পণ্যের স্তূপ জমছে চট্টগ্রাম বন্দরে

রাশেদ এইচ চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরো

চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার (প্রতিটি ২০ ফুট দীর্ঘ) ধারণক্ষমতা ৪৫ হাজার একক। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে পণ্যের ডেলিভারি অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় বর্তমানে সেখানে জমে আছে ৪০ হাজার একক কনটেইনার। অথচ বন্দর থেকে প্রতিদিন বের হচ্ছে মাত্র ৫০০ একক। পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী দুদিনে ধারণক্ষমতা অতিক্রম করে যাবে বন্দরে পণ্যের স্তূপ। 

চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে চার হাজার কনটেইনার ডেলিভারি হতো। পণ্য আনা-নেয়ার কাজে কাভার্ড ভ্যান, লরি, ট্রাক মিলিয়ে প্রায় সাত হাজার গাড়ি বন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করত। এখন সংখ্যা এক হাজারের নিচে নেমে এসেছে। বহির্নোঙর জেটিতে হ্যান্ডলিং কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকলেও পণ্য বের হতে না পারায় প্রতিদিন সাড়ে তিন হাজার কনটেইনার বন্দরের অভ্যন্তরে জমতে শুরু করেছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, বহির্নোঙর জেটিতে হ্যান্ডলিং কার্যক্রম এখনো ঠিক রয়েছে। কিন্তু বন্দর থেকে পণ্য ডেলিভারি অস্বাভাবিকভাবে কমেছে। শিল্পপণ্যের শুল্কায়ন শুরু হলে আশা করছি বন্দর থেকে পণ্যের ডেলিভারি কিছুটা উন্নতি হবে। 

নভেল করোনাভাইরাস ঠেকাতে দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি চলছে এখন। ছুটির শুরু থেকে দাপ্তরিক কার্যক্রম সীমিত করেছে দেশের সব কাস্টম হাউজ। সময়ে কেবল রফতানি ইপিজেডের কার্যক্রম সচল রাখা, আমদানির ক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, জরুরি চিকিৎসা অন্যান্য সেবাসামগ্রীর শুল্কায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল কাস্টম হাউজগুলো। তবে বন্দরের ডেলিভারি কার্যক্রম পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে ৩০ মার্চ নতুন একটি অফিস আদেশ জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সেখানে শিল্পের কাঁচামাল এবং সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার আমদানি পণ্যের শুল্কায়নে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে কাস্টম হাউজগুলোকে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার মো. ফখরুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় ছুটির সময়েও এখন শিল্পের কাঁচামাল এবং সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার আমদানি পণ্যের শুল্কায়ন হবে। এনবিআর থেকে -সংক্রান্ত আদেশ দেয়া হয়েছে। এজন্য নতুনভাবে দাপ্তরিক কার্যক্রমের পরিসরও বাড়ানো হবে। 

এদিকে এনবিআরের নতুন অফিস আদেশে আমদানীকৃত শিল্পের কাঁচামাল শুল্কায়নের নির্দেশ দেয়া হলেও ব্যবসায়ীরা পণ্য ছাড়করণে এগিয়ে না এলে বন্দরের কনটেইনার জট সহসাই দূর হবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্দরের যে ধারণক্ষমতা তা দুদিনের মধ্যেই সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছালও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কোনো লক্ষণ আপাতত নেই। কারণ কারখানা খোলা না থাকলে পণ্যের শুল্কায়নের অনুমতি দিলেও পণ্যের ডেলিভারি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে বাড়বে না। কারখানা বন্ধ থাকায় পণ্য নিয়ে রাখারও সুযোগ নেই। কারখানার চাকাই যেখানে বন্ধ, সেখানে পণ্যের ডেলিভারি নিয়ে কোথায় রাখা হবে। এর যৌক্তিকতাইবা কী?

দেশের শীর্ষস্থানীয় রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বণিক বার্তাকে বলেন, বন্দরের ডেলিভারি পড়ে গেছে, কারণ কারখানাগুলো পণ্য বুঝে নিচ্ছে না। আর বাস্তবতা হলো কারখানা মালিকরা তো পণ্য ডেলিভারি নেয়ার মতো পরিস্থিতিতেই নেই। রফতানিকারকদের দিক থেকে বলতে পারি, এপ্রিলের যে অর্ডারগুলো ছিল, সে অর্ডারগুলো এখন বায়ারদের পক্ষ থেকে স্থগিত করা হয়েছে। অনেক অর্ডার বাতিলও হয়ে গেছে। পরিস্থিতির শিকার যেসব ব্যবসায়ীর কাঁচামাল বন্দরের অভ্যন্তরে রয়েছে, তারা এসব চালান কোথায় নিয়ে যাবেন। কারখানার কার্যক্রমও বন্ধ। বন্দরের ডেলিভারি খারাপ অবস্থায় যাওয়ার এটাই একটা বড় কারণ বলে মনে করছি। 

করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে অধিকাংশ শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়েছে। ২৬ মার্চ কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত বিবেচনায় নিতে পোশাক শিল্প মালিকদের প্রতি অনুরোধ জানায় বিজিএমইএ। আরেক সংগঠন বিকেএমইএও নিট পোশাক কারখানা মালিকদের প্রতি বন্ধের নির্দেশনা জারি করে। ২৭ মার্চ শ্রম কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কল-কারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) একটি আদেশ জারি করে। রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক ক্রয়াদেশ বহাল রয়েছে এবং করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জরুরি অপরিহার্য পণ্য যেমনপারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই), মাস্ক, হ্যান্ড ওয়াশ, স্যানিটাইজার, ওষুধপত্র উৎপাদনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে, সেসব কারখানার মালিক শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যনিরাপত্তা ব্যবস্থা সুনিশ্চিতকরণ সাপেক্ষে উৎপাদন চালু রাখার নির্দেশনা দেয়া হয় ওই আদেশে। ফলে অধিকাংশ কারখানা বন্ধ থাকায় শিল্প মালিকরাও এখন বন্দর থেকে পণ্য খালাসে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। 

চট্টগ্রাম বন্দরের অন্যতম ব্যবহারকারী বায়েজিদ স্টিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু বকর চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন বিলেট এবং রড মিলিয়ে এক হাজার টন উৎপাদন করি। লকডাউন পরিস্থিতির আগে উৎপাদন তিন শিফট থেকে নামিয়ে এক শিফটে চালু রেখেছিলাম। সেখানে উৎপাদন একেবারেই বন্ধ করে রেখেছি। কর্মীদের বেতন, বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল, ব্যাংক ইন্টারেস্ট সবকিছু সামাল দেয়াটাই তো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া পণ্যের ৭০ শতাংশই ঢাকা আশপাশের অঞ্চলে যায় সড়কপথ ব্যবহার করে। জাহাজ থেকে নামানোর পর এসব পণ্যের সিংহভাগ বন্দর বা ডিপো থেকে কাভার্ড ভ্যান বা ট্রাকে করে সারা দেশে নেয়া হয়। রেলপথ নৌপথে সরাসরি কনটেইনার নিয়ে কমলাপুর ডিপো পানগাঁও নৌ টার্মিনালে খালাস করা হয়। আবার রফতানি পণ্যের ৯০ শতাংশই সারা দেশের কারখানা থেকে কাভার্ড ভ্যানে করে চট্টগ্রামের ১৮টি বেসরকারি ডিপোতে নিয়ে কনটেইনারে ভরা হয়। এরপর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজে তুলে দেয়া হয়। বাকি রফতানি পণ্যবাহী কনটেইনার রেলপথে কমলাপুর ডিপো নৌপথে টার্মিনাল থেকে বন্দরে এনে জাহাজে তুলে দেয়া হয়। এছাড়া রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল থেকে সড়কপথে কনটেইনারে করেও বন্দরে এনে জাহাজে তুলে দেয়া হয়। রফতানি কার্যক্রম কারখানা বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনের এসব ধাপও এখন থমকে আছে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন