বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ এখন
বাংলাদেশ। বায়ু মানসংক্রান্ত তথ্য সেবাদাতা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ‘২০১৯
ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি রিপোর্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণকারী দেশগুলোর তালিকায়
বাংলাদেশ এখন শীর্ষে এবং সবচেয়ে বেশি দূষিত রাজধানীর তালিকায় ঢাকার অবস্থান এখন
দ্বিতীয়। সন্দেহ নেই, গত কয়েক বছরের নির্মাণযজ্ঞের কারণে ঢাকার বায়ুদূষণ মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
গত ৪০ বছরে ঢাকা শহরে সুউচ্চ ভবন ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ৭৫ শতাংশ চাষযোগ্য জমি
হারিয়ে গেছে। এছাড়া নন-কমপ্লায়েন্স শিল্প ও অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে শহরের বাতাস
এবং ভূপৃষ্ঠের পানি দূষিত হচ্ছে। বাংলাদেশে পরিবেশের মারাত্মক সমস্যাগুলোর অন্যতম
বায়ুদূষণ। শহরে বায়ুদূষণের প্রধান তিনটি উপাদান হলো শিল্প-কারখানা, যানবাহনের
ধোঁয়া ও অবকাঠামো নির্মাণ। বায়ুদূষণের উপাদানগুলো মূলত ধূলিকণা, সালফার
ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন
অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন, কার্বন মনোঅক্সাইড,
সিসা ও অ্যামোনিয়া। অপরিকল্পিতভাবে শিল্প-কারখানা
স্থাপনে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোয় বায়ুদূষণ ক্রমে বাড়ছে। ক্ষতিকর উপাদানগুলোর ব্যাপক
হারে নিঃসরণ ঘটছে। এ কারণে বিশেষ করে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে (আইকিউ) ও
স্নায়বিক ক্ষতি হতে পারে এবং গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকি
বৃদ্ধি পেতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশে
দূষণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে বায়ুদূষণ। দূষণজনিত মৃত্যুর দুই-তৃতীয়াংশের
পেছনে রয়েছে এ ধরনের দূষণ। দূষণ বিভিন্ন প্রকার, যেমন বায়ু, পানি, জ্বালানি, স্যানিটেশন, পরিবেশ
ইত্যাদি। তবে এর মধ্যে বায়ুদূষণে মৃত্যুর হার বেশি হলেও এ ব্যাপারে আমাদের সচেতনতা
এখনো কম। এ ধরনের দূষণের প্রধান দুটি উপাদান হলো শিল্প-কারখানার
বর্জ্য ও যানবাহনের ধোঁয়া। নন-কমপ্লায়েন্স শিল্প ও অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে বিশেষত শহরের
বাতাস দূষিত হচ্ছে অধিক হারে। বাতাসে থাকা রাস্তাঘাট ও নির্মাণাধীন বিভিন্ন
স্থাপনার ধূলিকণা, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড,
হাইড্রোকার্বন, কার্বন মনোঅক্সাইড, সিসা
ও অ্যামোনিয়া বায়ুদূষণের জন্য বহুলাংশে দায়ী। ইটভাটার ধোঁয়া এ ধরনের দূষণের আরেকটি
বড় কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে,
এরূপ দূষণের সঙ্গে দারিদ্র্য, অস্বাস্থ্য
ও সামাজিক অবিচারের বিষয়গুলো অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
বায়ুদূষণের কারণগুলোর মধ্যে ইটভাটার
পরই রয়েছে ধুলাবালি। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন
ভবন। কিন্তু এসব স্থাপনা তৈরির সময় মানা হচ্ছে না ইমারত নির্মাণ বিধি। ভবন তৈরির
সময় সেগুলো কোনো কিছু দিয়ে ঢেকে দেয়া বা পানি ছিটিয়ে কাজ করার প্রবণতা একদম নেই।
এসব তদারকের কার্যকরী ব্যবস্থা বা নীতিমালার অভাবও লক্ষণীয়। ফলে ধুলা উড়ছে বাতাসে।
দূষিত হচ্ছে বায়ু। এছাড়া ফুটপাতের উন্নয়ন,
ইউলুপ ও উড়াল সেতু নির্মাণ, পয়োনিষ্কাশন
ব্যবস্থার জন্য খোঁড়াখুঁড়ি তো চলছেই। এসব উন্নয়ন প্রত্যাশিত হলেও দেখা যায় কোনো
কাজই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। ফলে বায়ু দূষিত হচ্ছে। ঢাকা শহরসহ অন্যান্য বড়
শহরে অনেক সময় দেখা যায় ড্রেনের ময়লা রাস্তার পাশে জমিয়ে রাখা হয়। একসময় এগুলো
শুকিয়ে ধূলিকণায় পরিণত হয় এবং পরিবেশ দূষিত করে। আবার সিটি করপোরেশনের ময়লার
গাড়িগুলো অধিকাংশ সময় না ঢেকেই ময়লা বহন করে,
ফলে বায়ুদূষণ হয়। বোঝাই যাচ্ছে বায়ুদূষণের পেছনে
অনেক কারণ রয়েছে। ফলে এ সমস্যা সমাধানে একটি সামগ্রিক চিন্তা ও পরিকল্পনা জরুরি।
সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও কর্তৃপক্ষ সমন্বিতভাবে কোনো উদ্যোগ নিতে না পারলে
পরিস্থিতি সামনের দিনগুলোয় ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেইজিংয়ের
জ্বালানি কাঠামো, শিল্পের কাঠামো,
যোগাযোগ কাঠামো সুসংহত করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে
বায়ুদূষণ প্রতিরোধে কাজ করা হয়েছে। গত বছর পরিচ্ছন্ন জ্বালানি সংস্কার, গ্রামে
কয়লা ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংস্কার করা হয়েছে। এছাড়া বেইজিং কর্তৃপক্ষ
কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ, পরিবেশবান্ধব প্রতিষ্ঠান বা কর্মকাণ্ডকে অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্রদান এবং
পরিবেশ সুরক্ষার মানদণ্ড প্রণয়ন করাসহ বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে বায়ুদূষণ প্রতিরোধ
পরিচালনার মান সার্বিকভাবে উন্নতি করেছে। ২০১৩ সালে চীনে ‘বায়ুদূষণ
প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম’ প্রকাশিত হয়। এটি বায়ুদূষণ প্রতিরোধে একটি মাইলফলক। গত পাঁচ বছরে
দূষণমুক্ত জ্বালানির ব্যবহার বাস্তবায়ন,
কয়লা ব্যবহারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ, সিমেন্ট
ও রাসায়নিক পদার্থসংশ্লিষ্ট শিল্প রূপান্তরের মাধ্যমে বায়ুর মান উন্নত করা হয়েছে।
চীনের জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন শহরে পিএম১০ আগের চেয়ে ২০ শতাংশেরও বেশি হ্রাস হয়েছে।
বাংলাদেশেও একই ধরনের ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিতে হবে।
বায়ুদূষণ রোধসহ পরিবেশ রক্ষায়
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের আওতায় পরিবেশ অধিদপ্তর ‘নির্মল
বায়ু এবং টেকসই পরিবেশ প্রকল্প’ বাস্তবায়নের পথে থাকলেও শুধু এ প্রকল্প দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়া
যাবে না। যেসব সুনির্দিষ্ট কারণে বায়ুদূষণ হচ্ছে, সরকারকে সেসব দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
পরিবেশ দূষণ ও পরিবেশ সংরক্ষণ বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এ বিষয়ে
আমাদের সচেতনতা আছে কিন্তু নেই সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ ও অভিজ্ঞতা, যা
কাজে লাগিয়ে বাস্তবায়ন করা যায় বসবাসযোগ্য পরিবেশ। জাতীয়ভাবে পরিবেশ রক্ষার জন্য
এবং পানি সুরক্ষার জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত, সচেতন
হওয়া উচিত। সর্বোপরি পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও
বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।