শারীরিক বনাম সামাজিক দূরত্ব

সেলিম জাহান

মানবিক বলয়ে যখন ‘দূরত্ব’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, তার একটি নেতিবাচক মাত্রিকতা আছে। প্রায়ই বলি আমরা, ‘তুমি অনেক দূরে সরে গেছো’ কিংবা ‘চিন্তার ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে।’ আর জগন্ময় মিত্রের সেই বিখ্যাত গান, ‘তুমি আজ কত দূরে’ তো আছেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষে মানুষে দূরত্ব মানুষ চায় না, কিন্তু ওই দূরত্বের ব্যাপারটি আবার ফিরে এসেছে জোরেশোরে বর্তমান সময়ের করোনা কিংবা কভিড-১৯ ভাইরাস সংকটকালে।

বারবার বলা হচ্ছে যে এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার অন্য কোনো বিকল্প নেই। সংক্রমণ রোধে এটা অত্যাবশ্যকীয়। পথে-ঘাটে, দোকান-পাটে, বিদ্যালয়-পাঠাগারে অর্থাৎ সামাজিক মেলামেশার প্রতিটি স্থানেই একটি মানুষের সঙ্গে আরেকটি মানুষের ন্যূনতম শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা বড় প্রয়োজন।

এটি নিশ্চিত করার ব্যাপারে রাষ্ট্রের যেমন একটি বিরাট সামষ্টিক ভূমিকা আছে, তেমনি ব্যক্তিমানুষেরও। রাষ্ট্র মানুষকে নৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত করতে পারে, প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন করতে পারে এবং সে আইন প্রয়োগও করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে, যদি ব্যক্তিমানুষ দায়িত্বশীল না হয়, তাদের নিজেদের দায়িত্বের কথা বিস্মৃত হয়।

আমরা জানি, করোনা সংক্রমণ সবার হতে পারে কিন্তু তাদের বয়সের কারণে বয়োবৃদ্ধদের মধ্যে মৃত্যুর আপাতন আনুপাতিক হারে বেশি হবে। সেই সঙ্গে যারা হাঁপানি, ক্যান্সার, বহুমূত্রের মতো ব্যাধির শিকার, তাদেরও ভঙ্গুরতা বেশি। এ পরিপ্রেক্ষিতে এটা খুব স্বাভাবিক যে তরুণরা বাইরে বেরোবেন বেশি, শারীরিক দূরত্বের অনুশাসন মানার ব্যাপারেও শিথিল হবেন। তাদের মনে হবে এ সংক্রমণের ফলে তারা হয়তো সপ্তাহখানেক অসুস্থ থাকবেন, তার পরই সুস্থ হয়ে যাবেন।

কিন্তু মনে রাখা দরকার যে তাদের এই দায়িত্বহীন কাজের ফলে তারা তাদের পরিবারের মধ্যে, আশেপাশের বয়োবৃদ্ধদের সংক্রমিত করতে পারেন এবং চূড়ান্ত বিচারে তাদের মৃত্যুর কারণও হতে পারেন। তরুণ বন্ধুদের প্রতি আমার একটিই শুধু আবেদন—গৃহের অভ্যন্তরে থাকুন, অপ্রয়োজনে বাইরে যাবেন না এবং বাইরে গেলেও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন।

জানি, আপনারা বলবেন যে এটা করলে আপনাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব হবে, আপনাদের একটি বিরাট আত্মত্যাগ করতে বলা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে! কিন্তু মনে রাখবেন, বহু মানুষের আরো বড় আত্মত্যাগের ফলে আপনারা আজ এখানে দাঁড়িয়ে আছেন। সে আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতে এইটুকু কি আপনারা করতে পারবেন না? নিজে বাঁচুন ও অন্যকেও বাঁচতে দিন।

শারীরিক দূরত্ব আমরা কঠিনভাবে বজায় রাখব ঠিকই, কিন্তু সামাজিকভাবে আমরা দূরে থাকব না। শারীরিক দূরত্ব মানে সামাজিক দূরত্ব নয়। আসলে আজকে সারা বিশ্বে যা ঘটছে, তাতে সামাজিক দূরত্ব নয়, সামাজিক নৈকট্যই বেশি প্রয়োজন। সামাজিক বিভাজন নয়, সামাজিক বন্ধনই কাঙ্ক্ষিত। আমরা সবাই যে একই নৌকোয়।

সংকটের যে বিশাল ব্যাপ্তি এবং যে গভীর স্বরূপ, তাতে আমাদের পরস্পরের খোঁজ নিতে হবে, পরস্পরকে সাহস জোগাতে হবে, পরস্পরকে সাবধান করতে হবে এবং সে কাজটি করতে হবে নানান যোগাযোগের মাধ্যমে। সংবাদ ও তথ্য আমরা সহভাগ করে নেব ঠিকই, কিন্তু তা যেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো বিশ্বাসযোগ্য সূত্র হয়। চিন্তাভাবনা না করে, সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে যা-ই আমাদের কাছে আসে, তা যেন আমরা সহভাগ না করে নিই। এতে অন্যের উপকার না করে অন্যের ক্ষতি করার সম্ভাবনাই বেশি। আমরা ভাগ্যবান যে বর্তমান সময়ের তথ্যপ্রযুক্তি শারীরিক উপস্থিতি ব্যতিরেকে আমাদের উপর্যুক্ত কাজগুলো করার সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু আমরা যাতে সেগুলো দায়িত্বের সঙ্গে ব্যবহার করি।

 সেই সঙ্গে এ-ও বলি যে এই ধূসর বিষণ্নতার সময়ে বেদনাদায়ক সব ঘটনা সহভাগ করে মন খারাপের পাল্লাটা আর ভারী করবেন না অনুগ্রহ করে। আমরা প্রত্যেকেই সে সব সংবাদের কিছু কিছু জানি। ‘কে আর হূদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?’

মনে রাখা দরকার সামাজিক নৈকট্য ও সামজিক বন্ধন ভিন্ন এ অভাবিত সংকট আমরা উতরাতে পারব না। যূথবদ্ধতা ভিন্ন আমরা কিন্তু অসহায়। শুধু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস এক্ষেত্রে এক অপপ্রয়াস ভিন্ন আর কিছুই নয়, যা ব্যর্থ হতে বাধ্য।

আজকের করোনা সংকটের কালে একটি নির্দেশিকা শব্দযুগল বলতে চেয়েছে এক কথা, কিন্তু বলে ফেলেছে অন্য কথা—নিজের অজান্তেই হয়তো। বলতে চেয়েছে ঘরের বাইরে নানান স্থানে দুজন মানুষ একটি নিরাপদ দূরত্বে থাকবেন, মানে ন্যূনতম একটি শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখবেন, যাতে সংক্রমণ না হয়। কিন্তু যেহেতু সামাজিক কর্মকাণ্ড ও সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে এই দূরত্বের কথা বলা হয়েছে, তাই অনেকটা বিভ্রমেই এর নাম দেয়া হয়েছে সামাজিক দূরত্ব (ঝড়পরধষ ফরংঃধহপরহম) বিধান। এটা তাই পরিষ্কার, যা বলতে চেয়েছে, তা বোঝাতে পারেনি; আর যা বোঝাতে চেয়েছে, তা বলতে পারেনি।

সুতরাং সামাজিক দূরত্বের বদলে নানান যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সামাজিক নৈকট্য গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু বজায় রাখতে হবে শারীরিক দূরত্ব। নিজে বাঁচতে হবে এবং অন্যকেও বাঁচতে দিতে হবে। ওটা করতে গেলে একদিকে অত্যাবশ্যকীয় শারীরিক দূরত্ব অনুশাসন, অন্যদিকে প্রয়োজন সামাজিক নৈকট্য বিধান। শব্দ প্রয়োগে আমাদের ভ্রান্তি যাতে না ঘটে।

সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক

মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন