দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত
কোম্পানিগুলো অনেক সময় শেয়ারদরকে প্রভাবিত করার জন্য প্রান্তিক আর্থিক প্রতিবেদনে
অস্বাভাবিক মুনাফা বা লোকসান দেখিয়ে থাকে। প্রান্তিক ফলাফলের সঙ্গে অনেক সময়
বার্ষিক ফলাফলের সামঞ্জস্য পাওয়া যায় না। এভাবে অসত্য তথ্য প্রদানের মাধ্যমে
কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের সর্বস্বান্ত করছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ
অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের
(বিএসইসি)
চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম
খায়রুল হোসেন। তিনি গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে সিকিউরিটিজ কমিশন ভবনে বাংলাদেশ
একাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেটসের
(বিএএসএম)
উদ্যোগে আয়োজিত ‘ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট
অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ডিটেকশন অব ফ্রড’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব কথা বলেন। পুঁজিবাজার বিটের সাংবাদিকদের জন্য
আয়োজিত এ সেমিনারে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএসইসির
চেয়ারম্যান বলেন, আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর পুঁজিবাজার-সংক্রান্ত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন ও
ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট
(এফআরএ)
প্রণয়নের বিষয়টি অন্যতম দাবি ছিল। বর্তমান
কমিশনের উদ্যোগে পুঁজিবাজারে যে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে, এর
মধ্যে এফআরএ ছিল অন্যতম। আর এর পরিপ্রেক্ষিতেই পরবর্তী সময়ে ফিন্যান্সিয়াল
রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি) গঠন করা হয়। আজকের এ সেমিনারের উদ্দেশ্য হচ্ছে সাংবাদিকরা যাতে
ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্টে যেসব জালিয়াতি হয়,
সেগুলো ঠিকমতো অনুধাবন করে তাদের প্রতিবেদনের
মাধ্যমে সেগুলো তুলে ধরতে পারেন। আইপিও নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়। আমরা চাই আইপিও
অনুমোদনের আগেই যাতে সাংবাদিকরা বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি তাদের লেখনীর মাধ্যমে তুলে
ধরতে পারেন। এতে আমরা আরো শক্তিশালী হব এবং বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হবেন।
বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দেয়া কমিশনের
অন্যতম উদ্দেশ্য উল্লেখ করে ড.
এম খায়রুল হোসেন বলেন, বিএসইসির
অনলাইন মডিউল চালুর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের ৯৫ শতাংশ সমস্যা সমাধান করা হয়েছে।
ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিংয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে ফিন্যান্সিয়াল
স্টেটমেন্ট। ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট কোম্পানি, বিশ্লেষক, বিনিয়োগকারী, একীভূতকরণ
ও অধিগ্রহণ, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল,
প্রাইভেট ইকুইটি ও ইমপেক্ট ফান্ডে বিনিয়োগ এবং
ক্রেডিট রেটিং করার ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়। কিন্তু ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্টে যদি
প্রকৃত আর্থিক অবস্থা উঠে না আসে,
তাহলে এটি কোনো কাজে দেবে না। বিশ্বের উন্নত
দেশগুলোয় ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্টে প্রকৃত চিত্র উঠে এলেও আমাদের এখানে তার
উল্টোটা হয়। ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্টের আর্থিক তথ্য যদি ভুল ইনপুট দেয়া হয়, তাহলে
ফলাফলও ভুলই আসবে। এতে বিনিয়োগকারী,
পুঁজিবাজার ও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্টের ক্ষেত্রে
নিরীক্ষকদের ভূমিকার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট তৈরি করে
কোম্পানি। আর প্রচলিত আইন ও বিধি-বিধান, হিসাবমান অনুসারে ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট তৈরি করা হয়েছে কিনা, সেটি
নিরীক্ষা করার দায়িত্ব নিরীক্ষকের। অনেক সময় নিরীক্ষকরা অভিযোগ করে থাকেন, কোয়ালিটি
অডিট করতে যে পরিমাণ ব্যয় হয়,
তার তুলনায় নিরীক্ষা ফি অনেক কম। এজন্য আমরা
নিরীক্ষকদের নিয়ে একটি সেমিনার করব। সেখানে তাদের দায়দায়িত্ব ও দুর্বলতাগুলো আমরা
তুলে ধরব। নিরীক্ষকদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসার পাশাপাশি ফি-সংক্রান্ত
সমস্যা সমাধানে আমরা কাজ করব।
তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর প্রান্তিক
প্রতিবেদনে অস্বাভাবিক উত্থান-পতনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, অনেক
সময় দেখা যায়, প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানির লোকসান হয়েছে। এরপরের প্রান্তিকেই আবার
মুনাফা দেখায়। আবার তৃতীয় প্রান্তিকে লোকসান এবং বছর শেষে দেখা যায় শেষ প্রান্তিকে
বড় ধরনের মুনাফা হয়েছে। প্রান্তিক প্রতিবেদনে এ ধরনের অস্বাভাবিক উত্থান-পতনের কারণে
কোম্পানির শেয়ারদর প্রভাবিত হয়। আর এ ধরনের অসত্য মূল্য সংবেদনশীল তথ্যের কারণে
বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক সংস্থা হওয়ার
পাশাপাশি নিজেদের অসহায়ত্ব তুলে ধরে ড.
খায়রুল বলেন, ব্যাংক, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মার্চেন্ট
ব্যাংক, ব্রোকারেজ হাউজ,
স্টক এক্সচেঞ্জ, সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি, ক্রেডিট
রেটিং কোম্পানি, তালিকাভুক্ত কোম্পানিসহ পুঁজিবাজারের বাইরে থাকা কোম্পানিগুলোর
কার্যক্রমও আমাদের তদারকি করতে হয়। অথচ কমিশনে মোট লোকবল রয়েছে মাত্র ১৬০ জন। এর
মধ্যে মাত্র ৮৪ জন কর্মকর্তা। বাকিরা তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। অন্যদিকে
ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেখভালের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের
সাত থেকে আট হাজার লোকবল রয়েছে। যদিও অনেক চেষ্টার পর আমাদের অর্গানোগ্রাম চূড়ান্ত
পর্যায়ে রয়েছে কিন্তু এখনো নিয়োগ দেয়ার মতো অবস্থায় আসেনি।
সেমিনারে টেকনিক্যাল সেশনে মূল
প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্টে বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতির বিষয়গুলো
তুলে ধরেন বিএসইসির পরিচালক ও বিএএসএমের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল
করিম। মূল প্রবন্ধের ওপর প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এফআরসির নির্বাহী
পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ,
সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) ব্যবস্থাপনা
পরিচালক শুভ্র কান্তি চৌধুরী,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের সহকারী
অধ্যাপক মোহাম্মদ সালাউদ্দিন চৌধুরী,
বিএসইসির পরিচালক কামরুল আনাম খান ও ক্যাপিটাল
মার্কেট জার্নালিস্ট ফোরামের
(সিএমজেএফ)
সভাপতি হাসান ইমাম রুবেল। সেশনটি সঞ্চালনার
দায়িত্বে ছিলেন বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ আহমেদ।