রেশনিং পদ্ধতিতে চলছে চট্টগ্রাম বন্দর

রাশেদ এইচ চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরো

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্যের ডেলিভারি সীমিত হয়ে আসায় এবার বড় ধাক্কা লেগেছে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরটির মূল পরিচালন (অপারেশনাল) কার্যক্রমে। গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় জেটিতে আসা জাহাজ থেকে মাত্র হাজার ৭০০ কনটেইনার নামানো সম্ভব হয়েছে। যদিও স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন কমপক্ষে চার হাজার কনটেইনার নামানো হয়।

নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বাণিজ্যিক অচলাবস্থার মধ্যে বাধ্য হয়েই রেশনিং পদ্ধতিতে অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। রেশনিং পদ্ধতি হলো, প্রতিটি জাহাজ কতটুকু পণ্য নামাতে পারবে, তা নির্ধারণ করে দেবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ জেটিতে ভেড়ার পর একটি জাহাজ থেকে চাইলেও সব পণ্য নামানো যাবে না। এক্ষেত্রে বন্দর থেকে যে পরিমাণ কনটেইনার ডেলিভারি হবে, ঠিক সেই পরিমাণ কনটেইনার জাহাজ থেকে নামানোর অনুমতি দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বন্দরের ইয়ার্ডে স্থান সংকুলান না হওয়ায় রেশনিং পদ্ধিতে জাহাজ থেকে কনটেইনার নামানো হলেও এর আওতায় নেই রেফার কনটেইনার। ফলে রেফার কনটেইনার ডেলিভারি শূন্যে নেমে এসেছে। রেফার কনটেইনার হলো পচনশীল পণ্য রাখার এক ধরনের বিশেষায়িত কনটেইনার, যা একটি ফ্রিজের মতো কাজ করে। বন্দরের অভ্যন্তরে একটি বিশেষ ইয়ার্ডে ধরনের কনটেইনারকে হাইভোল্টেজে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে রাখতে হয়। গতকাল থেকে রেফার কনটেইনার নিয়ে জেটিতে জাহাজ ভিড়লেও স্থান সংকুলান না হওয়ায় জাহাজ থেকে তা নামানো হয়নি। বিশেষায়িত এসব কনটেইনারে করে ওষুধের কাঁচামাল, শিশুখাদ্য, তাজা ফল মাছ হিমায়িত অবস্থায় আমদানি করা হয়।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে হাজার ৬০০টি রেফার কনটেইনার রাখার আয়োজন আছে। স্বাভাবিক সময়ে এখানে গড়ে দেড় হাজার রেফার কনটেইনার থাকে। কিন্তু দেশে লকডাউন পরিস্থিতি শুরু হলে বন্দরের অভ্যন্তরে ধরনের কনটেইনারের সংখ্যা ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে যায়। কারণ সরকারি ছুটিতে বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন রেডিয়েশন টেস্ট বন্ধ থাকায় রেফার কনটেইনার ডেলিভারি শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। রেডিয়েশন টেস্ট না হওয়ায় চট্টগ্রাম কাস্টমসের কর্মকর্তারাও শুল্কায়ন করতে পারছেন না। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ায় গত বুধবার হাজার ৬০০ সংযোগ থেকে মাল্টিফ্ল্যাগের মাধ্যমে নতুন করে ৩০০ রেফার কনটেইনার রাখার ব্যবস্থা করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ফলে হাজার ৯০০টি রেফার কনটেইনার রাখার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

এদিকে বন্দরের অভ্যন্তরীণ অপারেশনাল পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে গতকাল ডিপো অপারেটরদের (প্রাইভেট আইসিডি) চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। চিঠিতে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে কনটেইনারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় কোনোভাবেই স্থান সংকুলান হচ্ছে না। বন্দরের অভ্যন্তরে ডিপোগামী কনটেইনার মজুদ হয়ে আছে। বন্দরের অপারেশনাল কাজে গতিশীলতা আনার জন্য কনটেইনারগুলো জরুরি ভিত্তিতে সরিয়ে নেয়া প্রয়োজন। একই বি/এলের (বিল অব লেডিং) অন্তর্ভুক্ত সব কনটেইনার যাতে একসঙ্গে বন্দর থেকে বের করা যায়, সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের ভেসেল অপারেশনস, ইয়ার্ড অপারেশনসহ আমদানি কনটেইনার অপারেশন পরিচালনা ধরে রাখতে ডিপোগুলোর উদ্দেশ্যে পড়ে থাকা কনটেইনার বন্দর থেকে দ্রুত স্থানান্তর করতে বলা হয়েছে চিঠিতে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, বন্দর থেকে কনটেইনার ডেলিভারি বাড়াতে না পারায় জেটিতে অপারেশনাল কার্যক্রমে ধাক্কা লেগেছে। এটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। আমরা এরই মধ্যে অপারেশনে পরিবর্তন এনেছি। এছাড়া বিশেষ উদ্যোগে লোড কনটেইনারগুলো স্থানান্তর করতে সব অফডকে চিঠি দেয়া হয়েছে। ওভারফ্লো ইয়ার্ডে কিছু কনটেইনার স্থানান্তর করা যায় কিনা তারও চিন্তাভাবনা চলছে। আনুষ্ঠানিকভাবে সভা করা না গেলেও পরিস্থিতি ভালো করতে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

প্রাইভেট আইসিডি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) তথ্যমতে, বর্তমানে ১৯টি অফডকে কনটেইনার রাখার ধারণক্ষমতা ৬৫ হাজার একক। কনটেইনার সহজে মুভ করার জন্য যেখানে আদর্শ মান অনুযায়ী ১৫-২০ শতাংশ জায়গা খালি রাখতে হয়, সেখানে সব অফডক মিলে বর্তমানে কনটেইনার জমে গেছে প্রায় ৬২ হাজার একক। বন্দর দিয়ে আসা মোট ৩৮ ধরনের আমদানি পণ্য রাখা হয় অফডকগুলোয়। আবার রফতানি কনটেইনারও রাখা হয় এসব অফডকে।

বিকডার সচিব রুহুল আমিন সিকদার বণিক বার্তাকে বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের চিঠি দিয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর যে সমস্যার মুখোমুখি, আমরাও তো একই সমস্যায় আছি। বর্তমানে অফডকগুলোয় থাকা কনটেইনার আমদানিকারক বা রফতানিকারকরা নিয়ে না গেলে নতুন করে কীভাবে কনটেইনার রাখা যাবে? এর মধ্যে জনবল সংকট প্রকট হয়েছে। যেখানে চারজন কাজ করার কথা, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে একজন কর্মী। সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে যারা আসছে, তারাও পরিবহন থেকে শুরু করে পদে পদে কঠিন পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে।

এদিকে বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আমদানিকারকদের সমস্যার বিষয়টি বিচেনায় নিতে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে ব্যবসায়ীদের সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি। চিঠিতে চলমান পরিস্থিতিতে আমদানিকারকসহ ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে অস্তিত্ব রক্ষায় সহায়তা চাওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বরেন, বর্তমান পরিস্থিতির কারণে অনেক আমদানিকারক তাদের আমদানি করা পণ্য বন্দর থেকে ছাড় করাতে পারছেন না। বন্দর সচল রাখতে প্রয়োজনে আলাদাভাবে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন কাস্টমস ক্লিয়ারিং চালু থাকলেও আমদানি করা ভোগ্যপণ্য, বিভিন্ন ফলমূল ইত্যাদি বন্দর থেকে ছাড় করাতে হলে এসব পণ্যের মধ্যে কোনো প্রকার জীবাণু আছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য কোয়ারেন্টিন রেডিয়েশন পরীক্ষা করতে হয়। কিন্তু বর্তমানে সাধারণ ছুটি চলায় এসব পরীক্ষা হচ্ছে না। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি হওয়া বিপুল পরিমাণ পণ্য আটকে আছে। এসব পণ্য ছাড় করার লক্ষ্যে কোয়ারেন্টিন রেডিয়েশন পরীক্ষা দ্রুত সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিতে হবে। আমদানিকারকদের সহায়তা করার লক্ষ্যে মার্চ-মে পর্যন্ত বন্দরের সমুদয় চার্জ মওকুফসহ বিভিন্ন অফডক শিপিং এজেন্টের ওয়্যার ফেয়ার চার্জ মওকুফ করার আহ্বান জানিয়েছি সরকারের কাছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন