সব ধরনের পোলট্রি মুরগি উৎপাদনে প্রতি কেজিতে গড় খরচ প্রায় ৯৫ টাকা। কিন্তু চাহিদা কমে যাওয়ায় সেই মুরগি এখন ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে খামারিদের। একই অবস্থা ডিমের ক্ষেত্রেও। ৫ টাকা ৫০ পয়সা খরচে উৎপাদিত ডিম বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ৪ টাকায়। অন্যদিকে বিক্রিই হচ্ছে না একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা। সব মিলিয়ে বড় ধরনের বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে দেশের পোলট্রি শিল্পে।
নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি চলছে এখন। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে বের হচ্ছে না মানুষ, এমনকি বাজারেও যাচ্ছে না। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে কমে গিয়েছে পোলট্রি মুরগি ও ডিমের চাহিদা। অন্যদিকে বড় মুরগি বিক্রি না হওয়ায় নতুন করে একদিনের বাচ্চা কিনছেন না খামারিরা। ফলে প্রভাবটা গিয়ে পড়েছে মুরগির বাচ্চা উৎপাদনেও।
পোলট্রি খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কয়েকদিনের ব্যবধানে দেশে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে পোলট্রি মুরগির চাহিদা। ফলে বাজারদর কমে গেছে প্রায় ৩৭ শতাংশ। দৈনিক উৎপাদন ৩ হাজার ২৭ টন হলেও অবিক্রীত থাকছে ২ হাজার ১১৯ টন মুরগি।
একই অবস্থা ডিমের ক্ষেত্রেও। দৈনিক ডিম উৎপাদন হচ্ছে ৪ কোটি ৬৬ লাখ পিস। কিন্তু বিক্রি কমে গেছে ৬০ শতাংশ বা প্রায় তিন কোটি পিস। এ অবস্থায় ৫ টাকা ৫০ পয়সা খরচে উৎপাদিত প্রতি পিস ডিম মাত্র ৪ টাকা থেকে ৪ টাকা ২০ পয়সায় বা ২৪ শতাংশ কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে খামারিদের।
পোলট্রি মুরগি ও ডিমের মতো বিক্রি কমেছে এ শিল্পের অন্যান্য খাতেও। করোনাভাইরাসের প্রভাবে একদিন বয়সী বাচ্চা ৯৩ শতাংশ ও পোলট্রি ফিড প্রায় ৭০ শতাংশ বিক্রি কমেছে। এক টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে না মুরগির বাচ্চা। পাশাপাশি পোলট্রি ও ফিশ ফিডের উৎপাদনও প্রায় ৭০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া পোলট্রি প্রক্রিয়াজাত পণ্য বিক্রি কমেছে ৯০ শতাংশের বেশি। সব মিলিয়ে পোলট্রি শিল্পে একটি বিপর্যয়ের শঙ্কা ভর করেছে। এরই মধ্যে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হয়েছে এ খাত। পরিস্থিতি আরো তিন সপ্তাহ চলমান থাকলে ক্ষতি ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি)।
বিপিআইসিসির সভাপতি ও প্যারাগন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মসিউর রহমান এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, পাইকারি বাজার থেকে শুরু করে খুচরা বাজার-হাটে ক্রেতাসাধারণের উপস্থিতি ব্যাপক কমার কারণে সব ধরনের পোলট্রি পণ্য বিক্রিতে ধস নেমেছে। অথচ করোনাভাইরাস মোকাবেলায় মানুষের জন্য সহায়ক হতে পারে পোলট্রি শিল্প। পুষ্টিকর ও প্রোটিন জাতীয় খাদ্য শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং সংক্রমণ প্রতিরোধেও কার্যকর। সেই সক্ষমতা পোলট্রি শিল্পের রয়েছে। সঠিক তথ্য না যাওয়া এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। তাই সরকার কর্তৃক ঘোষিত খাদ্য সহায়তা কার্যক্রমে ডিম, দুধ ও মুরগির মাংস অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কভিড-১৯-বিষয়ক সচেতনতার অংশ হিসেবে এসব পণ্যের ইতিবাচক প্রচার চালানোর সুপারিশ করেন তিনি।
বিপিআইসির তথ্যমতে, একদিন বয়সী বাচ্চা উৎপাদনে নিট খরচ হয় প্রতিটির জন্য ৩৫ টাকা। কিন্তু এ বাচ্চা বিক্রি করতে পারছেন না উৎপাদনকারীরা। সপ্তাহে উৎপাদন ১ কোটি ৮৭ লাখ হলেও ১ কোটি ৭৪ লাখ পিস অবিক্রীত থাকছে। ফলে মোট উৎপাদনের ৯৩ শতাংশই অবিক্রীত থাকছে। এছাড়া পোলট্রি ফিড দৈনিক উৎপাদন হচ্ছে ৯ হাজার ৮৬৩ টন। কিন্তু অবিক্রীত থাকছে দৈনিক ৬ হাজার ৯০৪ টন বা ৭০ শতাংশ।
এ বিষয়ে ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএবি) সভাপতি রকিবুর রহমান টুটুুল বলেন, এক টাকায়ও বিক্রি করতে পারছি না একদিন বয়সী পোলট্রির বাচ্চা। ব্রিডার্স ও হ্যাচারি শিল্পে এরই মধ্যে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও বাজার ও বিপণন ব্যবস্থা স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে আরো ন্যূনতম এক মাস। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ছাড়াতে পারে ২ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে করোনাভাইরাসের প্রভাবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ২০ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত একটি সম্ভাব্য ক্ষতি নিরূপণ করেছে বিপিআইসিসি। এই ১৬ দিনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এর মধ্যে ব্রিডার্স শিল্পে ৪৫৮ কোটি, পোলট্রি ও ফিশ ফিডে ৭৫ কোটি টাকা, বাণিজ্যিক পোলট্রি (ডিম ও মুরগির মাংস) ৫০৩ কোটি টাকা, পোলট্রি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে ৩১ কোটি এবং প্রাণী ওষুধ ৮৩ কোটি টাকা। এ সপ্তাহের মধ্যে যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে দৈনিক প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ফিআব) সাবেক সভাপতি আবু লুেফ ফজলে রহিম খান শাহরিয়ার এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্রয়লার ও ডিম বিক্রি করা যাচ্ছে না। খামারিরা রেডি ব্রয়লার বাজারে আনতে পারছেন না। আবার বাজারেও ক্রেতার সমাগম নেই। তাই এ শিল্পের প্রতিটি শাখা বিশেষ করে নিবন্ধিত ব্রিডার ফার্ম ও হ্যাচারি, বাণিজ্যিক মুরগির খামার, ফিড মিল, ওষুধ প্রস্তুতকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান, কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকের সুদ আগামী ছয় মাসের জন্য মওকুফ করতে হবে। বন্দরে আটকে পড়া কাঁচামালের কারণে যে পোর্ট ড্যামারেজ জমা হচ্ছে, তা পুরোপুরি মওকুফ করতে হবে। পোলট্রির সব খাতের জন্য ৩০ শতাংশ আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে।