ব্যবসায়িক সাফল্যের দেখা পাচ্ছে না অটোগ্যাস

শামীম রাহমান

গাড়ির জ্বালানি হিসেবে দেশে অটোগ্যাসের ব্যবহার শুরু হয় ২০০৫ সালের দিকে। নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় সরকারও এটিকে প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করে। এর অংশ হিসেবে ২০১৫ সালে বন্ধ করে দেয়া হয় অটোগ্যাসের প্রতিদ্বন্দ্বী সিএনজি স্টেশনের অনুমোদন। বিপরীতে বসুন্ধরা, ওমেরা, বেক্সিমকো, বিএম, পেট্রোম্যাক্স, এনার্জিপ্যাকের মতো দেশের বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয় প্রায় এক হাজার অটোগ্যাস স্টেশন স্থাপনের লাইসেন্স। যদিও এখন পর্যন্ত জ্বালানি হিসেবে অটোগ্যাস ব্যবহার করছে মাত্র ১০ হাজারের মতো গাড়ি।

একদিকে সরকারের নীতিগত সহায়তা, অন্যদিকে বড় করপোরেটদের অংশগ্রহণ সত্ত্বেও সাফল্যের দেখা পাচ্ছে না দেশের অটোগ্যাস খাত। অটোগ্যাস ব্যবসায়ীরা বলছেন, মূলত প্রতিদ্বন্দ্বী জ্বালানি সিএনজির কারণেই সাফল্য আসছে না খাতটিতে। স্টেশনের সরঞ্জাম ও গাড়ি রূপান্তর যন্ত্রাংশের ওপর আরোপিত শুল্ক-করও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এছাড়া অটোগ্যাসের প্রতি পরিবহন মালিকদেরও আগ্রহ কম।

দেশে নিবন্ধিত মোটরযানের সংখ্যা ৪৩ লাখের বেশি। পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর তথ্য বলছে, এর মধ্যে চলাচলরত গাড়ির সংখ্যা ৩০ লাখের মতো। জ্বালানি হিসেবে এসব গাড়ি মূলত ডিজেল, পেট্রল, অকটেন ও সংকুচিত প্রাকৃতি গ্যাস বা সিএনজি ব্যবহার করে। সরকারের রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) হিসাবে, সিএনজিতে চলা গাড়ির সংখ্যা ৫ লাখ ৪ হাজার। এসব গাড়ি জ্বালানি সংগ্রহ করছে দেশের ৫৩৮টি সিএনজি স্টেশন থেকে।

অন্যদিকে দেশে এলপিজি স্টেশন আছে কমবেশি ১০০টি। বাংলাদেশ এলপিজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভারশন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত অটোগ্যাসে রূপান্তরিত গাড়ির সংখ্যা ১০ হাজারের মতো।

অটোগ্যাসের প্রতি আগ্রহ কম থাকার কারণ হিসেবে দাম নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকার কথা জানিয়েছেন পরিবহন মালিকরা। অটোগ্যাস ব্যবহারকারীরা বলছেন, এটি ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গাড়ির ইঞ্জিন। রিচার্জ করার সময় একবারে অনেক টাকার গ্যাস কিনতে হয়। এসব কারণে সাশ্রয়ী হলেও অনেকেই গাড়িতে অটোগ্যাস ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

ব্যবসায়ী ও ব্যবহারকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৫০০ সিসির একটি গাড়ির অটোগ্যাস ধারণক্ষমতা ৬০ লিটার। একবার ফুল রিচার্জে একটা গাড়ি হাইওয়েতে ৪০০-৪৫০ কিলোমিটার চলতে পারে। ঢাকায় চলে ৩০০-৩৫০ কিলোমিটার। বিপরীতে সমপরিমাণের এক সিলিন্ডার সিএনজিতে একটি গাড়ি চলতে পারে ৮০-৯০ কিলোমিটার। বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার সিএনজির দাম ৪৩ টাকা। আর এক লিটার অটোগ্যাসের বাজারমূল্য ৫০ টাকা।

তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) যখন গাড়িতে ব্যবহার হয়, তখন সেটিকে অভিহিত করা হয় অটোগ্যাস নামে। ক্লিন বা গ্রিন ফুয়েল হিসেবে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি আছে এ গ্যাসের। অটোগ্যাস উন্নত দেশগুলোয় গাড়ির প্রধান জ্বালানি। উন্নয়নশীল অনেক দেশও ঝুঁকছে এতে। গাড়ির জ্বালানি হিসেবে অটোগ্যাস যেমন সাশ্রয়ী, তেমনি পরিবেশবান্ধবও। সিএনজির চেয়ে ওজন এক-তৃতীয়াংশ কম। সিলিন্ডারে চাপ কম থাকায় বিস্ফোরণের ঝুঁকিও অনেক কম। আবার অটোগ্যাস পরিবহনযোগ্য হওয়ায় দেশের যেকোনো প্রান্তেই ফিলিং স্টেশন করা সম্ভব। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে গাড়ির জ্বালানি হিসেবে অটোগ্যাসকে প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব ড. মহ. শের আলী এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের নীতিগত বিষয় হচ্ছে, আমরা সিএনজি আর নতুন করে অনুমোদন দেব না। অটোগ্যাসের জন্য কেউ যদি এগিয়ে আসে, সেক্ষেত্রে আমরা নীতিগত সহায়তা দেব। এটা পুরোপুরি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা নিজ উদ্যোগে এলপিজি আমদানি ও বিপণন করছেন। মূলত গৃহস্থালি ও যানবাহনে ব্যবহারের জন্য এটা করা হচ্ছে। কেউ অটোগ্যাস ফিলিং স্টেশন করতে চাইলে আমরা তাদের কারিগরি ও নিরাপত্তা সহায়তাও দিচ্ছি।

অটোগ্যাস খাতের সঙ্গে যুক্ত দেশের অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপ। সারা দেশে ৩০০টির মতো অটোগ্যাস স্টেশনের অনুমোদন পেয়েছে গ্রুপটি। বর্তমানে ২০টির মতো স্টেশনের নির্মাণকাজ চলছে।

সরকারের এমন উদ্যোগের পরও এখনো অটোগ্যাস খাত সাফল্যের মুখ দেখছে না কেন জানতে চাইলে বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের হেড অব সেলস প্রকৌশলী জাকারিয়া জালাল বণিক বার্তাকে বলেন, এখন পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি গাড়ি অটোগ্যাসে রূপান্তর হয়নি। চাহিদা না থাকায় সেভাবে অটোগ্যাস স্টেশনও গড়ে উঠছে না। এজন্য মূলত দায়ী সিএনজির দামের সঙ্গে অটোগ্যাসের পেরে না ওঠা। ১০ বছর আগে সিনএনজির দাম ছিল প্রতি ঘনমিটার ১০ টাকা। তখন এলপিজির দাম ছিল লিটারপ্রতি ৫০ টাকার কাছাকাছি। সিএনজির মতো সস্তা জ্বালানির কাছে অটোগ্যাস মার খেয়েছে। সস্তায় সিএনজি পাওয়ায় মালিকরা তখন গাড়ি অটোগ্যাসে রূপান্তর করতে চাননি।

আঞ্চলিক কারণও অটোগ্যাসের ব্যবসা সম্প্রসারণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে যত গাড়ি রেজিস্ট্রেশন হয়, তার ৯৬ শতাংশ রেজিস্ট্রেশন ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে। অন্যদিকে অটোগ্যাস চলত এ তিন বিভাগীয় শহরের বাইরে খুলনা ও রাজশাহীতে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে অটোগ্যাসের প্রচলন না থাকার কারণেই মূলত এখন পর্যন্ত এর ব্যবসাটি সেভাবে সম্প্রাসরণ হয়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে চিত্রটি বদলাতে শুরু করেছে।

অটোগ্যাস খাতে বিনিয়োগ করেছে দেশের আরেক শীর্ষস্থানীয় এলপিজি বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ওমেরা ফুয়েলস। এখন পর্যন্ত কোম্পানিটি ২২টি অটোগ্যাস স্টেশন স্থাপন করেছে, যার মধ্যে ১৭টি অপারেশনে রয়েছে। তাছাড়া পাইপলাইনে আছে আরো ১৮টি স্টেশন।

সরকার অটোগ্যাসকে উৎসাহী করা সত্ত্বেও খাতটিতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না আসার পেছনে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতার কথা জানিয়েছেন ওমেরা ফুয়েলসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আক্তার হোসেন সান্নামাত। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও গ্যাস সরবরাহের বিপরীতে অতিরিক্ত হারে মূসক দিতে হচ্ছে। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক ও কর পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে আমাদের খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, লাইসেন্স নিলেও অনেকের মধ্যেই এ দ্বিধা কাজ করছে যে গাড়ি কনভারশনের আগে স্টেশন স্থাপন করা হলে সেটি ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক হবে কিনা? কোম্পানিগুলো যাতে অটোগ্যাস ফিলিং স্টেশন স্থাপনে আরো বেশি করে এগিয়ে আসে, এজন্য কর, শুল্ক ও মূসকের ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া প্রয়োজন বলে জানান তিনি।

এদিকে অটোগ্যাস ব্যবহারকারীরা বলছেন, এটি ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গাড়ির ইঞ্জিন। আবার রিচার্জ করার সময় একবারে অনেক টাকার গ্যাস কিনতে হয়। এসব কারণে অনেকেই গাড়িতে অটোগ্যাস ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে দেশে গাড়ির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত তৌফিক ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, অটোগ্যাসের একটা বড় সমস্যা একসঙ্গে অনেক টাকার গ্যাস কিনতে হয়। পাশাপাশি আমাদের দেশে সঠিকভাবে ঠিকমতো অটোগ্যাসে রূপান্তর হয় না। ফলে ইঞ্জিনের আয়ু কমে যায়। অটোগ্যাসচালিত গাড়ির টেকনিশিয়ানও কম। এসব বিষয় গাড়ি মালিকদের অটোগ্যাস ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করে বলে মনে করেন তিনি।

একই ধরনের কথা বলেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতুল্লাহ। তিনি বলেন, গাড়ির ইঞ্জিনের ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি অটোগ্যাসের দামের কথাও চিন্তা করেন মালিকরা। অটোগ্যাসের দাম ওঠানামা করে। এখন হয়তো দাম কম, কিন্তু ভবিষ্যতে এটার দাম যে বাড়বে না এমন তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ কারণে অনেক মালিকই গাড়ি অটোগ্যাসে রূপান্তর করতে চান না।

পরিবহন মালিকরা অনীহার কথা বললেও জ্বালানি হিসেবে অটোগ্যাসের বিপুল সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ এলপিজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভারশন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব হাসিন পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, এলপিজি বা অটোগ্যাস দামে সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব। এর সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঝুঁকি কম। সব মিলিয়ে দেশের জ্বালানি খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে অটোগ্যাস। বর্তমানে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কমবেশি ১০০টি অটোগ্যাস স্টেশন আছে। আরো কয়েকশ স্টেশন তৈরি হওয়ার পথে। মানুষের মধ্যেও অটোগ্যাসের বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে। তবে গাড়িতে অটোগ্যাস ব্যবহারে সরকারকে আরো এগিয়ে আসতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন