দরবারের জাঁকজমক-নিয়মকানুন ছিল পারস্য অনুপ্রাণিত

১৮৫৭ সাল। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখা দেয় সিপাহি বিদ্রোহের চেহারায়। যার ধারাবাহিকতায় অবসান ঘটে কোম্পানি শাসনের। শুরু হয় ব্রিটিশরাজ। নিভে যায় মোগলদের শাসনপ্রদীপ। শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের স্নেহধন্য কবি জহির দেহলভির ওই সময়ের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থকে ইংরেজিতেদাস্তান--গদর: দ্য টেল অব দ্য মিউটিনিনামে প্রকাশ করেছে পেঙ্গুইন র‍্যানডম হাউজ ইন্ডিয়া। সিপাহি বিদ্রোহের অমূল্য দলিলটিকে বাংলায় প্রকাশের স্বত্ব পেয়েছে বণিক বার্তা। শানজিদ অর্ণবে রূপান্তরে ধারাবাহিক আয়োজন

কেল্লার প্রশাসন

অতিরিক্ত সৈন্যসহ সম্রাটের একটি সেনাদল ছিল। এই সেনাদল তৈরি করেছিলেন দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ। এই দলে ছিল দিল্লির তরুণরা, তরুণ শাহজাদারা অন্যান্য অভিজাত ঘরের ছেলে, দরবারের খিদমতগার অশ্বারোহী দল।

মর্যাদাপূর্ণ এই দরবারের অভিজাতদের মধ্যে ছিলেন মন্ত্রী, আধ্যাত্মিক গুরু, শিক্ষক, হুজুর, চিকিৎসক, কেল্লায় বসবাসরত শাহজাদারা, গোমস্তা, সৈনিকদের বেতন দেয়ার জন্য নিযুক্ত খাজাঞ্চি, বিভিন্ন পদমর্যাদার অভিজাত কর্মকর্তা, কারখানার সুপারিনটেনডেন্ট, শিল্পী প্রমুখ এবং যারা বিভিন্ন আরজি সংগ্রহ করেন।

প্রাসাদে যারা কাজ করেন তাদের এবং শাহজাদা কোয়ার্টারমাস্টারদের বেতন দেয়ার জন্য একটি বিভাগ ছিল। আরো ছিল এস্টেটের জন্য বেতন দেয়ার বিভাগ, রাজস্ব বিভাগ, দরবারের অভিজাতদের বেতন দেয়ার বিভাগ সেনা কর্মকর্তাদের বেতন প্রদানের দপ্তর।

মহিমান্বিত দরবারের নিয়মকানুন

দিল্লি সালতানাত মোগল বংশীয় শাসনে দরবারের ব্যবস্থাপনা নিয়মকানুন ছিল পারস্যের দরবার থেকে অনুপ্রাণিত এবং এগুলো ইউরোপের কোথাও দেখা যায় না।

তখত--তাউস রাখা হতো দিওয়ান--খাসের কেন্দ্রস্থলে। সিংহাসনের ওপর সোনার তৈরি চাঁদোয়া ছিল। একটি রুপার দণ্ড বা ছুবা--নিকরা সোনার কারুকাজ করা খাপে বসানো থাকত।

তখত--তাউসের চার কোনায় সোনার কারুকাজ প্রলেপ দেয়া চারটি ময়ূর বসানো থাকত। এগুলোয় আবার মূল্যবান রত্ন যেমন রুবি বসানো থাকত।

সিংহাসনে গদি থাকত। সম্রাট যখন দরবারে উপস্থিত থাকতেন, তখন উপস্থিত সভাসদরা সিংহাসনের উভয় পাশে নিজেদের পদমর্যাদা অনুসারে দুই সারিতে দাঁড়াতেন। সবাইকে তাদের দৃষ্টি মাটির দিকে রাখতে হতো। দরবারে কেউ নড়াচড়া করতে পারতেন না; হাসা, কথা বলা এমনকি একে অন্যের দিকে তাকানোও নিষিদ্ধ ছিল। কেউ নিজের শরীরে আঁচড়ও কাটতে পারতেন না।

দরবারের উভয় পাশে সভাসদদের দুটি সারিকে তত্ত্বাবধান করতে লাল রঙের লাঠি হাতে দুজন কর্মচারী থাকত। সভাসদদের কেউ দরবারের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে এই কর্মচারীরা তার ঘাড়ে লাঠি দিয়ে আঘাত করত এবং সেই নিয়ম ভঙ্গকারীকে দরবার থেকে বের করে দেয়া হতো। এই দরবারের সমতুল্য পুরো দেশে আর কিছু ছিল না।

দিওয়ান--খাসের পরে ছিল লাল পর্দা। কেউ দিওয়ান--খাসে প্রবেশ করতে চাইলে প্রথমে লাল পর্দায় হাজির হতে হয় এবং সালামগাহে দাঁড়িয়ে সম্রাটকে অভিবাদন জানাতে হতো। এটা করা হতো তিনবার সালাম জানিয়ে, যাকে বলা হতো কুর্নিশসম্মানের সঙ্গে কোমর পর্যন্ত ঝুঁকে হাতকে নিজের কপালের কাছে নিয়ে সালাম জানানো। তখন ঘোষক ঘোষণা করত:

মুলাইঝা আদাব হ্যায়। আদাব বাজা লাও। জাহানপানাহ, বাদশাহ সালামাত, আলামপানাহ!’ (‘সাবধান! দুনিয়ার আশ্রয়কে আপনার অভিবাদন জানান, দুনিয়ার আশ্রয়দাতা সম্রাট দীর্ঘজীবী হোন!’)

অভিজাতরা প্রবেশ করতেন হাম্মামের দিক থেকে এবং তারপর দিওয়ান--খাসের ছাদ পর্যন্ত বিস্তৃত সিঁড়িতে চড়তেন। এখানে তারা পায়ের জুতা খুলে ফেলতেন এবং তারপর দিওয়ান--খাসের পরবর্তী সালামগাহে যেতেন এবং আবার সম্মান প্রদর্শন করতেন। ঘোষক এখানে আরেকবার অভ্যাগতের নাম ঘোষণা করত।

সভাসদ যদি নযর দিতে আসত, তাহলে সে সরাসরি সিংহাসনের কাছে গিয়ে তার সম্মান প্রদর্শন করত। সম্রাট সম্মানী হাতে নিয়ে দারোগার কাছে দিয়ে দিতেন। এই দারোগা সম্রাটকে দেয়া অতিথিদের সম্মানী সংগ্রহ করতেন। দারোগা সিংহাসনের পাশেই দাঁড়ানো থাকতেন।

একজন লেখকও সেখানে থাকত উপহারের বিবরণ, পরিমাণ লিখে রাখার জন্য। উপহার দেয়ার পর অতিথি পেছনের দিকে হেঁটে যেতেন। তাকে অবশ্যই সবসময় সম্রাটের মুখের দিকে মুখ রাখতে হতো। কোনো অবস্থায়ই সম্রাটকে পশ্চাদ্দেশ দেখানো যাবে না। পেছনের দিকে হেঁটে সালামগাহে গিয়ে আরেকবার সালাম জানিয়ে দরবারে দাঁড়ানো অভিজাতদের সারিতে গিয়ে দাঁড়াতেন।

অভিজাতরা তাদের পদমর্যাদা অনুসারে সিংহাসনের কাছে দাঁড়াতেন। সবচেয়ে মর্যাদাবান দাঁড়াতেন সিংহাসনের সবচেয়ে কাছে। তারা মাছি তাড়াতেন বাল--হুমা দিয়ে। কয়েকজন কর্মকর্তা ছিলেন যারা আবেদন সংগ্রহ করতেন, এদের নাম ছিল আর্জ বেগ। তারা দরবারের এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন এবং আবেদনকারীরা তাদের হাতে আরজি পেশ করত। আর্জ বেগরা আরজিগুলো সম্রাটের কাছে নিয়ে গিয়ে তার সামনে খুলতেন। সম্রাট আরজির ওপর চোখ বোলানোর পর আরেকজন বিশেষ কলম কাচের তৈরি কালির দানি সম্রাটকে এগিয়ে দিতেন। সম্রাট একটি পেনসিল দিয়ে আরজিতে স্বাক্ষর করতেন। সম্রাটের স্বাক্ষরের অর্থ তিনি আরজিটি গ্রহণ করেছেন এবং দ্রুতই সেটা বাস্তবায়িত হবে।

লেখক শিল্পীরা

যেসব সাহিত্যিক শিল্পীকে সম্রাট নিয়োগ দিতেন, তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে ছিলেন শ্রেষ্ঠ। নিজের বিষয়ে তাদের দক্ষতার জন্যই তাদের বাছাই করা হতো। তাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। আর যদি কেউ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারত, তাহলে তাকেও দরবারে নিয়োগ দেয়া হতো। এমনকি তারা যদি অন্য কোনো রাজদরবারে নিয়োগপ্রাপ্ত হতো, তাহলেও তারা মোগল দরবার থেকে একটা বৃত্তি পেত। তারা অন্য দরবার থেকেই বছরে বা ছয় মাসে একবার সম্রাটকে সম্মান জানাতে আসত।

কিলা--মোয়াল্লার পতনের পর এই শিল্পীরা বিপদে পড়ে যান। তারা দিল্লির আশপাশের এলাকাগুলোতে পৃষ্ঠপোষকতা বা চাকরির খোঁজে ছড়িয়ে পড়েন।

মির্জা জওয়ান বখতের বিয়ে

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অনেক উৎসব আয়োজন হয়েছে, কিন্তু মির্জা জওয়ান বখতের বিয়েতে যে শোভা দেখা গিয়েছিল, তার সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা হতে পারে না। এই শাহজাদার বিয়ের মতো জাঁকজমকপূর্ণ খরুচে বিয়ে আমি জীবনে দেখিনি।

এই বিয়ের উৎসব, রীতি-রেওয়াজ, সঞ্চক, মেহেন্দি, বারাত, নগরের সজ্জা, আলোকসজ্জা, নকরখানার সাজ বর্ণনা করার সামর্থ্য আমার নেই এবং আমি সে চেষ্টা করতেও চাই না। তবে দুটো বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন।

প্রথমত, বিভিন্ন জমায়েতের জাঁকজমক ছিল অনন্য। দিওয়ানের বারাদারিতে আয়োজিত হয়েছিল বিভিন্ন ধরনের মেহফিল। প্রত্যেকটি তোরণের নিচে একজন নৃত্যশিল্পী বিভিন্ন ধরনের নাচ পরিবেশন করেছিলেন। শাহজাদারা, গণ্যমান্য প্রাসাদের কর্মচারীদের জন্য পৃথক মেহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল। সেনাদল বিভিন্ন স্থানে জমায়েত হয়েছিল। চাকরবাকরদের জন্যও পৃথক মেহফিল আয়োজন করা হয়েছিল। এভাবে সমাজের প্রতিটি তলার মানুষের জন্য পৃথক মেহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল।

একটা সাধারণ নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল যে শাহজাহানাবাদের সব নাগরিক উৎসবের সংগীত নাচ উপভোগ করতে পারবেন। ১০-১২ দিন আয়োজনস্থলগুলো সাজানো হয়েছিল; পরীর মতো দেখতে নৃত্যশিল্পী সুন্দরী নারীরা তাদের নানা কসরত দেখিয়েছিলেন। সব রাজকর্মচারী শাহজাহানাবাদের অভিজাতদের বিভিন্ন ধরনের মাংসের একটি ডিশ উপহার দেয়া হয়েছিল, যা টোরা নামে পরিচিত। সাধারণ মানুষ চাইলে টোরা কিংবা এর পরিবর্তে ৫০ রুপি নিতে পারত। দরবারে তালিকাভুক্ত কর্মচারীরা প্রত্যেকে টোরা পেয়েছিলেন। যেমন আমার বাবা, মা, ছোট ভাই (তিনিও দরবার থেকে নির্দিষ্ট বেতন পেতেন) এবং আমি পৃথক পৃথক ডিশ পেয়েছিলাম। যে এই টোরা বিতরণের ব্যবস্থাপনায় ছিল, তাকে বলেছিলাম আমার বাড়িতে আরেক ডিশ টোরা পাঠাতে, তবে সেটা আরো আটদিন পর।

খাবার বিতরণ করা হয়েছিল মুক্তহস্তে। যেদিন বাসায় টোরা আসত, আমরা সেটা বিভিন্ন আত্মীয় বন্ধুদের বাসায় পাঠিয়ে দিতাম। টোরার একটি ট্রেতে যে পরিমাণ খাবার থাকত, তাতে একদল মানুষ তাদের গলা পর্যন্ত খেতে পারত। যেদিন টোরার ট্রেগুলো আসত, সেদিন আমার বাড়ির প্রবেশপথের গলিটা যেন ভরে যেত। প্রত্যেক ট্রেতে পাঁচ সের ওজনের খাবার থাকত: চার-পাঁচ রকমের পোলাও; লাল, হলুদ, বেগুনি রঙের মিষ্টি ভাত; পাঁচ সের মিষ্টি; লবণাক্ত বাকরখানি বিভিন্ন ধরনের নান। এই ট্রেগুলোতে সব ধরনের খাবার থাকত।

সংক্ষেপে বলতে হয়, অন্য কোনো রাজত্বে আমি এমন ধরনের উৎসব দেখিনি। যদিও আমি যখন এসব দেখেছি, তখন এই দরবার অনেকটাই ক্ষয়ে গেছে।

এসবের বাইরে যে কবিরা সেহরা তাহনিয়াত লিখেছিলেন, তাদের পুরস্কার খিলাত দেয়া হয়। যদিও তারা সবাই দরবারেরই বেতনভুক্ত ছিল। সব চাকরকেও নতুন পোশাক উপহার দেয়া হয়েছিল। ছবি: সংগৃহীত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন