্বলতার দরুন শিরঃপীড়া ও বাতব্যাধি শেষে আমার জীবনটাকে অকর্মণ্য করিয়া ফেলিয়াছিল। ঢাকায় তখন জলের কল ছিল না, কূপের জল খাইতে হইত; তাহাতে গলগন্ড জন্মিত এবং সেই জলের গুণে বার মাস কলেরা ঢাকায় লাগিয়াই থাকিত। ঢাকার নামে আমার সেই শৈশবের ত্রাস এখনও আছে। ছোট ছোট দুর্গন্ধ গলি, বৃষ্টি হইলে কলিকাতার গলিতে জল দাঁড়ায়, ঢাকায় সুরকি ও নানা আবর্জনা পচিয়া একটি ক্বাথের মত পদার্থ প্রস্তুত হয়, পদব্রজে চলিলে হাঁটু পর্যন্ত সেই ক্বাথে লিপ্ত হয়। ঢাকায়ই আমার স্বাস্থ্য চিরদিনের জন্য হারাইয়া আসিয়াছি। এখন শুনিয়াছি জলের কল হওয়ায় কলেরা কমিয়াছে কিন্তু অলিগলির নরকে বোধ হয় যমরাজ তেমনই জোরে প্রভুত্ব করিতেছেন।
১৮৮১ সনের কলেরার মহামারীতে আমার অঙ্কের চর্চা বেশী দূর অগ্রসর হয় নাই। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অঙ্কে তিন নম্বর কম হইয়াছিল, শুনিলাম, তদ্দরুণ ৩০ নম্বর অপরাপর বিষয় হইতে কাটা হইয়াছিল এবং এই জন্য আমি তৃতীয় শ্রেণীতে পাশ হইয়াছিলাম।
[বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অন্যতম পণ্ডিত গবেষক দীনেশচন্দ্র সেনের (১৮৬৬-১৯৩৯) পৈতৃক ভিটা ছিল ঢাকার সুয়াপুরে। ঢাকাতেই তার বেড়ে ওঠা। ১৮৮১ সালে ঢাকায় মহামারী আকারে কলেরা বা ওলাউঠা রোগ কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন নিজের আত্মজীবনী ‘ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য’-এ (১৯২২)। ওই গ্রন্থের ‘ঢাকায় ওলাউঠা’ শীর্ষক পরিচ্ছেদটি এখানে মুদ্রিত হলো]