১৮৫৭ সাল। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখা দেয় সিপাহি বিদ্রোহের চেহারায়। যার ধারাবাহিকতায় অবসান ঘটে কোম্পানি শাসনের। শুরু হয় ব্রিটিশরাজ। নিভে যায় মোগলদের শাসনপ্রদীপ। শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের স্নেহধন্য সভাকবি জহির দেহলভির ওই সময়ের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থকে ইংরেজিতে ‘দাস্তান-ই-গদর: দ্য টেল অব দ্য মিউটিনি’ নামে প্রকাশ করেছে পেঙ্গুইন র্যানডম হাউজ ইন্ডিয়া। সিপাহি বিদ্রোহের এ অমূল্য দলিলটিকে বাংলায় প্রকাশের স্বত্ব পেয়েছে বণিক বার্তা। শানজিদ অর্ণবের রূপান্তরে ধারাবাহিক আয়োজন—
আমার
পূর্বপুরুষ
যা
শোনা যাচ্ছিল, সেগুলো যেন প্রত্যক্ষ করা হয়েছিল
এই
সামান্য মানুষ, জহিরের কুলুজির শুরু সেই শের-ই-খোদা হজরত আলী মুর্তাজা থেকে। আমার
সতেরোতম পূর্বপুরুষ ছিলেন হজরত শাহ নিমাতুল্লাহ ওয়ালি রহমাতুল্লাহ আলাইহি এবং
অষ্টম পূর্বপুরুষ ছিলেন ইমাম রেজা,
আলাইহিস সালাম।
শাহ নিমাতুল্লাহ ওয়ালির পৌত্ররা ছিলেন শাহ নুরুল্লাহ, শাহ হাবিব ও শাহ মোহিবুল্লাহ। তার উত্তরসূরি ছিলেন শাহ খলিলুল্লাহ
ইবনে শাহ নিয়ামাতুল্লাহ ওয়ালি। নিয়ামাতুল্লাহ ওয়ালি ছিলেন বাহমানি সাম্রাজ্যের
শাসক আলা-উদ-দিন
হাসান বাহমান শাহের আধ্যাত্মিক গুরু। এ কারণে দাক্ষিণাত্যের বিদারে তার সমাধি
নির্মিত হয়েছিল। সমাধিটি এখনো বর্তমান।
আমার অন্য পূর্বপুরুষরা তৈমুর বংশীয় রাজাদের দরবারে উচ্চপদে আসীন ছিলেন। বাহাদুর শাহ জাফরের শাসনামলে আমার পিতা হজরত শাহ সৈয়দ জালালুদ্দিন হায়দারকে হাল্লাজ-উদ-দৌলা উপাধি দেয়া হয়েছিল। এছাড়া তাকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধিও দেয়া হয়েছিল। এরপর পদোন্নতি দিয়ে তাকে সম্রাটের একজন ওস্তাদের মর্যাদা দেয়া হয়। আমার বয়স যখন বারো বছর, তখন আমাকে দরবারে হাজির করা হয়। তারপর শিগগিরই দারোগা হিসেবে আমার প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গেল। প্রথমেই আমাকে দরবারের আদবকেতা ও ঘোড়ায় চড়া শেখানো হয়। শেখার প্রতি আমার আগ্রহের কারণে কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে রাকিম-উদ-দৌলা দারোগা-ই-কাজবেগি পেশগাহ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এ নগণ্য মানুষকে এবার নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হতে লাগল।
শিক্ষা
আমার
বিসমিল্লাহ (আনুষ্ঠানিক শিক্ষাশুরুর অনুষ্ঠান) উৎসব করে পালন করা হয়েছিল। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দাওয়াত করা
হয়েছিল এবং দুদিন ধরে নাচ-গান অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বেশ কয়েক দিন ধরে
টাকা ও উপহার বিতরণ করা হয়। বাবা মাঝে মাঝেই আমাকে বলতেন, আমার বিসমিল্লাহর দিন আত্মীয়স্বজনরা আমার হাতে একটি স্বর্ণমুদ্রা
দিয়েছিলেন। আমার বিসমিল্লাহ এমন ধুমধাম করে পালন করা হয়েছিল যে, তার তুলনায় আমার বিয়ের অনুষ্ঠান ম্যাড়মেড়ে হয়ে গিয়েছিল।
বিসমিল্লাহর
পর আমাকে একটি বিদ্যালয়ে পাঠানো হলো। আমার শিক্ষকের দায়িত্ব দেয়া হলো ওস্তাদ শেখ
সফদার আলীকে। সমবয়সী আরো অনেক শিশুই আমার শ্রেণীতে যোগ দিল। বর্ণমালা শেখার পর আমি
কুরান-ই-মাজিদ ও পন্দনামা-ই-সাদি পড়া শুরু করেছিলাম। কুরান-ই-মাজিদ শেষ হতে হতে শেখ সাদির গুলিস্তাঁ
ও বোস্তাঁ আমার পড়া হয়ে গিয়েছিল। তারপর আমি বাহার-ই-দানিশ, ইউসুফ-জুলেখাসহ
আরো অনেক সাহিত্য ও কবিতার সংকলন পড়া শুরু করে দিই।
আমার
প্রয়াত শিক্ষক শেখ সাহেবের সঙ্গে আমি এমনকি আবুল ফজলের লেখা গ্রন্থ ও
সিকান্দারনামা (নিজামী গজনবীর লেখা) পড়ে ফেলি। বিভিন্ন শিক্ষকের নির্দেশনায় আমি পারস্যের মহান লেখক ও
কবিদের অনেক বই পড়েছি। ফারসি সাহিত্য পড়ার পর মাদ্রাসায় সৈয়দ জাফর আলীর
তত্ত্বাবধানে আমি আরবি সাহিত্য পড়া শুরু করি। বারো বছর বয়সেই আমি শিক্ষকতার সুযোগ
পেয়ে যাই। রাজদরবারে কাজ পেয়ে যাওয়ায় আমি আমার আরবি সাহিত্য অধ্যয়ন গভীরভাবে করতে
পারিনি।
আমার
কবিজীবনের শুরু
কাব্যের
মধুর জগতের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে যখন আমি বাহার দানিশ ও জুলেইখা পড়তাম। এ সময় আমি
আকস্মিকভাবে বাবা ও তার বন্ধু মিয়া নবী বকশ সাহেবের মধ্যে চলা কাব্য আলোচনা শুনে
ফেলেছিলাম। তিনি আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। মিয়া সাহেব ছিলেন শাহ নাসিরের
পৌত্র। আমি যে কক্ষে অধ্যয়ন করতাম,
সেখানেই তারা
কবিতা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। মিয়া নবী বকশ সাহেব একজন বিখ্যাত কবির কবিতা আবৃত্তি
করার পর আমার বাবা প্রশংসা করে বলে ওঠেন,
‘কী খাসা মাতলা।
সুবাহানআল্লাহ!’
দ্বিপদীটা
ছিল এ রকম—
দেখতে
দাও প্রিয়ার দৃষ্টি কতক্ষণে আমার ওপর থেকে টলে যায়
আর
আমাকে দেখতে দাও যতক্ষণ দিন-রাতের আবর্তন নিরন্তর চলতে থাকে
মাতলা
শব্দটা শোনার পর আমি কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলাম। আমি বাবার কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, ‘মাতলা শব্দের অর্থ কী এবং মাতলা আসলে কী?’
বাবা
আমাকে মাতলা ও মাকতার অর্থ বুঝিয়ে দিলেন:
‘ছন্দে শুরুর
স্তবকে উভয় লাইনেই কাফিয়া থাকে এবং এটাকে মাতলা বলে। আর যে স্তবকে শুধু দ্বিতীয়
লাইনে কাফিয়া আনে সেটা শের’র।’
বাবা
এরপর গজল লেখার নানা ধরনের নিয়ম আমাকে ব্যাখ্যা করে বোঝালেন।
আমি
এসব নিয়ম আত্মস্থ করতে পেরেছিলাম এবং বাবা যেসব পদ্য আবৃত্তি করেছিলেন, সেগুলোও আমি মুখস্থ করেছিলাম। আমি তখনই বাবার মতো একই স্বর ও ছন্দে
সেসব কবিতা আবৃত্তি করি। শুনে আমার বাবা ও মিয়া নবী বকশ সাহেব উভয়ই খুব খুশি হন।
মিয়া সাহেব খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরে দোয়া করে বলেন, ‘তুমি
একদিন অপ্রতিম এক কবি হয়ে উঠবে।’
আমি
যে মাতলা ও কবিতা আবৃত্তি করেছিলাম:
দেখা
যাক আগন্তুকদের সঙ্গ কতক্ষণ টেকে
দেখো
কতক্ষণ এই থাকা ও না থাকা টিকে থাকে
আগন্তুক
থেকে, হে প্রিয়,
তোমার হূদয়
স্ফটিক স্বচ্ছ
কবে
আমি এই স্ফটিকের ওপর ধুলো নিক্ষেপ করব?
বুজুর্গদের
এই প্রশংসা বারুদে স্ফুলিঙ্গ সঞ্চার করেছিল এবং আমার মনে কবিতার প্রতি এক আবেগের
বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। এই আবেগ দিন দিন বেড়েই চলছিল।
এমন
একটা অবস্থা হয়েছিল যে, কোনো শের শুনলেই সেটা আমি মুখস্থ করে
ফেলতাম। বাড়ির গ্রন্থাগারে আমি অনেক ফারসি দিওয়ান খুঁজে পেয়েছিলাম। পারস্যের
কবিদের কবিতার ওপর অনেক বিশ্লেষণমূলক বইও ছিল। আমি সেগুলো পড়া শুরু করি।
আমি
তখনকার নামি-দামি উর্দু কবির লেখা প্রতিটি গজল
পড়েছি। তখন লক্ষৌতে দিওয়ান-ই-নাসিখ
ও আতিশসহ উর্দু কবিতার বিভিন্ন শৈলীর ওপর কিছু বই ছাপা হয়েছে এবং সেগুলো দিল্লিতে
এসে গেছে। এসব বইয়ের পাতায় উঁকি মারাটা আমার স্বভাব হয়ে গিয়েছিল। আমি কয়েকটা গজল
লিখে সেগুলো মিয়া নবী বকশ সাহেবকে দেখিয়েছিলাম। অবশ্য আমার বাবা আমাকে কবিতা লেখা
থেকে বিরত করতে চাইলেন। যদিও তিনি নিজেই একজন ভালো কবি ছিলেন। শাহ নাসির সাহেব
আমার বাবার ছাত্র ছিলেন।
হাফিজ
কুতুবউদ্দিন সাহেব ছিলেন মরহুম শাহ নাসিরের ছাত্র। এ সময় কুতুবউদ্দিন সাহেব শাহ
সাহেবের বাড়িতে একটি মুশায়রার আয়োজন করেছিলেন। এই মুশায়রা যে বাড়িতে হয়েছিল, সেটা আমার বাড়ির খুব কাছে ছিল বিধায় আমি সেই মুশায়রায় অংশ নিই। এখানেই
আমি আমার জীবনে প্রথমবারের মতো স্বরচিত গজল পাঠ করি। আমি খাকানি-ই-হিন্দ শেখ মোহাম্মদ ইব্রাহিম জকের
ছাত্র হিসেবে শিক্ষাগ্রহণ শুরু করি। কবি দাগও ছিলেন এই মুশায়রায়। এছাড়া আরো অনেক
বিখ্যাত কবি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমার বয়স তখন প্রায় চৌদ্দ। সেই মুশায়রার পর
দিল্লিতে আরো অনেক মুশায়রা হয়েছে,
কিন্তু আমি
সেগুলোর কোনোটিতে অংশ নিইনি। আমি নিজেই নিজের কবিতাকে পরীক্ষা করে দেখছিলাম।
হজরত
ওস্তাদ শাহ নাসির সাহেবকে দেখতে যাওয়ার সুযোগ খুব কম মিলত। আমি মাত্র এক বা দুবার
তাকে আমার গজল দেখাতে পেরেছি। তবে তার স্নেহপূর্ণ সঙ্গ থেকে দারুণভাবে উপকৃত
হয়েছিলাম। আমি নিজের লেখা গজল তার সামনে উপস্থাপন করেছিলাম, যেন তিনি সেগুলো একটু ঠিকঠাক করে দেন এবং তার পরামর্শও চাইতাম। আমার
লেখা মাকতা পড়ে তিনি খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
তিনি
আমাকে দোয়া করে বলেছিলেন, ‘ইনশাআল্লাহ! তুমি একদিন বড় কবি হবে।’ শাহ নাসির সাহেবের সে প্রশংসাই আমাকে
কবিতা লেখার যোগ্য করে তুলেছে। তার মৃত্যুর পর আমি কয়েকটা কাসিদা ও গজল লিখেছিলাম।
হায়! বিদ্রোহের অশান্তিতে সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। দুটি গজলই কেবল টিকে আছে।
সেগুলো জনপ্রিয় হয়েছিল এবং মানুষ গজলগুলো মনে রেখেছে। কয়েকটি কবিতা আমারও মনে আছে, কিন্তু বাকিগুলো চিরতরে হারিয়ে গেছে; যা
আমার স্মরণ আছে, সেটা একটা কাসিদার কিছুটা অংশ।
আমি
পাটিয়ালার মহারাজা অজিত সিংয়ের অনুরোধে একটি গজল লিখেছিলাম। এজন্য আমি ১ হাজার
রুপি পুরস্কার পাই। মাতলার জন্য ২০০ ও চারটা দ্বিপদীর জন্য ৮০০ রুপি পেয়েছিলাম।
শিক্ষক
ও সমসাময়িকেরা
হাকিম
মোমিন খান সাহেব ও শেখ মোহাম্মদ ইব্রাহিম জাকের মৃত্যুর পর ছাত্ররা কয়েকজন বিশিষ্ট
কবির কাছে শিক্ষা নিতে ছুটে যায়। এ বিশিষ্ট কবিদের মধ্যে ছিলেন মির্জা আসাদুল্লাহ
খান সাহিব গালিব, মুফতি সদরুদ্দিন খান সাহেব আজুরদা, হাকিম আগা জান সাহেব আইশ,
গুলাম আলী খান
সাহিব ওয়াশাত ও নওয়াব মুস্তাফা খান সাহেব শেফতা।
এ
মহান কবিদের তুলনায় আমরা নিতান্ত শিক্ষানবিশ ছিলাম। আমাদের এ শিক্ষানবিশ দলের
মধ্যে সবচেয়ে ভালো কবি ছিলেন মির্জা জয়নুল আবিদিন খান সাহেব আরিফ।
প্রতি
সন্ধ্যায় আমরা সমমনা বন্ধুরা একত্র হতাম এবং বেশ সমঝদারির সঙ্গে আমরা আমাদের কবিতা
আবৃত্তি করতাম। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ পর্যন্ত কবিতার এ বাগানে ফুল ফুটেছে এবং বিকশিত
হয়েছে। আমিও এ বাগানের অংশ ছিলাম।
আহ! সবকিছু কেমন ছিল আর কী হয়ে গেল!
বিদ্রোহের পর
কবিতার বাগান ধ্বংস হয়ে গেছে।