অভিমত

যুক্তরাজ্য কি আবার ইইউতে ফিরে যাবে?

আবু তাহের খান

নানা তর্ক-বিতর্ক মত-অমতের দ্বন্দ্বকে পেছনে ফেলে দীর্ঘ অর্ধশতকের (৪৭ বছর) সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে গত ৩১ জানুয়ারি ২৮ সদস্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে গেল ইউরোপের অন্যতম দেশ যুক্তরাজ্য। গণমাধ্যমের খবর থেকে দেখা যায়, বিষয়টি ঘিরে সেখানে ওইদিন আনন্দ বিষাদময় এক মিশ্র পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। গত ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত যুক্তরাজ্যের উপস্থিতি-সংবলিত ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সর্বশেষ অধিবেশনে সেদিন এর প্রেসিডেন্ট ইতালীয় এমপি ডেভিড সসোলি অত্যন্ত আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, ‘আমাদের যা কিছু বিভক্ত করে, ঐক্যবদ্ধ করার উপাদান তার চেয়ে অনেক বেশি।ইইউ ব্রেক্সিট (British + Exit)-বিষয়ক মুখপাত্র ভারহফস্টাড বলেন, ‘যে দেশটি ইউরোপের স্বাধীনতার জন্য দুই দফা রক্ত দিয়েছে, তাদের বিদায় বলাটা কষ্টদায়ক।আর সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ বক্তব্যটি রেখেছেন যুক্তরাজ্যের গ্রিন পার্টির এমপি মোলি স্কট, ইইউ পার্লামেন্টে দেয়া তার সর্বশেষ বক্তব্যে তিনি অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, ‘হয়তো এখনই পুনরায় ইইউতে ফিরে আসার জন্য প্রচার শুরু করা যাবে না। তবে ইইউতে ফিরে আসার স্বপ্ন অবশ্যই জিইয়ে রাখতে হবে।বস্তুত মোলি স্কটের বক্তব্যের সূত্র ধরেই প্রবন্ধের অবতারণা।

উল্লেখ্য, বিচ্ছেদের মুহূর্তে মোলি স্কটের বক্তব্যের বিরোধী উচ্চারণও কম উচ্চকিত ছিল না। গত ৩১ জানুয়ারি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ঘিরে লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার এলাকায় প্রায় সারাদিন ছিল ব্রেক্সিটপন্থীদের সরব উপস্থিতি। পাশাপাশি সেখানে ব্রেক্সিটবিরোধীরা থাকলেও গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ব্রেক্সিটপন্থীরাই ছিল অধিকতর উচ্চকণ্ঠ। মোট কথা, দুই পক্ষের কষ্ট, আবেগ আনন্দ মিলে সেটি ছিল আসলেই এক অভূতপূর্ব ঘটনা। অবশ্য একমাত্র ভবিষ্যৎই বলতে পারবে কষ্ট আনন্দের পরস্পরবিরোধী ধারা দ্বন্দ্ব সমন্বয়ের প্রক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে!

ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রথম আনুষ্ঠানিকতা পায় এখন থেকে প্রায় চার বছর আগে ২০১৬ সালের ২৩ জুন অনুষ্ঠিত গণভোটে, দেশটির ৫১ দশমিক ৮৯ শতাংশ মানুষ এর পক্ষে ভোট দিল। তবে গণভোটের ফলাফল ব্রেক্সিটের পক্ষে গেলেও লক্ষ করা যায়, ফলাফল ঘোষিত হওয়ার অব্যবহিত পর থেকেই গোটা ব্রিটেনে ব্রেক্সিটবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। আর সেই পরিপ্রেক্ষিতেই গণভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও এর রায় পার্লামেন্ট কর্তৃক অমুমোদন পেতে তথা ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার বিষয়টি তিন দফা বিলম্বিত হয়। তবে ব্রেক্সিট ঘিরে রক্ষণশীল দলের জন্য একটি বর্ধিত আনন্দের ঘটনা এই যে ২০১৬ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে বরিস জনসন ব্রেক্সিট আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে গণভোটের যে রায়কে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন, ২০২০ সালে তার হাত ধরেই প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ব্রেক্সিটের চূড়ান্ত বাস্তবায়ন ঘটল। অবশ্য বিচ্ছেদ শেষ পর্যন্ত বরিস তার দলকে দীর্ঘমেয়াদে কতটা সাফল্য এনে দিতে পারবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

এদিকে যুক্তরাজ্যের অন্যতম রাজ্য স্কটল্যান্ডের পার্লামেন্ট সেখান থেকে ইইউর পতাকা না সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সঙ্গে ওই পার্লামেন্ট সে প্রদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট আয়োজনেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্কটিশ পার্লামেন্টের এরূপ সিদ্ধান্ত বরিস জনসন তথা সেখানকার রক্ষণশীল দল তথা পুরো ব্রিটেনের জন্য শুধু রাজনৈতিক ঝুঁকিই তৈরি করবে না, ব্রেক্সিট নিয়েও দেশের ভেতরে অসন্তোষের মাত্রা বৃদ্ধি করবে। কারণ স্কটিশদের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার দাবির বিষয়টিকে তখন অন্য ব্রিটিশরা ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের আলাদা হয়ে যাওয়ার ঘটনার সঙ্গে তুলনা করতে প্রয়াসী হবে। এমনকি স্কটিশরাও যদি তাদের স্বাধীনতার দাবির পক্ষে যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্রেক্সিটের প্রসঙ্গ তুলে আনেন, তাহলে তাতে মোটেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সুতরাং মানতেই হবে যে স্কটল্যান্ড প্রসঙ্গে ব্রিটেনের রাজনীতিতে ব্রেক্সিট একটি নতুন কাঁটা হিসেবেই যুক্ত হলো।

সামগ্রিকভাবে ব্রিটেনের ওপর ব্রেক্সিটের আর কী কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, সেক্ষেত্রে সর্বাগ্রে আসে অর্থনীতির প্রসঙ্গ। কারণ বস্তুত নিজেদের অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক শক্তিকে অধিকতর সংহত করার লক্ষ্য নিয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ১৯৫৭ সালে স্বাক্ষরিত রোম চুক্তির বলে ইইউর প্রতিষ্ঠা (তখন নাম ছিল ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটিইইসি) আর সে অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের জন্যই ব্রিটেন ১৯৬৩ ১৯৬৭ সালে ইইউর সদস্যপদের জন্য আবেদন করেও ফরাসি প্রেসিডেন্ট দ্য গলের ভেটোর মুখে বাধাগ্রস্ত হয়েও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে এবং ১৯৬৯ সালে দ্য গলের পদত্যাগের পর ১৯৭২ সালে সদস্যপদ লাভে সমর্থ হয়।  এত সাধ্য-সাধনার মধ্য দিয়ে অর্জিত সদস্যপদ বিসর্জনের জন্য ব্রিটেন এমন মরিয়া হয়ে উঠেছিল কেন? তাহলে কি এর পেছনে অর্থনৈতিক জনস্বার্থের চেয়েও বড় হয়ে কাজ করেছে কোনো উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা, যে চেতনা এখন ইউরোপের দেশে দেশে ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে? প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এরই মধ্যে তার ভিডিওবার্তায় একেনতুন জাতীয় জাগরণের সূচনাবলে উল্লেখ করেছেন।

৩১ জানুয়ারি মধ্যরাত থেকে ব্রেক্সিট কার্যকর হলেও ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আরো প্রায় ১১ মাস ধরে এটি সম্পন্ন হওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। এর মধ্যে সবচেয়ে সচলভাবে কার্যকরাধীন বিষয়গুলোর মধ্যে থাকবে ইউ কাস্টমস ইউনিয়ন ইইউ কমন মার্কেট। আর সব মিলিয়ে এই ১১ মাসের অন্তর্বর্তী সময়ে যে বিষয়গুলো আগের ধারাবাহিকতায় অব্যাহত থাকবে তা হলো: . অবাধ ভ্রমণ যাতায়াত; . কাজের অধিকার বসবাস এবং . বাণিজ্যিক লেনদেন। ব্রেক্সিটপন্থীরা আশাবাদী যে এই অন্তর্বর্তী সময়ের কাজগুলো যথাযথভাবেই সম্পন্ন হবে এবং শর্ত অনুযায়ী তা হওয়াই উচিত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যাতায়াত শুল্কের বিষয়টি মোটামুটিভাবে নিষ্পত্তি করা গেলেও কর্মপরিবর্তনের বিষয়টির সমাধান অত সহজে হবে কি? এবং সেটি যথাযথভাবে করতে না পারার কারণে ব্রিটেনে বেকারত্বের হার যদি বর্তমানের দশমিক শতাংশ থেকে বেড়ে দশমিক শূন্য শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, তাহলে তাতে মোটেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা। ইইউর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির ধারাবাহিকতা কি ব্রিটেন এখন নতুন সব দেশের সঙ্গে যথাযথভাবে রক্ষা করে চলতে পারবে? এক্ষেত্রে বাণিজ্যিক লেনদেনের ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশ যদি ইইউর কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা পেয়ে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে সরে যায়, তাহলে সে পরিস্থিতি ব্রিটেনের পক্ষে মোকাবেলা করা সত্যি কষ্টকর হয়ে পড়বে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য যদি বাড়তি শুল্ক মূল্য সুবিধা দিয়ে অন্য দেশ বা দেশগুলোকে নিজের দিকে টানতে চায়, তাহলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ভারসাম্য তার প্রতিকূলে চলে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। অবস্থায় যুক্তরাজ্যের সামনে যে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তা মোকাবেলা করা তার একার পক্ষে মোটেও সহজ হবে না।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ঘন ঘন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান সরকার পরিবর্তনের কারণে ব্রিটেনে রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যয় ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। ব্রেক্সিটের কারণে নতুন পরিস্থিতি প্রক্রিয়া মোকাবেলায় এবং বহু ক্ষেত্রে বহু কাজ নতুন করে শুরু করার কারণে ব্যয় যে আরো অনেকাংশে বেড়ে যাবে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। তাছাড়া ইইউ-উত্তর নতুন যাত্রায় নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কৌশল প্রণয়ন করতে গিয়েও যুক্তরাজ্যকে নানা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হতে পারে। এক্ষেত্রে কোনোভাবেই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় যে এসব পরিকল্পনা কৌশল শতভাগ সুফল দেবেই। অতএব, ব্রেক্সিট মানেই ব্রিটেনের জন্য পদে পদে নতুন থেকে নতুনতর ঝুঁকি।

ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক কূটনীতি নানা সামরিক-বেসামরিক কৌশল মোকাবেলায় বহু ক্ষেত্রে বহু পরিস্থিতিতে বহু সমস্যা যুক্তরাজ্যকে এখন একাই মোকাবেলা করতে হতে পারে। আর এটা বুঝতে পেরে কোনো কোনো চালাক-চতুর দেশ যদি নতুন করে ব্রিটেনের ঘাড়ে চড়ে বসে, তাহলে তার প্রতি কষ্ট করুণায় সিক্ত হওয়া ছাড়া অনেকেরই হয়তো আর কিছুই করার থাকবে না।

দুই

এতক্ষণ যা বলা হলো, সেগুলোর প্রায় সবই ব্রেক্সিটের কারণে ব্রিটেনের জন্য ঝুঁকিসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি। কিন্তু যে উগ্র জাতীয়তাবাদী বোধ চেতনাকে পুঁজি করে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেল, তা যে তাদের কোনোই সুফল দেবে নাএমনটি হলফ করে বলাটা মোটেও সমীচীন হবে না। বিভক্তি নিয়ে যত হাপিত্যেশই করা হোক না কেন, থেকে কিছু না কিছু সুফল তাদের ভাগ্যে অবশ্যই জুটবে। তবে আবেগ থিতিয়ে গেলে এবং পৃথিবীর নিষ্ঠুর বাস্তবতায় জাতীয়তাবাদীদের অধিকাংশ স্বপ্ন ক্রমাগত ধাক্কা খেতে থাকলে একসময় তারা যদি ২০১৬ সালের গণভোটে ব্রেক্সিটের বিপক্ষে ভোটদানকারী ৪৮ দশমিক ১১ শতাংশ ভোটারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্রেক্সিটপন্থীদের সংখ্যালঘু করে তোলে, তাহলে তাতে মোটেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আর এর সঙ্গে স্কটিশ স্বাধীনতাকামীদের আন্দোলন আকাঙ্ক্ষার শক্তি যুক্ত হলে তা যে অবধারিতভাবেই ইইউর প্রতি স্মৃতিবিধুরতাকে আরো বাড়িয়ে তুলবে, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়।

আর সেই একই ধারবাহিকতায় জাতীয়তাবাদী ব্রিটিশরা একসময় আবার বলতেই পারেআমরাই তো চার্লস দ্য গলকে কৌশলে মোকাবেলা করে ১৯৭৩ সালে ইইউতে আমাদের সদস্যপদ নিশ্চিত করেছিলাম। অতএব, আবেগের ঘোরে ভুল করে আমরা যদি ব্রেক্সিট ঘটিয়েও থাকি, তাহলেও ইইউতে আবার ফিরে যাওয়ার অধিকার আমাদের অবশ্যই রয়েছে।

 

আবু তাহের খান: পরিচালক

স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

[email protected] 

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন