চীনের
হুবেই প্রদেশে প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়া নভেল করোনাভাইরাস ডিজিস বা কভিড-১৯ এখন আর দেশটির একার জন্য উদ্বেগের বিষয় নয়। ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া—সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে মরণঘাতী ভাইরাসটি। প্রতিদিনই এসব অঞ্চলের নতুন
নতুন দেশে সংক্রমিতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে যে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সতর্ক করে বলছে, নভেল করোনাভাইরাসের লাগাম টেনে ধরতে
বিশ্ব এখনো প্রস্তুত নয়। এজন্য এখনই জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে
জাতিসংঘের বিশেষ এ সংস্থাটি। খবর এএফপি।
গত
ডিসেম্বরের শেষের দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানের নভেল করোনাভাইরাসের
প্রথম প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে এটি মহামারী আকার ধারণ করে।
সর্বশেষ গতকাল পর্যন্ত দেশটিতে সংক্রমিত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭১৫
জনে। এর মধ্যে গতকাল মারা গেছেন ৫২ জন,
যা তিন সপ্তাহের
মধ্যে সর্বনিম্ন। এছাড়া হুবেই প্রদেশের বাইরে চীনে এদিন কোনো মৃতের ঘটনা ঘটেনি। আর
দেশটিতে সংক্রমিতের সংখ্যা ৭৮ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে নতুন করে সংক্রমিত হয়েছেন
৪০৬ জন। যার মাত্র পাঁচজন হুবেই প্রদেশের বাইরের বাসিন্দা। তবে এর বিপরীত চিত্র
চীনের বাইরের দেশগুলোতে। গতকাল পর্যন্ত চীন ছাড়া অন্য দেশগুলোয় মৃতের সংখ্যা
দাঁড়িয়েছে ৪০ জনে। আর আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২ হাজার ৭০০ জন। নতুন করে সংক্রমিত
দেশের তালিকায় এসেছে ইউরোপের দেশ ক্রোয়েশিয়া,
সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া এবং আফ্রিকার আলজেরিয়ার নাম।
চীনের বাইরে আক্রান্ত দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটিতে গতকাল পর্যন্ত কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। সংক্রমিত হয়েছেন ১ হাজার ১৪৬ জন। এর মধ্যে দেশটিতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের এক সেনাসদস্যও রয়েছেন। ওই মার্কিন সেনা দেশটির সংক্রমিত নগরী দাইগুর ক্যাম্প ক্যারোলে নিযুক্ত রয়েছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার চতুর্থ বৃহৎ নগরী দাইগু। দেশটিতে সংক্রমিতের ৯০ শতাংশ এ শহরের বাসিন্দা। ২৫ লাখ বাসিন্দার শহরটিতে মাস্ক বিক্রির দোকানগুলোতে দীর্ঘ লাইন ছাড়া কার্যত জনশূন্য অবস্থা বিরাজ করছে।
দক্ষিণ
কোরিয়ার পর নভেল করোনাভাইরাস এখন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে ইরান ও ইতালিতে। এর মধ্যে
মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়া ইরানে গতকাল আরো তিনজন মারা গেছেন। এ
নিয়ে দেশটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৫ জনে। আর সংক্রমিত
হয়েছেন ১০০ জনের বেশি। এর মধ্যে ইরানে ভাইরাসটি মোকাবেলায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া
দেশটির স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী ইরাজ হারিরসি সংক্রমিত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন
মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আলীরেজা ভাহাবজাদিহ।
ইরানের
ধর্মীয় দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় নগরী কোয়ামে
গত সপ্তাহে সর্বপ্রথম ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হয়ে মৃতের ঘটনা ঘটে। এরপর দেশটি থেকে
মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে ইরান থেকে ইরাক, লেবানন, ইসরায়েল, বাহরাইন, ওমান, কুয়েত ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হয়েছে। এর
মধ্যে গতকাল ওমানে দুজন, ইরাকে চারজন ও বাহরাইনে নতুন করে নয়জন
নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন।
পরিস্থিতি
মোকাবেলায় ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করছে উপসাগরীয় দেশগুলো।
ইরানের চিরবৈরী যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও মনে করেন, ইসলামিক রিপাবলিক দেশটি ভাইরাসটির বিষয়ে অনেক তথ্য গোপন করতে পারে।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রও ভাইরাসটিতে সংক্রমিতের বাইরে নেই। দেশটিতে এরই মধ্যে
সংক্রমিতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ জনে। মার্কিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন,
যুক্তরাষ্ট্র
থেকে ভাইরাসটি আরো দ্রুত ছড়াতে পারে।
আর
হটস্পটের তালিকায় থাকা ইতালিতে গতকাল পর্যন্ত নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে
মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ জনে। এছাড়া আক্রান্ত হয়েছেন ৩০০ জনের বেশি। পরিস্থিতি
মোকাবেলায় দেশটি ১১টি শহরকে লক ডাউন বা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। জরুরি অবস্থার জন্য
স্টেডিয়াম খালি রাখতে দেশটির আসন্ন একটি ফুটবল খেলার আয়োজন স্থগিত করা হয়েছে।
ইতালি ভ্রমণ করে ফেরা ক্রোয়েশিয়ার এক যুবকের শরীরে গতকাল ভাইরাসটির উপস্থিতি পাওয়া
গেছে। বলকান অঞ্চলের মধ্যে ক্রোয়েশিয়া এ প্রথম আক্রান্ত দেশের তালিকায় এসেছে।
ইউরোপের আরেক দেশ অস্ট্রিয়ায় নতুন করে সংক্রমিতের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। এছাড়া
স্পেনের কাতালোনিয়ায় সংক্রমিত একজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এ প্রথম দেশটির মূল
ভূখণ্ডে কেউ সংক্রমিত হলেন। এর আগে দেশটির ক্যানারি ও ম্যালোরকা আইল্যান্ডে
জার্মানি, ইতালি ও ব্রিটেন থেকে আসা তিনজনকে নভেল
করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হিসেবে শনাক্ত করা হয়। সব মিলিয়ে বিশ্বব্যাপী ভাইরাসটিতে
সংক্রমিতের সংখ্যা ৮০ হাজার ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
ডব্লিউএইচওর
পক্ষ থেকে চীনে ভাইরাস মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দলের নেতৃত্ব দেয়া ব্রুস
আইলওয়ার্ড সতর্ক করে বলেন, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ভাইরাসটির লাগাম
টেনে ধরতে বিশ্ব প্রস্তুত নয়। আক্রান্ত দেশসহ অন্যান্য দেশকে এটি মোকাবেলায় জরুরি
ভিত্তিতে বড় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান জেনেভাভিত্তিক সংস্থাটির এ কর্মকর্তা।