বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বাড়ছে

শামীম রাহমান

যকৃতের জটিলতায় ভুগছিল খুলনার স্কুলছাত্র রিফাত। মঙ্গলবার (৩১ মার্চ) দুপুরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। স্বজনরা সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে যান খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসক নেই বলে ফিরিয়ে দেয়া হয় সেখান থেকে। খালিশপুর ক্লিনিক, সার্জিক্যাল হাসপাতাল আর ময়লাপোতা হাসপাতালকোথাও মেলেনি চিকিৎসা। সন্ধ্যায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ছোট্ট রিফাত।

মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা আলমাছ উদ্দিনের। ঘটনাটি ২৮ মার্চ সকালের। তখনই শুরু হয় চিকিৎসার জন্য স্বজনদের ছোটাছুটি। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে রাজধানীর ছয়টি হাসপাতালে গেলেও কোনোটিই ভর্তি নেয়নি। রাতে মুগদা জেনারেল হাসপাতালের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ ওয়ার্ডে জায়গা মেলে। সেখানে তাত্ক্ষণিকভাবে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়নি। অনেকটা বিনা চিকিৎসায় পরদিন সকালে মারা যান আলমাছ উদ্দিন।

নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে হতো সিলেট নগরীর হাউজিং এস্টেটের বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিনকে (৬৫) গত ১৫ মার্চ ডায়ালাইসিসের জন্য তাকে সিলেট কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালে নেয়া হয়। সে সময় কিছুটা শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন তিনি। একদিন আগে তার ছেলে যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে শুনে ডায়ালাইসিস না করে তাকে বাড়িতে থাকার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। পরে সিলেটের আরো কয়েকটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিসের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন গিয়াস উদ্দিনের স্বজনেরা। চিকিৎসা না পেয়ে ২৪ মার্চ মৃত্যু হয় তার।

করোনার উপসর্গ থাকায় এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় নোয়াখালীতে দুজন, নওগাঁয় একজন, বগুড়ায় একজন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন, পুরান ঢাকায় একজন, ঢাকার মিরপুরের টোলারবাগে একজন চাঁদপুরের এক ব্যবসায়ীর ঢাকায় মৃত্যুর খবর দিয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যম। জ্বর-সর্দি-কাশির মতো উপসর্গ থাকলেই রোগীদের ফিরিয়ে দিচ্ছে বা ঢাকায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে দেশের বেশির ভাগ হাসপাতাল-ক্লিনিক।

রোগীর স্বজনরা যখন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে চিকিৎসা না করার অভিযোগ তুলছেন, তখন উল্টো রোগী বা তাদের স্বজনদেরই দোষারোপ করছেন চিকিৎসকরা। বিষয়টি সম্পর্কে একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেছে বণিক বার্তা। তারা জানিয়েছেন, করোনার উপসর্গ থাকলে তাদের কী করতে হবে, তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা সরকার দিয়েছে। কোথায় যোগাযোগ করতে হবে, কীভাবে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবেসব তথ্যই উন্মুক্ত। তার পরও এসব উপসর্গ নিয়ে মানুষ যখন করোনা চিকিৎসায় প্রস্তুত নয় এমন হাসপাতালে আসেতাহলে তাদের ফিরিয়ে দেয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এক সপ্তাহ ধরে প্রায় প্রতিদিনই করোনার উপসর্গ নিয়ে চার-পাঁচজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। কোনো কোনো দিন মৃত্যুর সংখ্যাটি আটজন পর্যন্ত ছিল। যদিও আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানিয়েছেন, করোনার উপসর্গ নিয়ে যারা মারা গেছেন, পরীক্ষার পর তাদের কারো শরীরেই করোনাভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়েনি।

করোনাভাইরাসের কারণে কেবল বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনাই ঘটছে না, হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোয় সাধারণ চিকিৎসাও মিলছে না বলে অভিযোগ রোগীদের। মহাখালীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যান্সার রিসার্চ অ্যান্ড হসপিটালে গতকাল নিয়মিত কেমোথেরাপি দেয়ার তারিখ ছিল ঢাকার এক গণমাধ্যম কর্মীর মায়ের। দুদিন আগে হাসপাতাল থেকে কেমো নিতে তাদের আসতে নিষেধ করে দেয়া হয়। শুধু ঢাকার এই ক্যান্সার হাসপাতাল নয়, সারা দেশেই রোগীদের নিয়মিত সেবা বন্ধ করে দিয়েছে অসংখ্য বেসরকারি ক্লিনিক।

সিলেটের একটি বেসরকারি হাসপাতালে গত ২৪ মার্চ অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ভর্তি করাতে গিয়েছিলেন দক্ষিণ সুরমার বাসিন্দা আব্দুল মজিদ। তবে রোগীকে ভর্তি করেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালে স্ত্রীকে ভর্তি করেন তিনি। ২৭ মার্চ একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেন আব্দুল মজিদের স্ত্রী। করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর সিলেটে এমন ঘটনা বেড়েছে।

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় জানিয়েছেন, সম্প্রতি অন্তঃসত্ত্বা রোগীর চাপ বেড়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন নারী আমাদের এখানে ভর্তি হচ্ছেন, যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।

ক্লিনিকগুলোর নিয়মিত সেবা বন্ধের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সিলেট প্রাইভেট মেডিকেল অ্যান্ড ডায়াগনোস্টিক সেন্টার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ডা. নাসিম আহমদ বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা তো রোগীদের সেবা দিতেই চাই। কিন্তু আমাদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) নেই। অবস্থায় রোগীর কাছে যাওয়া চিকিৎসকদের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। রোগী, চিকিৎসক, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সবার জন্য একটি অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হয়েছে।

দেশে কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী প্রথম শনাক্ত হয় গত মার্চ। এরপর থেকেই রোগী ভর্তির ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থানে চলে যায় হাসপাতালগুলো। সর্দি-কাশি-জ্বর কিংবা শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গের রোগীদের ফিরিয়ে দিতে শুরু করে একের পর এক হাসপাতাল। শুধু করোনাভাইরাসের উপসর্গ নয়, নিয়মিত সেবাও বন্ধ করে দিয়েছে অনেক সাধারণ বিশেষায়িত হাসপাতাল।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ক্লিনিক) আমিনুল হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা না পাওয়ার দু-একটি ঘটনার কথা আমরা জেনেছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলছি। ভবিষ্যতে ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন