উন্নয়ন বৈপরীত্য

হামে আক্রান্ত সাজেকের ‘সৌভাগ্যবান’ শিশুরা!

পাভেল পার্থ

 বছরের ফেব্রুয়ারি থেকেই হাম ছড়িয়ে পড়ে রাঙ্গমাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক এবং বান্দরবানের রুমা লামার পাহাড়ে। ৩০০ শিশু আক্রান্ত এবং নিহত আট। লংথিয়ান পাড়া, কমলাপুর চাকমা পাড়া, নিউথাং পাড়া, তরুণ ত্রিপুরা পাড়া, হাইচ্যা পাড়ার শিশুরা বেশি আক্রান্ত। সাজেক ইউনিয়নের তুইছুই মৌজার অরুণ পাড়ায় ২০ দিনে মারা যায় ছয় শিশু। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সাগরিকা ত্রিপুরা (১১), ১৫ মার্চ দীনেশ ত্রিপুরা ( বছর মাস), ১৬ মার্চ রুজিনা ত্রিপুরা () মারা যায়। ১৭ মার্চ মারা যায় তিনজনকহেন ত্রিপুরা ( বছর মাস), রাকেশ ত্রিপুরা () দেবী ত্রিপুরা (দেড় মাস) ২৩ মার্চ লুংথিয়ান পাড়ার খেতি ত্রিপুরা মারা যায়। ঘটনার পর বাঘাইছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত এলাকায় যান এবং ২৮৫ শিশুকে হামের টিকা দেন। সাজেকের চলমান হাম সংকট মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছে সেনাবাহিনী বিজিবির চিকিৎসক দল। শিয়ালদহ মৌজার লংথিয়ান পাড়ার প্রহিত ত্রিপুরা (), রখেন ত্রিপুরা (), রকেট ত্রিপুরা (), নহেন্দ্র ত্রিপুরা (১০) এবং দীপায়ন ত্রিপুরা (১১)—এই পাঁচ ভাইকে বাঁচাতে সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় চিকিৎসার জন্য। পাশাপাশি তারা অসুস্থ শিশুদের জন্য গুঁড়ো দুধ, বিস্কুট, সুজি, হরলিকসসহ শুকনো খাবারও সরবরাহ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিসহ চিকিৎসক দল এলাকা পরিদর্শন করেছে। সাজেকের হামে নিহত আক্রান্ত শিশুরা অনেক সৌভাগ্যবান। কোনোঅজ্ঞাত রোগনয়, বহুল জ্ঞাত হামেই তারা আক্রান্ত হয়েছেবিষয়টি দ্রুতই সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন। লামা উপজেলার লামা ইউনিয়নের লাল্যা পাড়ায় এক শিশু মারা যায় এবং ৪২ জন আক্রান্ত। ১৬ মার্চ ৩১ শিশু দুজন প্রাপ্তবয়স্ককে ট্রাকে করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করানো হয়। স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রথম দিকে একেঅজ্ঞাত রোগহিসেবে চালিয়ে দেন। হামে নিহত সাজেকের ত্রিপুরা শিশুরা কারণেই সৌভাগ্যবান যে সীতাকুণ্ড পাহাড়ে হামে নিহত ত্রিপুরা শিশুদের মতো তাদের মৃত্যুকে কেউঅজ্ঞাত রোগেরমোড়কে গোপন করার চেষ্টা করেনি। দায়িত্ব মমতার টানে এগিয়ে এসেছে সেনাবাহিনী বিজিবি। সীতাকুণ্ড পাহাড়ের মতো দুর্গম বলে কর্তৃপক্ষ দূরে সরে যায়নি।

.

আমাদের কি স্মরণে আছে কী ঘটেছিল মাত্র তিন বছর আগে সীতাকুণ্ড পাহাড়ে? চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা, পৌর সদর, বারৈয়াঢালা, বাড়বকুণ্ড, সোনাইছড়ি সলিমপুর পাহাড়ে দশটি ত্রিপুরা পাড়া আছে। ২০১৭ সালের থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত সোনাইছড়ি ত্রিপুরা গ্রামের নয়জন শিশু হামে নিহত হয়। থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত সোনাইছড়ি ত্রিপুরা পাড়ার রূপালী ত্রিপুরা (), কসম রায় ত্রিপুরা (১০), কানাই ত্রিপুরা (), জানাইয়া ত্রিপুরা (), হূদয় ত্রিপুরা (), তাকিপতি ত্রিপুরা (১২), রমাপতি ত্রিপুরা (), ফকতি ত্রিপুরা (), শিমুল ত্রিপুরা () হাম নামের একঅজ্ঞাতরোগে নিহত হয়। একের পর এক হামে ত্রিপুরা শিশুরা আক্রান্ত নিহত হতে থাকলে স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রথম দিকে হামকেঅজ্ঞাত রোগহিসেবে আবিষ্কার করেছিলেন। পরবর্তীতে জানা যায়, সীতাকুণ্ড পাহাড়ে কোনো দিন রাষ্ট্রের টিকাদান কর্মসূচির পা পড়েনি। ভাবা যায়, টিকাদান কর্মসূচিতে শতভাগ সফল বাংলাদেশে এখনো পাহাড়ে পাহাড়ে শিশুরা হামের মতো এক সাধারণ রোগে মরে যায়!

.

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড আর রাঙ্গামাটির সাজেক। হামে নিহত ত্রিপুরা শিশুরা প্রমাণ করল রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা কি টিকাদান কর্মসূচি এখনো পাহাড়বিমুখ। আদিবাসীবিমুখ। ১৯৭৯ সাল থেকে দেশব্যাপী সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি শুরু হলেও প্রমাণিত হলো সাজেকের উল্লিখিত আদিবাসী বসতিগুলো এত বছর ধরেই জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির বাইরে ছিল। সীতাকুণ্ডে যখন হামে ত্রিপুরা শিশুরা নিহত হয়েছিল, তখন বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদেরগাফিলতি দায়িত্বে অবহেলা চিহ্নিত করেশাস্তি হিসেবে কয়েকজন স্বাস্থ্যকর্মীকে সন্দ্বীপের উড়কির চরে পাঠানো হয়েছিল। প্রমাণিত হয়েছিল কেবল মাঠ পর্যায় নয়, জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার সব স্তরের দায়িত্বই সেখানে অবহেলিত হয়েছে। সাজেকের সাম্প্রতিক হাম সংকট ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ন্যায়বিচার হওয়া জরুরি। কারণ যে ত্রিপুরা শিশুরা নির্দয়ভাবে বিনা স্বাস্থ্যসেবায় হামে মারা গেল, তাদের পরিবারের শ্রম-ঘামের উপার্জনের মাধ্যমেই দেশের স্বাস্থ্য খাত চলে। হয়তো হামের পাশাপাশি যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, হেপাটাইসিস বি, পোলিও, রুবেলা ইনফ্লুয়েঞ্জা বি নয়টি রোগের মৃত্যুঝুঁকি থেকেও কি এসব পাহাড়ি গ্রাম নিরাপদ?

.

ত্রিপুরাদের ভেতর আরাঙ্গা লুটিসা খুব পরিচিত শিশুরোগ। আরাঙ্গা মানে জলবসন্ত আর লুটিসা হলো হাম। এসব রোগ নিরাময়ে রয়েছে নানা ত্রিপুরা কবিরাজি। যদিও ত্রিপুরা বৈদ্যদের ব্যবহূত অধিকাংশ ভেষজ এখন সাজেক পাহাড়ে বিরল। নানাভাবে সামনে এসেছে সাজেকের হামে নিহত আক্রান্ত ত্রিপুরা শিশুরা খাদ্যহীনতা অপুষ্টিতে ভুগছে। কিন্তু এর কারণ কী? ২০১৫ সালের মে মাসেও সাজেকে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে সাতজনের করুণ মৃত্যু ঘটে। ২০১৭ সালের এপ্রিলে এই সাজেকেই তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেয় এবং ৫০টি পাহাড়ি গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার আদিবাসী দুঃসহ খাদ্য যন্ত্রণা পাড়ি দেয়। এখনো সাজেক ইউনিয়নের উদোলছড়ি, নতুনজৌপুই, পুরান জৌপুই, নিউথাংমাং, নিউলংকর, ব্যাটলিং পাড়া, ব্যাটলিং তারুং পাড়া, কমলাপুর, লংত্যাং, অরুণ পাড়া, কাছ্যা পাড়া, শিয়ালদাই, গণ্ডাছড়া, থলছড়া, এগাজ্যাছড়ি, মোনআদাম, ধাবআদাম, কলকপাড়া, বাদলছড়ি, নিমুই পাড়া, হাগড়াকেজিং, দুলুছড়ি, দুলবন্যা গ্রামে খাদ্যসংকট চলছে। জুম সংগ্রহের ওপর নির্ভরশীল এসব পাহাড়ি নাগরিকের খাদ্য সংকট মার্চ থেকে আগস্ট অবধি চলে। সেপ্টেম্বরের শেষে জুমের ফসল তোলার পর খাদ্যাভাব কিছুটা কমে। ২০১২ সালে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি জুরাছড়ি উপজেলা এবং বান্দরবানের থানচি রুমা এলাকার পাহাড়ে খাদ্য সংকট দেখা দেয়, যা দুই বছর স্থায়ী হয় এবং অধিপতি রাষ্ট্রের প্রবলভাবে অনালোচিত পাহাড়ি খাদ্য সংকটের কারণে অনেক পরিবার নিজ গ্রাম থেকে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়। জুমের ওপর নির্ভরশীল ত্রিপুরাদের সাজেক পাহাড়ে নিজস্ব জায়গা-জমিন সবই তো দখল হয়েছে, দখল হয়ে যাচ্ছে। একের পর এক গড়ে তোলা হচ্ছে দশাসই সব করপোরেট পর্যটন উন্নয়ন প্রকল্প। পাহাড়ের বাস্তুসংস্থান প্রতিবেশ জুম-কৃষির জন্য এখন যথেষ্ট নয়। কিছুটা জুম আবাদ, দিনমজুরি আর খেয়ে না খেয়েই দিন চলছে সাজেকের ত্রিপুরাদের। জীবন নিয়ে টিকে থাকার উৎপাদন অস্তিত্বের এসব মৌলিক প্রশ্ন তো কেউ তুলছে না? কেবল টিকাদান কর্মসূচি শতভাগ সফল করে তুললেই কি সাজেক পাহাড়ে শিশুদের স্বাস্থ্যগত সংকট দূর হয়ে যাবে? আত্মপরিচয়ের সীমানা চৌকাঠ যখন নানাভাবে চুরমার, তখন কীভাবে সাজেক কি সীতাকুণ্ডে একজন ত্রিপুরা শিশু সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে?

.

সীতাকুণ্ড পাহাড়ে যখন হামের সংক্রমণ ঘটেছিল, তখন ঢাকা কাতরাচ্ছিল চিকুনগুনিয়ার মতো এক নতুন রোগে। আবার সাজেক পাহাড়ে যখন হাম হানা দিল, তখন কেবল দেশ নয়, বিশ্ব লড়ছে করোনা সংকট মোকাবেলায়। করোনার কালে আমাদের পাহাড়ি অঞ্চলের শিশুরা যদি হামেই আক্রান্ত হতে থাকে, তবে করোনার ঝুঁকি তাদের জন্য আরো বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। এটি কেবল একটি পাহাড়ের বিষয় তখন থাকবে না, সংকট সংক্রমিত হবে দেশময়। সাজেকের হাম সংকট মোকাবেলায় দ্রুত নিরপেক্ষ তদন্ত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। নিহত শিশুদের পরিবার আক্রান্ত পরিবারগুলোর দেখভালের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আশা করি, রাষ্ট্র সাজেক পাহাড়ের দিকে সমতার চোখেই তাকাবে। বাঘাইছড়ি দেশের বৃহত্তম উপজেলা। সাজেক বড় ইউনিয়ন। প্রায় ৬০৭ বর্গকিলোমিটার এই পাহাড়ি এলাকা এখন দেশের এক অন্যতম পর্যটনস্থল। দেশের এই অনন্য বৈশিষ্ট্যময় পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে খাদ্যহীনতা কি স্বাস্থ্যগত সংকটের এমনতর কত করুণ রক্তক্ষরণ বয়ে চলেছে। দারুণ ভ্রমণপ্রিয় হুল্লোড়ে মাতোয়ারা পর্যটক হিসেবে আমরা কি কোনোদিন তা টের পাই?

 

পাভেল পার্থ: গবেষক লেখক

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন