সুদনীতি

ঋণ ও আমানতের সুদহার নির্ধারণ একটি অর্থনৈতিক পর্যালোচনা

ড. মোহাম্মদ দুলাল মিয়া

ঋণ আমানতের সুদহার একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আমানতের সুদের উচ্চহার সঞ্চয়কে উৎসাহিত করে আবার ঋণের সুদের নিম্নহার বিনিয়োগ সহায়ক দুইয়ের এই বিপরীতমুখী ধারার সমন্বয় যেকোনো অর্থনীতির জন্য বেশ কঠিন আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণের হার অনেক বেশি, সে কথা বলা বাহুল্য তাই ঋণ আমানতের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট করার কথা অনেকদিন থেকেই জোর আলোচনা হচ্ছিল বিশেষ করে ব্যাংকারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএবি) ব্যাপারে বেশ সরব ছিল তারই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের জুন থেকে ঋণের সুদহার শতাংশ আমানতের সুদহার শতাংশ করার সিদ্ধান্ত হয়, যদিও সেটার বাস্তব প্রয়োগ পর্যন্ত খুবই সীমিত দেখা গেছে তবে সব আলোচনা সমালোচনার পর চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ব্যাংকিং খাতে সুদহারে নয়-ছয় নীতি (ঋণের সুদ ক্রেডিট কার্ড ব্যতীত সর্বোচ্চ শতাংশ আমানতের সুদ সর্বোচ্চ শতাংশ) বাস্তবায়ন করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়



ঋণের সুদহার হ্রাস করার অনেক সুফলের কথা অর্থশাস্ত্রে বিদ্যমান যেমন ঋণের নিম্ন সুদহার বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়ক, যা মূলত শিল্পোন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে সুদের উচ্চহার বজায় থাকলে বিনিয়োগকারীর মূলধন খরচ বেশি হয়, ফলে লাভজনক অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব হয় না অবস্থায় যদি সুদহার হ্রাস করে মূলধন ব্যয় কমানো যায়, উদ্যোক্তা অনেক বেশি প্রকল্প গ্রহণ করতে পারবেন, যা অধিক উৎপাদন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে দ্বিতীয়ত, সুদের উচ্চহার উদ্যোক্তার দেউলিয়াত্বের একটা বড় কারণ যেমন সুদের উচ্চহারের কারণে বিনিয়োগকারী তার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ঋণ নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধের মানসে অতিরিক্ত ঝুঁকি নিয়ে থাকেন কেননা অল্প ঝুঁকিতে যে মুনাফা হয়, সেটা মূলধনের সুদ পরিশোধের জন্য যথেষ্ট না- হতে পারে তাই বিনিয়োগকারী অতিরিক্ত ঝুঁকি নিয়ে অধিক মুনাফা করতে চান, যা মূলত ব্যবসা দেউলিয়াত্বের সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করে তৃতীয়ত, উচ্চ সুদহার বিনিয়োগকারীর নৈতিক অবক্ষয়ের একটি প্রধান কারণ বিনিয়োগকারী মনে করেন যে অধিক ঝুঁকির কারণে যদি ব্যবসা দেউলিয়া হয়, তবে লোকসানের একটা অংশ লগ্নি প্রতিষ্ঠানের ওপরও বর্তাবে তাই বিনিয়োগকারী নিরাপদ বিনিয়োগকে অনেক সময় লাভজনক মনে করেন না, উচ্চঝুঁকিসম্পন্ন প্রকল্প গ্রহণে উৎসাহিত হন, যা নৈতিক অবক্ষয়ের শামিল সুতরাং সুদহার কমানোর অনেক অর্থনৈতিক তাত্পর্য রয়েছে তবে সেই সঙ্গে আমানতের সুদহারও কমাতে হবে, যাতে ব্যাংকের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ স্প্রেড মার্জিন বা সুদহারের ব্যাপ্তি থাকে সুদহারের নয়-ছয় নীতির মাধ্যমে ব্যাংকের শতাংশ ব্যাপ্তি রাখা হয়েছে

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিেজর মতে, সুদহারের এই ব্যাপ্তি যত বেশি হবে, আর্থিক খাতের উন্নয়ন তত বেশি ত্বরান্বিত হবে স্টিগলিত্জ তার সহযোগীরা মালয়েশিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশের আর্থিক খাতের উন্নয়নকে সুদহারের ব্যাপ্তির আলোকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে উন্নয়নশীল দেশের জন্য ঋণ আমানতের নির্দিষ্ট হার বেঁধে জুতসই একটা সুদহারের ব্যাপ্তি ব্যবস্থা করা গেলে আর্থিক খাতের উন্নয়ন সম্ভব হবে এবং বিনিয়োগ বেগবান হবে তাদের মতে, উন্নয়নশীল দেশের সঞ্চয় সুদহারের ওপর তেমন নির্ভর করে না, বরং অন্যান্য নিয়ামক দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয় যেমন সামগ্রিক অবকাঠামোর উন্নয়ন এসব দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত নগরকেন্দ্রিক হয় এবং মফস্বল অঞ্চলে তাদের তেমন উপস্থিতি থাকে না, যার ফলে মফস্বল এলাকার সঞ্চয়কে প্রচলিত আনুষ্ঠানিক আর্থিক খাতের আওতায় এনে বিনিয়োগে রূপান্তর করা যায় না যেহেতু দেশের বিশাল একটা জনগোষ্ঠী মফস্বলে বাস করে, তাদের গচ্ছিত তহবিলযা দেশের মূলধনের একটা বড় অংশ অলস পড়ে থাকে অথবা অনানুষ্ঠানিক খাত দিয়ে প্রবাহিত হয়মূলধারার অর্থনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে অপারগ এসব অঞ্চলে সঞ্চয় বৃদ্ধিতে শুধু সুদহারের বৃদ্ধি ততটুকু কার্যকর নয়, যতটুকু কার্যকর দরকারি অবকাঠামোর উন্নয়ন সম্প্রসারণ

অন্যদিকে সুদহারের ব্যাপ্তি (স্প্রেড মার্জিন) যত বেশি হবে, লগ্নি প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের মুনাফা তত বেশি হবে অধিকতর মুনাফা ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের জন্য প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে আরো বেশি মুনাফার আশায় তারা অধিকতর বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন সে লক্ষ্যে নতুন নতুন শাখা, উপশাখা, এটিএম বুথসহ অন্য অবকাঠামোর বিস্তার ঘটবে লগ্নি প্রতিষ্ঠানের সেবার মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে এতে করে সঞ্চয়ের জোগান বাড়বে, যা বিনিয়োগের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে আবার ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো প্রকল্প যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মান বৃদ্ধি করবে এবং ঋণ প্রদানের পর ঋণগ্রহীতাসহ অর্থায়নকৃত প্রকল্পের সঠিক পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করবে প্রয়োজনে ব্যাংকগুলো প্রকল্পের সফলতার জন্য নির্দেশনামূলক সেবাও প্রদান করবে, যা আদতে কুঋণের পরিমাণ হ্রাসে ফলপ্রসূ হবে 

তত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে সুদহারের নয়-ছয় নীতি অবশ্যই অর্থনৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য তবে নীতির প্রত্যক্ষ সুফল পাওয়ার জন্য কতগুলো নিয়ামকের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে প্রথমত, সঞ্চয়ের সুদহার যেন কখনই মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম না হয় মূল্যস্ফীতির হার যদি সঞ্চয়ের সুদহারের চেয়ে বেশি হয়, প্রকৃত সুদহার হবে ঋণাত্মক, যেটা সঞ্চয়ের জন্য হবে মারাত্মক হুমকি শঙ্কার কথা হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে গত কয়েক বছরের মূল্যস্ফীতির হার শতাংশ ছুঁই ছুঁই কখনো কখনো শতাংশ অতিক্রম করে গেছে তবে শতাংশের নিচে নামার নজির তেমন নেই তাই মূল্যস্ফীতির আশানুরূপ হার বজায় রাখা হবে একটা বড় চ্যালেঞ্জ চ্যালেঞ্জে ব্যর্থ হওয়ার মানে হচ্ছে সঞ্চয়কে নিরুৎসাহিত করা এবং সেই সঙ্গে বর্তমান ভোগকে আকর্ষণীয় করা; যা নয়-ছয় নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত সুতরাং মুদ্রানীতিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে মূল্যস্ফীতির হারকে প্রত্যাশিত মাত্রায় রাখা যায়, সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে

দ্বিতীয়ত, সুদহারের নয়-ছয় নীতিতে ব্যাংকগুলোর জন্য শতাংশ সুদহারের ব্যাপ্তি রাখা হয়েছে এখানে প্রশ্ন হলো, শতাংশ ব্যাপ্তি ব্যাংকগুলোর প্রণোদনার জন্য যথেষ্ট কিনা শুধু সরকারি ব্যাংকের সুদহারের গড় ব্যাপ্তি (ভোক্তাঋণ ক্রেডিট কার্ড ব্যতীত) শতাংশের সামান্য উপরে, যা বিশেষায়িত ব্যাংকের জন্য শতাংশেরও নিচে কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকের সুদের গড় ব্যাপ্তি দশমিক শতাংশ বিদেশী ব্যাংকের দশমিক শতাংশ বাংলাদেশের শিল্পায়নে বেসরকারি ব্যাংকের ভূমিকা অসামান্য সুতরাং বর্তমানের তুলনায় এক-চতুর্থাংশ স্প্রেড বা ব্যাপ্তি কমালে এসব ব্যাংক লাভজনকভাবে টিকে থাকতে কতটুকু সমর্থ, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে শতাংশ ব্যাপ্তি ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য অবশ্যই অনেক বেশি, যেটা কমানোই যুক্তিযুক্ত কিন্তু বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের নাজুক অবস্থার পেছনে অকার্যকর ঋণ (নন-পারফর্মিং লোন) অনেকাংশে দায়ী অবস্থায় শতাংশ ব্যাপ্তি ব্যাংকগুলোর জন্য কতটুকু প্রেষণাদায়ক হবে, সেটা নির্ভর করবে অকার্যকর ঋণ হ্রাসের কার্যকর পদক্ষেপের ওপর সেই নিমিত্তে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন ছাড়া সুদহারের নয়-ছয় নীতি প্রশ্নের মুখে পড়বে

তৃতীয়ত, ব্যবসা শিল্প খাতের বিকল্প বিনিয়োগের ক্ষেত্রকে (মূলত অনুৎপাদক খাতকে) নিরুৎসাহিত করতে হবে জামানতের সুদহার সঞ্চয়কারীর জন্য আকর্ষণীয় না হলে তারা বিনিয়োগের বিকল্প উপায় খুঁজবেন, যেমন স্বর্ণ, রুপা, হীরা এসব অনুৎপাদনশীল সম্পদে বিনিয়োগ আবার আবাসন খাতের চাহিদাও বাড়তে পারে আবাসন খাতের একটা অর্থনৈতিক গুরুত্ব থাকলেও শিল্পে বিনিয়োগের চেয়ে এর সুফল অনেক কম সেক্ষেত্রে আবাসন খাতের চাহিদা বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে, যাতে শিল্প খাতের প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ আবাসন খাতে প্রবাহিত হয়ে অপ্রয়োজনীয় বুদ্বুদ (বাবল) সৃষ্টি না করে

চতুর্থত, অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেডিট রেশনিং বা ঋণের পরিমাণ সীমিতকরণ নীতি অনুসরণ করতে পারে ঋণের সুদহার নির্ধারণ করে দেয়ার অর্থ হলো বিনিয়োগকারীর প্রকল্পের ঝুঁকির সঙ্গে ঋণের সুদহার ওঠানামা করবে না যেহেতু ঋণের হার পূর্বনির্ধারিত, ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণে খুব সাবধানতা অবলম্বন করবে তারা শুধু সেসব প্রকল্পে অর্থায়ন করবে, যেগুলোর ঝুঁকির মাত্রা তাদের পূর্বনির্ধারিত ঝুঁকির মাত্রার নিচে থাকবে ক্রেডিট রেশনিং যদি বেশি হয়, বিনিয়োগের অভাবে শিল্পোন্নয়ন ব্যাহত হবে এবং সুদের নয়-ছয় নীতির লক্ষ্য অর্জিত হবে না সুতরাং লগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে অযাচিত ক্রেডিট রেশনিং না করে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে

উদীয়মান অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা প্রসারতা একটি অপরিহার্য শর্ত আর আর্থিক খাতের উন্নয়ন নির্ভর করে যুগোপযোগী নিয়মনীতি প্রণয়ন প্রয়োগের ওপর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঋণের সুদহার হ্রাস একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ তবে নীতির সফলতা নির্ভর করবে আনুষঙ্গিক আরো অনেক নিয়ামকের ওপর ঋণ আমানতের সুদহার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে সেসব নিয়ামকের যুগপৎ নিয়ন্ত্রণ পরিবর্তনই কেবল সুদহারের নয়-ছয় নীতির প্রত্যাশিত সুফল বয়ে আনবে

 

. মোহাম্মদ দুলাল মিয়া: সহযোগী অধ্যাপক বিভাগীয় প্রধান; ফিন্যান্স অর্থনীতি বিভাগ

নিজুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ওমান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন