চট্টগ্রাম
জেলায় বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, চাকরি প্রভৃতি কারণে বহুবার কক্সবাজার গেছি। আমার এক খালারও সেখানে বিয়ে হয়েছে। তাই ছেলেবেলা থেকেই বারবার সেখানে গেছি বিশেষত সমুদ্রসৈকতে। কিন্তু দেশের বিভিন্ন নদীতে এবং সুন্দরবনের ইরাবতী ডলফিনের কথা জানা থাকলেও কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ডলফিনের কথা এই প্রথম শুনলাম। জানি না আদৌ সংবাদটি সত্য কিনা। আজকাল ভুয়া সংবাদ, ফটোশপ—সব মিলিয়ে এমন একটা সময় এসেছে যে মাঝে মাঝে নিজেকেও অবিশ্বাস হয়! যদি সংবাদটি ঠিক হয়ে থাকে, কোথায় ছিল তারা এতদিন? কেনইবা ফিরে এল আবার? করোনাভাইরাসের কারণে সমুদ্রসৈকত এখন ফাঁকা, জনমানবশূন্য। তাই কি তারা ফিরে এসেছে? এছাড়া আর তো কোনো কারণ দেখি না। ডলফিন তো জলের প্রাণী। সমুদ্র তো ডলফিনের বাসস্থান। আর সমুদ্রসৈকত আমাদের বেড়ানোর স্থান। ওরা তো জলের দেশের নাগরিক। আমরা কেবলই পর্যটক। তবে কি প্রতিকূল পরিবেশে পর্যটকদের ভয়ে নাগরিকরা দূরে সরে গিয়েছিল। এখন অবস্থা স্বাভাবিক হতেই ফিরে এসেছে। জানান দিচ্ছে, এটা আমাদেরই আবাস। আমাদের খেলার জায়গা!
সবকিছু
নতুন লাগে
কেবল
কক্সবাজারেই নয়, আমাদের আশপাশেও আমরা সবাই নতুন কিছু দেখছি। সাবেক সহকর্মী শরফুল আলম লিখেছে, ‘আজ
বিকালে ওষুধের দোকানে যেতে হয়েছিল। কতদিন পর ঢাকার আকাশ নীল হয়েছে দেখলাম।’ শরফুল আলম একা নয়। আমরা সবাই নতুন কিছু দেখছি, জানছি। বাইরে বেরোনোর ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে সকালে এখন ছাদের ওপর হাঁটি। সেদিন দেখলাম গাছে নানা রকম পাখপাখালি। আগে কেবল কাক আর কদাচিৎ শালিক দেখেছি। আজ বেশ কয়েক স্কোয়াড্রন ছোট চড়ুই মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। সবুজ টিয়া সবুজ পাতার সঙ্গে মিশে আছে। মাঝে মাঝে কার্নিশে এসে বসছে। আমাকে দেখেও আর ভয় পাচ্ছে না। তবে কি মানবজাতির নপুংসকতার খবর এরই মধ্যে তাদের কাছে পৌঁছে গেছে? আচ্ছা, ধূসর ও কালোয় মেশানো ঝুঁটিওয়ালা পাখির নাম কী? এমনকি বকও দেখলাম, আরো সব নানা বর্ণের, ধ্বনির ও আকারের পাখি দেখলাম। যাদের সবার নামও আমি জানি না। কোথায় ছিল এরা এতদিন। আগেও বহুবার ছাদে হেঁটেছি। এদের তো কখনো দেখিনি। কেনইবা ওরা আবার বের হলো? তাদের বের হওয়ার জন্য আমাদের অন্তরীণ হওয়া কি আবশ্যক? নাকি বাস্তুচ্যুত মাছ, পশু-পাখিরা আমাদের ঠেলে ঘরের ভেতর পাঠিয়েছে?
শুধু
মাছ, পাখপাখালি কেন, চিরচেনা গাছগুলোকেও নতুন লাগছে। আমাদের অন্তরীণ হতে দেখে ওদেরও কি স্বস্তি লাগছে? আমাদের নাগরিক জীবনের কালো ধোঁয়া, নানা বর্জ্যমুক্ত হওয়াতেই কি বৃক্ষদের আনন্দ? টবের ফুলগুলো এবং ওদের পাতারাও কেমন যেন ষোড়শী তরুণীর মতো উচ্ছল! ধরিত্রী কি কেবলই আমাদের? ডলফিনের, পাখপাখালি, বৃক্ষ, তরুলতা, আর অন্য জীবজন্তুর নয়? আমরা কি কেবল কাক, মশা, ইঁদুর, নেড়ে কুকুর আর কালো বিড়ালের সঙ্গে থাকব? সহজ এ প্রশ্নগুলোর জবাব আমার জানা নেই? আপনারা কেউ জানেন কি?
বাড়ির
পাশের মানুষ
শুধু
মাছ, পাখপাখালি, অন্য জীবজন্তু কেন, আমাদের আশপাশের নিত্যদিনের মানুষগুলোর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ কতটা? মাথার চুলগুলো বড় ও অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। সেলুনে যাওয়া সম্ভব নয়। সেলুন খোলা কিনা তাও জানি না। বাসায় ছেলে ফাহমিদের দেয়া একটা বিয়ার্ড ট্রিমার আছে। ভাবলাম স্বাবলম্বী হই। নিজেই নিজের চুল কাটতে লাগলাম। যা হওয়ার তাই হলো। এক জায়গায় মাথার চামড়া দেখা যায়। ক্ষ্যান্ত দিলাম।
আজ সকাল থেকে আরেক বিপত্তি। টয়লেটের ফ্ল্যাশ কাজ করছে না। অন্য সময় হলে সেলুনে গিয়ে চুল কেটে আসতাম। প্লাম্বারকে খবর দিতাম। বাড়িতে এসে ঠিক করে দিত। অন্তরীণাবস্থার কারণে বাইরে যাওয়া কিংবা ঘরে কাউকে ডাকা সম্ভব নয়। আমাদের নাগরিক জীবন এসব নাপিত, পাইপ, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, সুইপারের সঙ্গে কত ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা কেবল সেবার বিনিময়ে তাত্ক্ষণিক পয়সা দিয়েই খালাস! চিন্তা হলো, যে লোকটি আমার চুল কাটত, সে কেমন আছে? কীভাবে তার সংসার চলছে? এমন অবস্থায় আছে কত মানুষ। রেস্টুরেন্ট ওয়ার্কার, রিকশাচালক, দিনমজুর, ভাসমান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, আরো কতজন! যাদের বাদ দিয়ে আমাদের নাগরিক জীবনযাপন অসম্ভব। রাষ্ট্র, বাঘা রাজনীতিবিদ, বিশাল ব্যবসায়ী, দাপুটে আমলারা কেউ তাদের দেখবেন না। তো তাদের দেখবে কে?
স্বাস্থ্য
ও শিক্ষাসেবা
‘ছোটলোকদের’
কথা না হয় বাদই দিলাম। নিজেদের ঘরের মানুষের কথাই বলি। চিকিৎসকরা তো আমাদেরই সন্তান, কারো ভাইবোন ইত্যাদি। কয়েক দিন ধরে ফেসবুকে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) নিয়ে কথা হচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, পিপিই ছাড়া কীভাবে তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা করবেন? তাহলে তারা তো নিজেরাই আক্রান্ত হবেন। এরই মধ্যে জানা গেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে গিয়ে বহু চিকিৎসক, নার্স ও অন্যরা আক্রান্ত হয়েছেন এবং অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, এখনই পিপিইর দরকার নেই। চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবীকে শাসানো হয়েছে, তারা যদি করোনাভাইরাস রোগীদের সেবা দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন তাহলে মিলিটারি পুলিশকে খবর দিতে! পরে অবশ্য হইচইয়ের মুখে আদেশটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। অত্যন্ত প্রভাবশালী গার্মেন্ট মালিকরা তাদের শ্রমিকদের বেতনের নাম করে ৫ হাজার কোটি টাকা সহায়তা আদায় করে নিয়েছেন। আচ্ছা, আর অন্য যেসব শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, সেসব কারখানার মালিকরা কীভাবে তাদের শ্রমিকদের বেতন দেবেন? আর চিকিৎসকদের পেশাগত নিরাপত্তার সামগ্রী, চিকিৎসাসামগ্রী ক্রয়, আইসিইউ, নতুন হাসপাতাল নির্মাণের জন্য বরাদ্দ থাকবে না কেন? চিকিৎসকরা তো শুল্কমুক্ত গাড়ি, থোক বরাদ্দ, বিনা ভাড়ার বাসস্থান সুবিধা চাননি। তারা আমাদের সেবাদানের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণই কেবল চেয়েছেন।
কেবল
চিকিৎসক কেন, শিক্ষকদের অবস্থা আরো করুণ। চিকিৎসকদের তো প্রাইভেট প্র্যাকটিস আছে, ওষুধ
কোম্পানি আছে, টেস্ট ল্যাব আছে। শিক্ষকদের তো এসব কিছুই নেই। বিশেষত যারা ঢাকা ও বড় শহরের বাইরে পাঠদান করেন। বড় দায়িত্ব দিলে তাদের পেছনে তো বড় ব্যয়ও করতে হবে। কেবল ফাঁকা বুলিতে কাজ হবে না। সহজ এ প্রশ্নগুলোর জবাব আমার জানা নেই? আপনারা কেউ জানেন কি?
ধরিত্রী
আমাদের সবার
আমাদের
দাপটে ডলফিনরা তাদের আবাস ছেড়ে পালিয়েছিল। পালিয়েছে পশু, পাখপাখালি। বৃক্ষ, তরুলতা শ্বাসরুদ্ধ হয়েছিল। এখন তারা হাঁফ ছেড়ে বের হয়েছে। আমরা কি আবার এ যাত্রা রক্ষা পেলে ঘর থেকে বের হয়ে তাদের তাড়িয়ে দেব? এ করোনাভাইরাস যে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী, রাজপুত্র, পর্দার, মাঠের নায়ক কাউকেই ছাড় দেয়নি, সে কি আমাদের এত সহজেই ছেড়ে দেবে? করোনাভাইরাস হয়তো একদিন নিয়ন্ত্রণে আসবে, কিন্তু সামনে এর চেয়ে ভয়াবহ ভাইরাস থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আছে কি?
উপায়
আছে। তবে প্রথমেই কবুল করে নিতে হবে যে এ ধরিত্রী কেবল আমাদের নয়। এটা ডলফিন, পশু-পাখি, নাপিত, মিস্ত্রি, চিকিৎসক, গার্মেন্ট মালিক সবার আবাসস্থল। তাই নিজেরা বাঁচার পাশাপাশি অন্যদেরও বাঁচার সুযোগ করে দিতে হবে। নিজেদের এমনভাবে বিচরণ করতে হবে, যাতে অন্যদের বিচরণ করতে অসুবিধা না হয়; নিজের আবাস গড়তে গিয়ে যাতে অন্যের নিবাস ভেঙে না পড়ে। নিজেদের ভোগ যেন অন্যের অভুক্ত থাকার কারণ না হয়।
কীভাবে
এটা করতে
হবে
কবুল
করে নিতে হবে যে আমাদের এটা ভোগবাদী সমাজ। তাই সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। আমাদের মোট ভোগের পরিমাণ কমাতে হবে। করোনাভাইরাস সাক্ষী কত কম ভোগে আমাদের জীবন চলে। নিজেদের ভোগের পর এমন অবশিষ্ট রাখতে হবে, যাতে অন্য মানুষ, মাছ, পশু-পাখি, তরুলতার জন্য পর্যাপ্ত অবশিষ্ট থাকে। কেবল নিজেদের ভোগের জন্য বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, বিজলি, পানি ও পয়োনিষ্কাশন, সিনেমা হল, স্টেডিয়াম ও কারখানা গড়ার মারাত্মক নেশা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
ভোগের
বিভাজন পরিবর্তন করতে হবে। মোটাদাগে যদি ভোগকে দুই ভাগে ভাগ করি, সামরিক ও বেসামরিক ভোগ, তাহলে সামরিক ভোগের পরিমাণ কমাতে হবে। ২০১৮ সালে বৈশ্বিক সামরিক ব্যয় ছিল ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। একজন ভালো ক্রেতা হিসেবে আমরা যদি জিজ্ঞেস করি, কী পেলাম এই ভোগ থেকে? আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ভারত, পাকিস্তান কোথাও কি সামরিক ব্যয় আমাদের কিছু দিয়েছে? অর্থহীন এ ভোগ কমাতেই হবে।
আবার
সময় ভোগকে যদি মোটাদাগে দেখি কাজ ও অবসর, তাহলে দেখা যাবে অনর্থক কাজের পেছনে অনেক সময় ব্যয় করছি। ভোগের মোট পরিমাণ কমালে আমাদের কাজের পরিমাণও কমে যাবে। অবসর বাড়বে। পরিবারের জন্য সময় বাড়বে। কই এখন তো বেশির ভাগ মানুষ ঘরবন্দি। পৃথিবী তো ভেঙে পড়েনি? এখন দিনে ২ ঘণ্টা ব্যাংক চললে পরে দিনে ১২ ঘণ্টা ব্যাংক চালাতে হবে কেন? হ্যাঁ হয়তো জিডিপি কমবে। তাতে কী? ওই সংখ্যাটাই তো নষ্টের মূল!
মানুষে
মানুষে ভোগের ব্যবধান কমাতে হবে। আর তাই কাজের ধরন নির্বিশেষে সবার ন্যূনতম আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। আয়ের ব্যবধান কমাতে হবে। একজন বায়োলজিস্ট তো বলেই দিয়েছেন, আপনারা আমাদের মাসে ১ হাজার ৮০০ ইউরো পারিশ্রমিক দেবেন আর একজন ফুটবলারকে দেবেন ১ মিলিয়ন ইউরো! যান, এখন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো বা মেসির কাছে যান, তারা আপনাদের ভাইরাসমুক্ত হওয়ার কৌশল বাতলে দেবেন!
মোট
কথা, বাঁচতে হলে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে।
মুহাম্মদ
ফাওজুল কবির
খান: সাবেক সচিব