যে কোম্পানিতে ন্যূনতম বেতন ৭০ হাজার ডলার!

বণিক বার্তা অনলাইন

আজ থেকে চার বছর আগে একটি প্রযুক্তি কোম্পানির প্রধানকে কর্মীদের বিলাসবহুল গাড়ি উপহার দেয়ার ঘটনা গণমাধ্যমে বেশ ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের সিয়াটল শহরের এই কার্ড পেমেন্ট কোম্পানির প্রধান বিশেষত্ব হলো, এখানে কর্মীদের ন্যূনতম বেতন ৭০ হাজার ডলার। ২০১৫ সালে গ্র্যাভিটি পেমেন্টস নামে ওই প্রতিষ্ঠানের ১২০ কর্মীর জন্য ন্যূনতম বেতন বাৎসরিক ৭০ হাজার ডলার ঘোষণা করেন মালিক ড্যান প্রাইস। এর জন্য নিজের বেতনও কাটছাঁট করেন তিনি। আজো সেই নিয়মই চলছে। বলতে গেলে এক কঠিন জুয়ায় জিতে গেছেন প্রাইস। তার কোম্পানির আয় ও মুনাফা দুটোই বেড়েছে।

এই অবিশ্বাস্য ন্যূনতম বেতনের পেছনের গল্পটি খুব করুণ। প্রাইস তার এক বান্ধবী ভ্যালেরির সঙ্গে এক ছুটির দিনে কাসকেড মাউন্টেইনে হাইকিংয়ে গিয়েছিলেন। কথায় কথায় ভ্যালেরি তাকে বলেন, তার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। বাড়িওয়ালা হঠাৎ করে বাড়িভাড়া ২০০ ডলার বাড়িয়ে দিয়েছে। এই টাকা দিতে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন। এ কথা জেনে মনে মনে ক্ষুব্ধ হন প্রাইস। এই নারী ১১ বছর সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছেন, দুইবার ইরাকে গেছেন। আর এখন এই ৫০ বছর বয়সে জীবিকা নির্বাহের জন্য তাকে সপ্তাহে ৫০ ঘণ্টা খাটতে হয়। তারপরও কুলিয়ে উঠতে পারছেন না! যদিও তার বাৎসরিক আয় ছিল ৪০ হাজার ডলার। কিন্তু সিয়াটলের মতো এলাকায় এ দিয়ে ভালো থাকা যায় না।

মাত্র ৩১ বছর বয়সেই মিলিয়নেয়ার বনে যান প্রাইস। কিশোর বয়সে প্রতিষ্ঠা করেন গ্র্যাভিটি পেমেন্টস। তার কোম্পানির গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। কোম্পানির বাজারমূল্য কয়েক মিলিয়ন ডলার। তিনি বছরে বেতন নিতেন ১১ লাখ ডলার। কিন্তু ভ্যালেরির গল্প শোনার পরই ভাবতে থাকেন, তাহলে তার প্রতিষ্ঠানের কতো কর্মী না জানি এর চেয়েও খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে! তাৎক্ষণিকভাবে সব বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন প্রাইস। 

রাতারাতি বদলে যায় প্রাইসের দৃষ্টিভঙ্গি। ফোর্বস ম্যাগাজিনের ধনীর তালিকায় বিল গেটসকে হটিয়ে জেফ বেজোসের শীর্ষস্থান দখলের খবর দেখে তার কষ্ট হয়। তিনি বলেন, ১৯৯৫ সালের আগে আমেরিকার জাতীয় সম্পদে সবচেয়ে গরীব জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের একটি বড় হিস্যা ছিল, সেটি সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশের তুলনায় ঢের বেশি। আর এখন, বিশ্বের শীর্ষ ধনীর ১ শতাংশের সম্পদের পরিমান সবচেয়ে গরীব ৫০ শতাংশ লোকের চেয়ে বেশি। এই ফারাকটা দিন দিন বাড়ছেই। ১৯৬৫ সালে আমেরিকার সিইওরা কর্মীদের গড় আয়ের ২০ গুণ বেশি আয় করতেন। আর ২০১৫ সালে সেটি ৩০০ গুণ হয়ে গেছে।

ভ্যালেরির সঙ্গে পাহাড়ে চড়তে চড়তে দারুণ এক আইডিয়া আসে প্রাইসের মাথায়। অর্থনীতিতে নোবলে জয়ী ডেনিয়েল কানেম্যান এবং অ্যাঙ্গাস ডেটনের একটি গবেষণাপত্র পড়েছিলেন। সুখী হতে একজন আমেরিকানের কতো টাকার দরকার- এ নিয়েই ছিল সেই গবেষণা। নিজের কোম্পানির কর্মীদের বেতন বাড়াবেন বলে ভ্যালেরির কাছে প্রতিশ্রুতি দেন প্রাইস। বাকিটা ইতিহাস!

সব হিসাব নিকাশ শেষে ২০১৫ সালের এপ্রিলে কর্মীদের ন্যূনতম বেতন ৭০ হাজার ডলার করার সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত করেন প্রাইস। এর জন্য নিজের বেতন ১১ লাখ ডলার থেকে ৭০ হাজার ডলারে নামিয়ে আনেন, ব্যয় সঙ্কুলান করতে আলিশান দুটি বাড়িটি মর্টগেজ রাখেন, সব শেয়ার বেচে দেন এবং জমানো টাকাও তুলে ফেলেন। একদিন সব স্টাফকে ডেকে সেই ঐতিহাসিক ঘোষণাটি দেন প্রাইস। কর্মীরা এটি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। ঘোষণার সময় এই কথাটি তাকে কয়েকবার বলতে হয়।

পাঁচ বছর পর এসে ড্যান প্রাইস মুচকি হেসে কিছুটা খেদের কথা জানান। কারণ নোবেলজয়ী ওই প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকদ্বয় তাদের গবেষণায় সুখী হতে ন্যূনতম আয় ৭৫ হাজার ডলার হওয়া উচিত বলে মত দিয়েছিলেন। সেটি প্রাইস এখনো করতে পারেননি!

এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানির এক তৃতীয়াংশ কর্মীর বেতন দ্বিগুণ হয়ে যায়। এর পর থেকে গ্র্যাভিটিও বদলে গেছে। কর্মী সংখ্যা হয়ে গেছে দ্বিগুণ, বেতন বাবদ খরচ ৩৮০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ১ হাজার ২০ কোটি ডলারে পৌঁছে গেছে। সেই সঙ্গে আরো কিছু বেড়েছে যা নিয়ে প্রাইস খুব গর্বিত। তিনি বলেন, বেতন বাড়ানোর আগে আমাদের কর্মীদের মধ্যে বছরে একটি বা দুটি শিশুর জন্ম হতো। আর মাত্র সাড়ে চার বছর পর আমরা ৪০টির বেশি শিশু উপহার পেয়েছি। ১০ শতাংশের বেশি কর্মী নিজের বাড়ি কিনতে পেরেছেন, যেখানে সিয়াটল হলো যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ব্যয়বহুল একটি শহর। বেতন বাড়ানোর আগে এটা ছিল ১ শতাংশের কম। পেনসন ফান্ডে টাকা রাখা কর্মীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে, ৭০ শতাংশের বেশি কর্মী ঋণ পরিশোধ করেছেন। 

মায়ের সঙ্গে ড্যান প্রাইস

তবে শুরুর দিকে এ নিয়ে অনেক ঝক্কিও গেছে। প্রচুর মানুষ চিঠি দিয়ে তাকে অভিনন্দন ও সমর্থন জানিয়েছে। পত্রপত্রিকায় তাকে নিয়ে খবর বেরিয়েছে, ‘আমেরিকার সেরা বস’ এর খেতাব পেয়েছেন। কিন্তু গ্র্যাভিটিরই অনেক গ্রাহক এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছে। তারা এটিকে রাজনৈতিক রঙ দিয়েছে। ওই সময় সিয়াটলে ন্যূনতম মজুরি ১৫ ডলার করা নিয়ে বিতর্ক চলছে, তখনটার সময়ে ‍যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ছিল এটি। ছোট ব্যবসায়ীরা রীতিমতো যুদ্ধে নেমেছিলেন এটির বিরুদ্ধে। রাশ লিবাউ নামে একজন রেডিও সেলিব্রেটি তাকে ‘কমিউনিস্ট’ আখ্যা দিয়েছিলেন। এমনটি গ্র্যাভিটির দুইজন জ্যেষ্ঠ কর্মী এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে চাকরি ছাড়েন। তাদের ধারণা ছিল রাতারাতি বেতন বেড়ে যাওয়ায় জুনিয়র কর্মীরা অলস হয়ে যাবে। প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে। 

এতে যে উল্টো ঘটনা ঘটেছে সেটি জানান গ্র্যাভিটির বিক্রয় পরিচালক রোসিটা বারলো, তিনি এ কোম্পানির শুরুর দিকের কর্মী। বেতন বাড়ানোর কারণে জুনিয়র কর্মীরা আরো বেশি কাজ করছে। ফলে সিনিয়রদের কাজের চাপ কমেছে। তিনি বলেন, কারণ আপনাকে যখন জীবনযাপনের ব্যয় নিয়ে ভাবতে হবে তখন কর্মস্থলে মনোযোগ দিতে পারবেন না। রোসিটা বারলো নিজেও এমন পরিস্থিতির শিকার ছিলেন। শুরুতে ড্যান প্রাইস খুব হিসেবি ছিলেন। পাগলের মতো টাকা জমাতেন। কর্মীদের বেতন ছিল বেশ কম।  যদিও নিজে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন তিনি। মাস চালাতে রোসিটার খুব কষ্ট হতো। গোপনে ম্যাকডোনাল্ডসে কাজ করতেন। একদিন ধরা পড়ে যান। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে বেতন এক লাফে বাড়িয়ে ৪০ হাজার ডলার করা হয়। ন্যূনতম বেতন ৭০ হাজার করার আগের ঘটনা এটি।

আরেক কর্মীর উদাহরণ টেনে ড্যান প্রাইস বলেন, সেই কর্মী কম ভাড়ায় বাসা পেতে দূরে থাকতেন। গাড়ির টায়ার ছিল পুরনো। এ নিয়ে সব সময় উদ্বিগ্ন থাকতেন তিনি। কিন্তু ন্যূনতম বেতন ৭০ হাজার করার পর তিনি অফিসের কাছে বাসা নিলেন। এখন ভালো বাসায় থাকেন, ভালো খান, নিয়মিত জিমে যান। এতে তার উৎপাদনশীলতা অনেকখানি বেড়ে গেছে। এ কারণেই গ্র্যাভিটি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি আয় করছে বলে মনে করেন প্রাইস। তার মতে, বেতন বাড়ালে কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়ে এমন নয়, এতে কর্মীদের সক্ষমতা বাড়ে।

কর্মীদের উপহার দেয়া টেসলা গাড়ি

এটি করতে গিয়ে অনেক কিছু ত্যাগ করেছেন ড্যান প্রাইস। নিজের বেতন ১১ লাখ ডলার থেকে কমিয়ে ৭০ হাজার ডলারে এনেছেন। জীবনযাপনে এনেছেন আমূল পরিবর্তন। স্বচ্ছল থাকতে নিজের বাড়িটি এয়ারবিএনবিকে ভাড়া দিয়েছেন। ১২ বছরের পুরনো একটি অডি গাড়ি নিয়ে অফিসে আসতেন। এটি দেখে কর্মীরা গোপনে চাঁদা তুলে ২০১৬ সালে তাকে একটি দামি টেসলা গাড়ি উপহার দেয়। কর্মীদের এই ভালোবাসায় কেঁদে ফেলেছিলেন প্রাইস। ইউটিউবে সেই ভিডিও তখন ভাইরাল হয়েছিল। 

সেই সাহসী সিদ্ধান্তের পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। এখন নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করেন প্রাইস। তিনি চান অন্য বড় কোম্পানিগুলো তাকে অনুসরণ করুক। বোস্টনের ফার্মালজিক, আটলান্টার রেন্টেড ডটকম তার অনুসরণেই ন্যূনতম বেতন ৫০ হাজার ডলার করেছে। তবে এ সংখ্যা একেবারে নগণ্য।

বিবিসি অবলম্বনে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন