দক্ষিণ এশিয়ায় কভিড-১৯

মোকাবেলায় সবচেয়ে বড় বাধা কি দারিদ্র্য

সাইফ বাপ্পী

এশিয়ার সবচেয়ে বড় বস্তিটি অবস্থিত মুম্বাইয়ের ধারাভিতে। এখানকার ৫২ বছর বয়সী এক পৌরকর্মীর দেহে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে গতকাল। ওই ব্যক্তি মূলত মুম্বাইয়ের ওরলি এলাকার বাসিন্দা হলেও তার কর্মক্ষেত্র ছিল ধারাভিতে। নিয়ে ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ধারাভি এলাকায় কভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি পাওয়া গেল দুজন।

এর আগে বুধবার কভিড-১৯- আক্রান্ত ৫৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। ওই ব্যক্তির বিদেশ বা সংক্রমিত এলাকায় ভ্রমণের কোনো ইতিহাস পাওয়া যায়নি। গত ২৩ মার্চ তিনি নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমণের লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। বর্তমানে তার বাড়ি সিল করে দেয়া হয়েছে এবং বাড়ির অন্য সাত বাসিন্দাকে হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে।

ওই ব্যক্তি পেশায় ছিলেন দর্জি। ভারতের স্লাম রিহ্যাবিলিটেশন অথরিটির (এসআরএ) কার্যক্রমের আওতায় বানানো বড় এক ভবনে বাস করতেন তিনি। ৩০০টি ফ্ল্যাটের ওই ভবনের পুরোটাই সিল করে দেয়া হয়েছে। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষার আগ পর্যন্ত ওই ভবনে কাউকেই ভেতরে ঢুকতে বা বেরোতে দেয়া হচ্ছে না। ওই ভবনের বাসিন্দাদের স্থানীয় পৌর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে খাবার রেশন সরবরাহ করা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, পৃথিবীজুড়ে মোট দরিদ্রের অর্ধেকই বাস করে পাঁচটি দেশে। পাঁচ দেশের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ রয়েছে দুটি। এর মধ্যে ভারতের অবস্থান শীর্ষে। পঞ্চম বাংলাদেশ। দুটি দেশেই কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। আশঙ্কা রয়েছে, বাংলাদেশ ভারতের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলোয় করোনা মোকাবেলার পথে বড় ধরনের বাধা হয়ে উঠতে পারে দারিদ্র্য।

নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় ভারত এরই মধ্যে লকডাউনে চলে গিয়েছে। বাংলাদেশে লকডাউন ঘোষিত না হলেও জনগণকে বলা হয়েছে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বজায় রাখার পাশাপাশি ঘরে অবস্থান করতে। ঘোষণা বাস্তবায়নে রাস্তায় সক্রিয় রয়েছে পুলিশ সেনাবাহিনী।

বৈশ্বিক মহামারী কভিড-১৯ মোকাবেলা বাংলাদেশ ভারতের দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা খাতের জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য, বিশেষ করে বাংলাদেশ ভারতের জন্য অনেক বড় এক মানবিক সংকটের কারণ হয়ে উঠেছে দারিদ্র্য।

বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় নভেল করোনাভাইরাসের সবচেয়ে বড় হটস্পট হয়ে উঠেছে মুম্বাই। গতকাল পর্যন্ত শুধু মুম্বাই শহরেই ১৮১টি করোনা সংক্রমণের তথ্য নিশ্চিত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে নয়জনের। সব মিলিয়ে গতকাল পর্যন্ত ভারতে মোট সংক্রমণ নিশ্চিত হয়েছে হাজার ৯৬৫ জনের। মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৫০।

বর্তমানে ধারাভিতে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস করছে। পাঁচ বর্গকিলোমিটারের বস্তি এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নোংরা ছোট ছোট পথের গোলকধাঁধা। এখানকার বাসিন্দাদের ৭০ শতাংশেরও বেশি ব্যবহার করে গণশৌচাগার। 

সম্প্রতি দ্য নিউইয়র্কারে ওয়াশিংটনভিত্তিক সেন্টার ফর ডিজিজ ডায়নামিকস, ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিসির পরিচালক রামানন লক্ষ্মীনারায়ণের এক সাক্ষাত্কার প্রকাশিত হয়। বর্তমানে তিনি নয়াদিল্লিতে অবস্থান করছেন। ফোন মারফত দেয়া ওই সাক্ষাত্কারে তিনি জানান, ভারত বর্তমানে মহামারীর একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে। সংক্রমণ পরিস্থিতির দিক থেকে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় দুই সপ্তাহ পিছিয়ে রয়েছে। ইতালির তুলনায় চার সপ্তাহ।

তিনি বলেন, মুম্বাইয়ের বস্তি এলাকায় এরই মধ্যে সংক্রমণ শনাক্ত হতে শুরু করেছে। ধরনের নগর এলাকাগুলোতেই এখন দ্রুত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা সবচেয়ে বেশি এবং প্রশ্নাতীতভাবেই এটি ভারতের নাগরিক জনসংখ্যার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে, যদি না ভাইরাসের প্রভাব বদলে ফেলার মতো মৌলিক কিছু পরিবর্তন এখানে থেকে থাকে এবং ধরনের পরিবর্তন বিদ্যমান থাকার কোনো প্রমাণও পাইনি আমরা।

এসব জনবহুল দারিদ্র্যপীড়িত এলাকাগুলোই এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য সামাজিক বিচ্ছিন্নতার নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ। কভিড-১৯ মোকাবেলায় সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কথা বলা হলেও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিষয়টি একেবারেই অসম্ভব, বিশেষ করে বস্তিবাসীর জন্য। বাংলাদেশের বস্তিগুলোর অধিকাংশ ঘরই ছোট আয়তনের টিনের ছাউনি বা বাঁশের বেড়ায় নির্মিত। এসব ঘরে গাদাগাদি করে বাস করছে তিন-পাঁচজন করে ব্যক্তি। আলাদা শৌচাগার সুবিধা নেই এখানেও।

দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের বেঁচে থাকার জন্য তাদের কাজকর্ম চালু রাখাটা খুবই জরুরি। কাজ না থাকলে দরিদ্র পরিবারগুলোর আয় বন্ধ। আর আয় বন্ধের অর্থ হলো পরিবারের সদস্যদের খেয়েপরে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তাটুকু বন্ধ হয়ে পড়া। কারণেই করোনা সংক্রমণের ভয় থাকলেও বাড়ি থেকে বেরোনো ছাড়া আর কোনো গতি নেই দরিদ্র মানুষের।

নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় গত সপ্তাহেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশটিতে সর্বাত্মক লকডাউনের ঘোষণা দেন। কিন্তু বর্তমানে লকডাউনের ফলে দেখা দিয়েছে আরেক ধরনের মানবিক সংকট। এখানকার দারিদ্র্যপীড়িত কোটি কোটি মানুষের আয়-উপার্জন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে লকডাউনের কারণে। ফলে লকডাউনের মধ্যেও ঘর থেকে বেরোতে চাইছেন ভারতের শ্রমজীবীরা। কোনো কোনো স্থানে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষও ঘটছে।

ভারতের অকৃষি খাতে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা ৫০ কোটি। এর ৯০ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। নির্মাণ খাত, ফুড ভেন্ডর, রিকশা চালানোসহ নানা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন এদের অনেকেই। কিন্তু এদের জন্য বেঁচে থাকাটাকেই এখন মুশকিল করে তুলেছে লকডাউন।

আনন্দ (ছদ্মনাম) নামে এক আদিবাসী সম্প্রদায়ের ব্যক্তি বাস করছেন মহারাষ্ট্রের নাগপুরের এক বস্তিতে। লকডাউনের শুরু থেকেই কাজে যেতে পারছেন না তিনি। অথচ দিনমজুরি করেই জীবিকা নির্বাহ করছিলেন তিনি। যে বস্তিতে বাস করছেন তিনি, সেখানে পরিষ্কার পানি বা সাবান কোনোটিই নিয়মিত পাওয়া যায় না। আনন্দের জীবনে এখন বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কভিড-১৯। তার চেয়েও বড় উদ্বেগের কারণ হলো ক্ষুধা।

গত সপ্তাহেই বিদ্যমান বিভিন্ন স্কিমের আওতায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নগদ অর্থ সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। একই সঙ্গে বয়স্ক, বিধবা শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের তিন মাসের ভাতা অগ্রিম পরিশোধের ঘোষণা দিয়েছে দিল্লি।

ঘোষণার দুদিনের মাথায় একটি নাগরিক সহায়তা জরুরি পরিস্থিতিজনিত ত্রাণ কার্যক্রম (পিএম কেয়ারস) চালু করেন নরেন্দ্র মোদি। বিভিন্ন রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকেও ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, যার আওতায় দরিদ্রদের নগদ সহায়তা বিনা মূল্যে খাদ্য বিতরণ করা হবে। কিন্তু এসব পদক্ষেপ একেবারেই অপ্রতুল। কোনো কোনোটি সুবিধাভোগীদের হাতে পৌঁছানো হচ্ছেও খুব ধীরে।

এছাড়া দেশটির নগর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই হলো ভারতের অন্যান্য স্থান থেকে আসা শ্রমজীবী। কারণে বিদ্যমান স্কিমগুলোর আওতায় সহযোগিতা পেতে নিজেদের নাম তালিকাভুক্ত করতে পারেননি তারা। ফলে স্থানীয় এনজিও বা অন্য কোনো উপায়ের ওপর নির্ভর করেই বর্তমানে বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাদের। আনন্দও বর্তমানে একটি এনজিওর ওপর নির্ভরশীল। তার ছয় সদস্যের পরিবারের জন্য সম্প্রতি এনজিওটি থেকে ছোট ব্যাগভর্তি খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর পরিমাণও এতটাই অপ্রতুল, আনন্দের কাছে তা পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়।

বাংলাদেশেও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরতদের নিয়ে তৈরি হয়েছে বড় ধরনের শঙ্কা। বিবিএসের তথ্য বলছে, দেশে মোট কর্মসংস্থানের মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত কর্মী রয়েছেন প্রায় ৮৫ শতাংশ। দৈনিক, চুক্তিভিত্তিক মজুরি নিয়োগপত্র ছাড়াই কাজ করছেন তাদের বড় একটি অংশ। মুদি কিংবা বিভিন্ন দোকানে কাজ করার পাশাপাশি এদের বড় একটি অংশ নিয়োজিত পরিবহন, বন্দর, নির্মাণ আবাসন এবং হাটবাজারে। সব মিলিয়ে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ বা দিনমজুরি করছেন প্রায় দুই কোটি শ্রমিক, যারা এখন পুরোপুরি বেকার। তাদের জীবনযাত্রা এরই মধ্যে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

পরিস্থিতির প্রতিফলন এরই মধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। ইদানীং ঢাকার রাস্তাঘাটে বেশকিছু মানুষকে ত্রাণের আশায় বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। বিত্তবানদের দেয়া ত্রাণের জন্য ফুটপাতে দীর্ঘ প্রতীক্ষায় বসে থাকতে হয় তাদের। মাঝে মধ্যে পথচলতি দু-একটি গাড়ি থেমে টুকটাক কিছু টাকাপয়সা বা ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করে যায় ঠিকই। কিন্তু সে সময় অপেক্ষারত দরিদ্রদের ভিড় আর হুড়োহুড়ি পড়ে যাচ্ছে ব্যাপক আকারে। চলমান কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে দৃশ্যটি আতঙ্কজনক, সন্দেহ নেই। কিন্তু ত্রাণের জন্য অপেক্ষারত ওইসব মানুষের আর কোনো উপায়ও নেই। কারণ চলমান পরিস্থিতিতে তাদের কোনো কাজ নেই, আয়ও নেই। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাও নানা পরিসরে ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়েও যা মিলছে, তা একেবারেই যৎসামান্য।

করোনার কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় দরিদ্রতা যে একটি ইস্যু হবে, তা এরই মধ্যে দৃশ্যমান বলে মনে করছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, করোনার সূত্র ধরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এক ধরনের স্থবিরতা এসেছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী যারা রয়েছে, তাদের অবস্থা সংকটপূর্ণ হবে। সেই সঙ্গে নতুন দরিদ্রও কিছু তৈরি হতে পারে। সবই নির্ভর করছে সংকট কতদিন স্থায়ী হবে এবং অর্থনীতি কত তাড়াতাড়ি গতি ফিরে পাবে, তার ওপর। কিন্তু সব পূর্বাভাস বলছে, স্বল্পকালীন হলেও একটা অর্থনৈতিক সংকট আসবে। সুতরাং তার জন্যই প্রস্তুত হওয়া ভালো।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন