নাগরিক সেবা

বাংলাদেশে কি আধার অনুকরণ করা যায়?

মামুন রশীদ

আধার হলো ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন অথরিটি অব ইন্ডিয়া (ইউআইডিএআই) কর্তৃক ইস্যুকৃত ভারতের সব নাগরিকের জন্য বিনা মূল্যে একবারের (ওয়ানটাইম) পরিচয়পত্র। এ পরিচয়পত্র হলো বিশ্বের সর্ববৃহৎ বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ প্রকল্প। সবাই আশা করছেন, এ প্রকল্প দীর্ঘস্থায়ী হবে। মানুষের কল্যাণ, আইন প্রয়োগের কার্যকারিতা ও সুশাসনে ব্যাপক প্রভাব রাখবে এবং এটি হবে জাতীয় নিরাপত্তায় অন্তর্ভুক্তির প্রধান হাতিয়ার।

আলোচ্য পরিচয়পত্রে ১২টি স্বতন্ত্র সংখ্যা আছে এবং এটি নিবন্ধিত হয় আঙুলের ছাপ ও জনমিতিক তথ্যের মতো ব্যক্তির বিস্তারিত বায়োমেট্রিক তথ্য নেয়ার মাধ্যমে। এ পরিচয়পত্র প্রাথমিকভাবে ইস্যু করা হয়েছিল ভারতীয় নাগরিকদের জন্য সুনির্দিষ্ট সরকারি সুবিধা ও ভর্তুকি বরাদ্দের প্রক্রিয়া অধিক যৌক্তিকীকরণ এবং এতে স্বচ্ছতা আনার জন্য। এখন এর সুবিধা ও ব্যবহার দায় পরিশোধ বা পেমেন্ট ব্যবস্থা, কর নিয়ন্ত্রক এবং আরো অনেক কিছু হিসেবে আবর্তিত হয়েছে। ফলে ভারতীয় সব নাগরিকের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিলে পরিণত হয়েছে। এখন দেশটির নাগরিকদের ব্যাংক হিসাব খোলা, ঋণের জন্য আবেদন, পেনশন স্কিম থেকে সুবিধা প্রাপ্তি, পাসপোর্ট নিবন্ধন, পরীক্ষা নেয়া এবং আরো অনেক কিছুতে অবশ্যই আধার কার্ড উপস্থাপন করতে হয়। সরকারি ভর্তুকি পেতে একজন নাগরিকের ব্যাংক হিসাবের সঙ্গে আধার কার্ড সংযুক্ত করাও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। 

আধার প্রোগ্রামটি সফলভাবে চালু করার পর থেকে এটি বিভিন্ন দিক থেকে সুবিধা প্রদান করে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে রান্নায় ব্যবহূত গ্যাস বিতরণের জালিয়াতি রোধে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আধারের মাধ্যমে চার কোটির অধিক গ্রাহককে চিহ্নিত করা হয়, যারা জালিয়াতির মাধ্যমে অন্যায়ভাবে রান্নার গ্যাসের সুবিধা ভোগ করে আসছিলেন। এটি চিহ্নিত করার ফলে ভারত সরকার গ্যাস ভর্তুকি বাবদ কোটি কোটি রুপি খরচ কমাতে পেরেছিল।

একটি নগদবিহীন অর্থনীতির দিকে যাত্রার প্রচেষ্টা এবং ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড পেতে অসমর্থ জনগোষ্ঠীকে ডিজিটাল পেমেন্টে তাড়িত করতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৭ সালেআধার পে চালু করেন। এ পরিশোধ ব্যবস্থা স্বতন্ত্র আইডি ও বায়োমেট্রিক যাচাইকরণের মাধ্যমে নিজেদের গ্রাহক থেকে অনায়াসে প্রাপ্য অর্থ সংগ্রহে ব্যবসায়ীদের সহায়তা করে। ব্যবসায়ীদের শুধু অ্যাপের জন্য একটি স্মার্টফোন এবং যাচাইয়ের জন্য একটি বায়োমেট্রিক ডিভাইসে বিনিয়োগ করার প্রয়োজন পড়ে। এ লেনদেন নিরাপদ, কার্যকর এবং ব্যবসায়ীদের সহজেই সমন্বয়ের (রিকনসিলিয়েশন) সুযোগ দেয়। অধিকন্তু লেনদেন ব্যয়ও কম, যেহেতু বিক্রেতা শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ লেনদেন মূল্য পান এবং ন্যূনতম মার্চেন্ট ছাড় হার প্রদান করা হয়।

ফলে যতটা সম্ভব গ্রাহক-ভোক্তার জন্যও পরিশোধ সহজ ও সুবিধাজনক হয়েছে। তাদের কেবল নিজেদের পিন উপস্থাপন করতে হয় এবং কোনো স্মার্টফোন প্রয়োজন হয় না, যতক্ষণ তারা পরিশোধ নোটিফিকেশন দেখার ইচ্ছা প্রকাশ না করেন। বায়োমেট্রিক ব্যবস্থা ও নগদ অর্থের প্রয়োজনহীনতা ব্যাপকভাবে নিরাপত্তা উদ্বেগও কমিয়েছে। 

ভারতের বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনুপস্থিতি নিয়ন্ত্রণে (চেক) ইউআইডি ব্যবহার করায় সরকারি অফিসগুলোয় কর্মীদের কর্মসময় গড়ে ২০ মিনিটের বেশি বেড়েছে। ইনভেস্ট ইন্ডিয়া মাইক্রো পেনশনস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী উল্লেখ করেছেন, -কেওয়াসি প্রবর্তন দলিল প্রক্রিয়ায় সময় ও ব্যয় ৫০ শতাংশ কমিয়েছে। ভারত সরকারের স্কুল শিক্ষাবিষয়ক সচিব মনে করেন, ইউআইডি ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকার সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা, যাদের সাধারণত উপস্থিতির হার কম, তাদের সহজেই তদারক করা যায়। তবে দুর্বল নেটওয়ার্ক এবং বায়োমেট্রিক রিডারের উচ্চব্যয় এ সমাধানের ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধক হিসেবেও কাজ করে।

গবেষণায় উঠে এসেছে ডিজিটাল অবকাঠামো সৃষ্টিতে আধারের প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে আর্থিক ও সামাজিক ট্রান্সফার ঘটে। ওই গবেষণায় আরো উঠে এসেছে যে কল্যাণমূলক কর্মসূচিতে আগে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অনেক বেশি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন প্রকৃতদের শনাক্ত করা অনেক সহজ। দেশটির আরেকটি সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, আধার পে বর্ডার জুড়ে ইন্টারোপেরাবল এজেন্ট নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করতে পারে, যা তাত্ত্বিকভাবে সরকারি পরিশোধ বাস্তবায়ন করে, একই সঙ্গে আর্থিকভাবে বাদ পড়াদের (ফিন্যান্সিয়ালি এক্সক্লুডেড) আর্থিক সেবাও প্রদান করে।

তবে একজনের ইউআইডি দ্বারা সহজেই প্রবেশগম্য তথ্যভাণ্ডার হওয়ায় আধার ডাটাবেজ সাধারণ মানুষের মধ্যে অসংখ্য গোপনীয়তা উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। ইউআইডি সুরক্ষায় ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে ভার্চুয়াল আইডি (ভিআইডি) চালু করা, স্বল্পস্থায়ী ও এলোমেলোভাবে সৃষ্ট নাম্বার। অবশ্য গোপনীয়তা সুরক্ষার জন্য একটি আইন প্রণয়নও জরুরি, যা আধারকে অধিক বিশ্বাসযোগ্য ও নিরাপদ করে তুলবে।

এদিকে প্রথম যখন প্রবর্তন করা হয়েছিল তখন বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) প্রাথমিকভাবে ভোটার আইডি হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল। এর সঙ্গে সর্বসাম্প্রতিক মাইক্রো চিপ, বায়োমেট্রিক আইডি (১০ আঙুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ নিরীক্ষা) যুক্ত হয়ে এখন এনআইডি গাড়ি ও সিম কার্ড নিবন্ধন, পাসপোর্ট আবেদন, কিছু ব্যাংকিং ট্রানজেকশন পরিচালন, ট্রেড লাইসেন্স, কর পরিশোধ, শেয়ার ট্রেডার এবং আরো ২২টি ক্ষেত্রে ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

অবশ্য ভারত আধারের মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ সুফলপ্রদায়ী সেবা প্রদান করে, আমাদের এনআইডি এদিক থেকে অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি মাইক্রোফিন্যান্স প্রতিষ্ঠান (এমএফআই), মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) এবং আরো কিছু বিষয়সহ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ওপর নজর দিয়েছে। আলোচ্য কার্ডের মাধ্যমে পেমেন্ট ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে এটি ব্যাপকভাবে সাপোর্ট দেবে এবং ভারতের মতো আমাদের অর্থনীতিকে সহায়তা করবে। অধিকন্তু, এনআইডির সঙ্গে কর আহরণের একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া প্রবর্তন নিশ্চিতভাবে সরকারের রাজস্ব বাড়াবে।

 

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন