দিনগুলো ছিল ঈদের মতো রাত শব-ই-বরাত

১৮৫৭ সাল। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখা দেয় সিপাহি বিদ্রোহের চেহারায়। যার ধারাবাহিকতায় অবসান ঘটে কোম্পানি শাসনের। শুরু হয় ব্রিটিশরাজ। নিভে যায় মোগলদের শাসনপ্রদীপ। শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের স্নেহধন্য কবি জহির দেহলভির ওই সময়ের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থকে ইংরেজিতেদাস্তান--গদর: দ্য টেল অব দ্য মিউটিনি নামে প্রকাশ করেছে পেঙ্গুইন র‍্যানডম হাউজ ইন্ডিয়া। সিপাহি বিদ্রোহের এ অমূল্য দলিলটিকে বাংলায় প্রকাশের স্বত্ব পেয়েছে বণিক বার্তা। শানজিদ অর্ণবের রূপান্তরে ধারাবাহিক আয়োজন

নিত্যকার্যসূচি ও শখ-আহ্লাদ

আমি ঘুম থেকে উঠতাম খুব সকালে। এমনকি ফজরের আজান হওয়ার আগে। এরপর ঘোড়ায় চড়ে কর্মস্থলে যেতাম। অন্য কিছু করার আগে আমি কিলা--মোয়াল্লার নিচে জমা হওয়া ভিড়ে যোগ দিতাম। এই ভিড় হুজুর পুরনূর-এর এক ঝলক পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করত। তিনি মুসাম্মান বুর্জে জের--ঝারোখায় আসতেন। হুজুর এলে বেশ রব উঠত। আমি হাওয়াদারের সঙ্গে যেতাম। আমার কোমরে কলমদান বাঁধা থাকত। শোরগোলের মধ্যেই যেসব কবিতা আবৃত্তি হতো, আমি সেগুলো যতটা সম্ভব লিখে রাখতাম।

কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর সবাইকে ঘোড়ায় চড়ার জন্য রাজকীয় আদেশ জারি হতো।

সওয়ারি--মুবারকের (বা সম্রাটের পবিত্র বাহন) পেছনে দুটো হাতি ছিল। এর একটিতে আমি চড়তাম। এক্ষেত্রে চড়ার বাহন হিসেবে হাতি আর ঘোড়ার মধ্যে অদলবদল করতাম। মোটকথা হলো সকাল ৯টার পর আমি বাড়ি ফিরে যেতাম।

আমার একটা পৃথক কামরা ছিল, যেখানে আমি সময় কাটাতাম এবং বাইরের মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতাম। আমার ছোট ভাই উমরাও মির্জা আনোয়ার ও চাচাতো ভাই আমির মির্জা খুরশিদও এখানে আমার সঙ্গে সময় কাটাত। আমার বন্ধুরা এই বসার ঘরে আসত সকাল ৯টার পর।

কয়েকজন ছাত্রও আসত আমাদের কাছে পরামর্শ নিতে। ২ ঘণ্টা ধরে আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। নিজেরা যে দ্বিপদীগুলো লিখেছি, সেগুলো নিয়ে কথা হতো। কবিতা ও কবিতার বিশ্লেষণ নিয়ে রচিত ফারসি গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করতাম। আমাদের এই আড্ডা বেলা ১১টায় ভেঙে যেত।

আমি বাড়ির ভেতরে গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে দুই ঘণ্টা বিশ্রাম করতাম। এরপর স্থানীয় বন্ধুরা একত্র হয়ে গাঞ্জিফা ও চওসার খেলতাম।

বিকাল ৫টায় আমি ঘোড়ায় চেপে বাজারের দিকে ঘুরতে যেতাম। মাগরিবের নামাজের পর আমি বাসায় ফিরে আসতাম। আবার আমার বন্ধুরা বাসায় আসত এবং আমরা নানা ধরনের বিনোদনকর্মে যুক্ত হতাম। যারা আসত তাদের মধ্যে অনেকে সেতার ও তবলা বাজাতে পারত। এরা এলে ব্যাপারটা আমাদের সবার জন্য খুব আনন্দের হতো। মাঝে মাঝে দু-একজন বন্ধু আগে চলে গেলেও প্রায় সবাই রাত ১১টা পর্যন্ত থাকত। এটা আমাদের সবার জন্যই দারুণ একটা উপভোগ্য আড্ডা ছিল।

আমাদের দুনিয়ায় কোনো উদ্বেগ ছিল না। আমাদের প্রতিটি দিন ছিল ঈদের মতো আর রাতগুলো ছিল শব--বরাতের মতো। আমরা শুধু হাসিঠাট্টা আর আনন্দ করতাম। এমন কোনো মেলা বা উৎসব ছিল না, যেখানে আমরা হাজির থাকতাম না।

আমাদের দলে ছিল শহরের ধনী, অভিজাত আর ভদ্র তরুণরা। দলে এমন কেউ ছিল না যে যথেষ্ট মার্জিত, সংস্কৃতিমনা নয়। শহরের ভদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা কাব্যশিল্পে দক্ষতা অর্জন করত, একমাত্র তারাই আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে আসত এবং আমাদের মজমায় যোগ দিত। দিল্লিতে যদি প্রতিভাবান কোনো লেখক-কবি আসতেন, তাহলে তিনি অবশ্যই একবার হলেও আমার বাড়ি হয়ে যেতেন।

বিদ্রোহ শুরুর আগ পর্যন্ত আমরা এই আনন্দের মধ্য দিয়ে দিন কাটিয়েছি।

বিদ্রোহের চার মাস আগে আমি বিয়ে করেছিলাম। তখন আমার বয়স ছিল বাইশ।

বিদ্রোহ আমাদের মাথার ওপর একের পর এক অনেকগুলো দুর্যোগ আছড়ে ফেলল। বন্ধুরা সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছিল। আমাদের সব আরাম আর বিলাস কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

চাকরি

বাবা আমার জন্য উদারহস্তে খরচ করতেন। কোনোদিন আমি কোনো কিছুর অভাব বোধ করিনি। মাসে আমি ৫০ রুপি বৃত্তি পেতাম। আমার কাব্য প্রতিভায় মুগ্ধ পাটিয়ালার রাজা অজিত সিংয়ের চাচা আমার প্রতি উদার ও অকৃপণ ছিলেন। ঘোড়া বেচাকেনা করেও আমি কিছু অর্থ উপার্জন করতাম। সব মিলিয়ে আমি কখনো অর্থকষ্টে ছিলাম না।

তার প্রশংসায় রচনা করা একটি গজলের জন্য পাটিয়ালার রাজা অজিত সিং আমাকে ১ হাজার রুপি পুরস্কার দিয়েছিলেন। এছাড়া তিনি আমাকে স্বর্ণের কারুকাজ করা একটি দামি শাল, একটি পাগড়ি এবং আরো কিছু বিলাসদ্রব্য উপহার দিয়েছিলেন।

আমার বয়স যখন তেরো, তখন মায়ের চাচা মির্জা খান সাহেব মারা যান। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তার পদবি ছিল দারোগা--মাহি-মারাতিব, রাজকীয় মত্স্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা। এটা সর্বোচ্চ শ্রেণীর পদের একটি সম্মানীয় খেতাব। তার মৃত্যুর পর পদটি ফাঁকা হয়েছিল। অনেক আগ্রহী পদটির জন্য আবেদন করেন। আমাকে ততদিনে সম্রাটের সামনে হাজির করা হয়েছে এবং আট বছর বয়স থেকেই আমি মহলের নিয়মিত দর্শনার্থী। আমি সম্রাটের একজন শিষ্য হয়ে গিয়েছিলাম। কবিতা সংশোধনের জন্য আমি সম্রাটের কাছে যেতাম। বাবা এবার সুযোগটা ব্যবহার করতে চাইলেন এবং ফাঁকা পদে আমার নাম প্রস্তাব করলেন। বাবা অনুরোধ করলেন, আমাকে যেন আমার যোগ্যতা প্রমাণের এবং সম্রাটের মহিমান্বিত জীবনের সেবা করার একটা সুযোগ দেয়া হয়।

সম্রাট উদারভাবে সাড়া দিলেন এবং আমাকে দারোগা--মাহি-মারাতিব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো। আমার নাম হলো রাকিমউদ্দৌলা সৈয়দ জহিরউদ্দিন হুসাইন খান। এছাড়া আমাকে দারোগা--কাজবেগি করা হলো এবং খাজা কুতুবউদ্দিনের খিলাত দেয়া হলো।

সম্রাট যখন খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকির (মেহরুলিতে অবস্থিত) পবিত্র দরগায় হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন, তখন আমার দায়িত্ব ছিল তাকে সঙ্গ দেয়া। এবং তিনি যতদিন ছিলেন, আমি ততদিন তার সেবায় সেখানে উপস্থিত ছিলাম। এ সময় আমার খাবার আসত প্রাসাদ থেকে। একদিনও আমি এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হইনি। তেরো থেকে বাইশ বছর পর্যন্ত আমি নিরলসভাবে আমার দায়িত্ব পালন করে গিয়েছি।

বিদ্রোহের পর যখন সম্রাটের সব কর্মচারীর চাকরি চলে যায়, তখন আমারটাও বাদ পড়েনি।

বিয়ে

তেরো বছর বয়সে আমার বাগদান হয়ে গিয়েছিল। তিন বছর পর আমার নিকাহ উৎসব পালিত হয়। তবে বিয়ের উৎসবের সঙ্গে সম্পর্কিত সানচাক, মেহেন্দি, বারাত, চৌথির মতো অনুষ্ঠানগুলো অনুষ্ঠিত হয়নি। আমার স্ত্রীও তার মায়ের বাড়িতে যায়নি এবং তার বিয়ের পোশাকসজ্জা এসে পৌঁছার পর সেগুলো আমাদের বাড়ির একটি কক্ষেই রাখা হয়েছিল।

আমি তখন বেশ ছোট, তাই ওই বয়সে আমার স্ত্রীকে বাড়িতে নিয়ে আসতে অস্বস্তি বোধ করছিলাম। আমি স্রেফ আলসেমি করে দিন পার করছিলাম। এটা আমার বাবাকে এতটা রাগিয়ে দিয়েছিল যে উনি আমার সালাম নেয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দেন।

যাই হোক, মা আমাকে বাবার কাছে নিয়ে গেলেন এবং তার পায়ে নিয়ে ফেললেন এবং বাবা আমাকে ক্ষমা করলেন। অনুষ্ঠান পালন করা এবং বিয়ে করতে আমি রাজি হলাম।

আমার বিয়ের অনুষ্ঠান এবার খুব ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়েছিল। সঙ্গে আনুষঙ্গিক রীতি ও উৎসবও পালিত হয়েছিল। আমার স্ত্রীকে প্রথা অনুসারে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে তার স্বামীর বাড়িতে প্রেরণ করা হয়েছিল। তাকে ৫ হাজার রুপি দামের বিয়ের পোশাক দেয়া হয়েছিল। সবকিছু হাসিখুশিভাবে শেষ হয়েছিল এবং সবাই সন্তুষ্ট ছিলেন।

অনুষ্ঠান শেষে আমার স্ত্রীর বিয়ের পোশাক তালাবদ্ধ করে রাখা হয় এবং আমরা বাড়ির জিনিসপত্রই ব্যবহার করা শুরু করি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন