যেভাবে আধুনিক রূপচর্চায় রয়ে গেছে প্রাচীন মিশরের প্রভাব

বণিক বার্তা অনলাইন

আধুনিক রূপচর্চার পথিকৃৎ ছিলেন প্রাচীন মিশরীয়রা। মিশরের রাজা-রানি, নারী-পুরুষ, ধনী-গরীব সবাই কমবেশি রূপচর্চা করতো। তবে বিখ্যাত দুই রানি ক্লিওপেট্রা ও নেফারতিতির কথা সবার থেকে আলাদা। বিশেষ করে রানি ক্লিওপেট্রার রূপের রহস্য নিয়ে আজো কৌতূহলের কমতি নেই। ওই সময়েই মিশরীয়রা চোখ আর ঠোঁট রাঙাতে হুলস্থূল কাণ্ড বাঁধিয়ে দিত! সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান তো বটেই প্রতিদিনের রুটিনেও ছিল রূপচর্চা। অবশ্য শুধু সৌন্দর্য চর্চার জন্যই নয়- ধর্মীয় আচারে প্রতীকী অর্থে, কুনজর থেকে নিরাপদ থাকতে এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্যও প্রসাধনী ব্যবহার করতো মিশরীয়রা। 

খ্রিস্টপূর্ব ২০৩০ থেকে ১৬৫০ সালের কথা। ধনী মিশরীয় নারীরা তখন প্রসাধনীর সর্বোচ্চ ব্যবহার করতেন। যে কোনো মেকআপ প্রয়োগ করার আগে তারা প্রথমে ত্বক কমল করতে নানা উপায় অবলম্বন করতেন। এজন্য সামর্থ্যের ওপর ভিত্তি করে কেউ দুধ দিয়ে গোসল করতেন, আবার কেউ গায়ে মাখতেন মৃতসাগরের লবণ। কথিত আছে, রানি ক্লিওপেট্রা দৈনিক ২০টি গাধার দুধ দিয়ে গোসল করতেন। দুধ ও মধুর ফেসমাস্ক ছিল দারুণ জনপ্রিয়। বগলের দুর্গন্ধ দূর করতে ব্যবহার করা হতো সুগন্ধী ধুপ। বলা যেতে পারে আধুনিককালের ডিওডরেন্ট। নরম কোমল ত্বক পেতে ময়েশ্চারাইজার হিসেবে ব্যবহার করা হতো ফুলের নির্যাস বা সুগন্ধি মশলাযুক্ত তেল।

এখানেই শেষ নয়, মিশরীয় নারীরাও শরীরের অবাঞ্ছিত লোম নিয়ে বেশ সতর্ক ছিলেন। আজকাল আবাঞ্ছিত লোম তুলে ফেলতে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, রেজার, বিশেষ ক্রিমসহ নানা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া প্রাকৃতিক মধু আর চিনি মিশ্রণ ব্যবহার করে লোম তুলতে যে আধুনিককালের ‘সুগারিং’ পদ্ধতি সেটিও কিন্তু ক্লিওপেট্রার আমলেরই। অথচ হালের মানুষও বেশ যন্ত্রণাদায়ক ওয়াক্সিং ব্যবহার করে। যেখানে প্রাচীন মিশরীয়দের সুগারিং পদ্ধতি এই গরম মোম ঢালার চেয়ে কম যন্ত্রণার।

মেকআপের নানা উপাদান রাখার পাত্রগুলোও ছিল সৌখিন। বহু মূল্যবান কাচ, স্বর্ণ বা পাথরের বাটি ইত্যাদি ধাতব ও পাথরের পাত্রে চমৎকার কারুকার্য থাকতো। অবশ্য সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী  এসব পাত্রের উপাদান ও কারুকার্যে কমবেশি হতো। অভিজাতরা ক্যালসাইটের (ক্যালসিয়াম কার্বোনেট শিলা) পাত্রে রাখা হতো মেকআপ আর সুগন্ধি। কাজল ও আইশ্যাডো রাখতে ব্যবহৃত হতো সিলস্টোন প্যালেট। এসব পাত্রে যা বিভিন্ন প্রাণী, দেবদেবী বা যুবতীদের প্রতিকৃতি খোদাই করা থাকতো।

ম্যালাকাইটের (কপার কার্বোনেট শিলা বা সবুজ রত্নপাথর) গুঁড়ার সঙ্গে প্রাণীর চর্বি বা উদ্ভিজ্জ তেল (যেমন: অলিভ অয়েল) মিশিয়ে তৈরি করা হয় আইশ্যাডো। রূপচর্চার জন্য অভিজাতরা নারীরা বসতেন পলিশ করা ব্রোঞ্জের আয়নার সামনে। এরপর কোনো দক্ষ দাস লম্বা একটি হাতির দাঁতের তৈরি কাঠি দিয়ে প্রথমে চোখে কাজল দিয়ে দিতো। এরপর দেয়া হতো আইশ্যাডো, এর রঙ হতো সবুজ। ক্লিওপেট্রার আইশ্যাডো অবশ্য ছিল নীল রঙের হতো। চোখের উপরে আর নিচে টানা হতো কালো কাজলের দাগ। কাজল নারী-পুরুষ সবাই পরতো। কেবলমাত্র সৌন্দর্যের জন্যই নয়, এটি মরুভূমিতে সূর্যের প্রখর আলো থেকে চোখকে রক্ষা করতো। তাছাড়া এসব উপাদান যেসব খনিজ থেকে সংগ্রহ করার হতো সেগুলো সীসাযুক্ত। ফলে চোখে কাজল লাগানোর পর আর্দ্রতার সংস্পর্শে সেটি ব্যাকটেরিয়ারোধী হিসেবে কাজ করতো।

সবশেষে আসে ঠোঁটসজ্জা। লিপস্টিক ছাড়া তখনও মেকাপ পূর্ণতা পেত না। সে সময়ে গেরুয়া মাটির সঙ্গে প্রাণীর চর্বি বা তেল মিশিয়ে তৈরি হতো লিপস্টিক। তবে রাণী ক্লিওপেট্রার লিপস্টিক ছিল আলাদা। তিনি নিখুঁত লাল রঙ পেতে লাল গোবরে পোকা শুকিয়ে বানানো পাউডার মেশাতেন। অনেক সময় মেকআপের সমস্ত উপাদান আয়োডিন ও ব্রোমিন ম্যানাইট খনিজ থেকে তৈরি রঙ মেশানো হতো। এসব খনিজ অত্যন্ত বিষাক্ত। মারাত্মক অসুস্থতার পাশাপাশি মৃত্যুও ডেকে আনতে সক্ষম এই ওষ্ঠরঞ্জনী। ‘মৃত্যু চুম্বন’ প্রবাদটি সম্ভবত এখান থেকেই এসেছে।

প্রাচীন মিশরীয়দের রূপচর্চার সঙ্গে যে ধর্মীয় বিশ্বাসেরও যোগ ছিল তার প্রমাণ মিলেছে একাধিক মমিতে। কারণ অনেক সমাধিতে মিলেছে চিরুনি, মলম, অলঙ্কার ও প্রসাধনী। মমি এবং মুখোশের কারুকার্যেও এ বিষয়টি স্পষ্ট। বলা যায়, স্থাপত্যশিল্পের পাশাপাশি আধুনিক রূপচর্চাতেও আধুনিককালে প্রাচীন মিশরীয় সংস্কৃতির আধিপত্য স্পষ্ট।

সিএনএন অবলম্বনে 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন