ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

৪৯% শেয়ার কিনে নিল দুই চীনা প্রতিষ্ঠান

শামীম রাহমান

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মিত হচ্ছে ঢাকা-এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) এ প্রকল্পটিতে বিনিয়োগ করে থাইল্যান্ডভিত্তিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড, যেটি ইতালথাই নামেও পরিচিত। এ প্রকল্পে শুরু থেকেই অর্থসংকটে ভুগছিল প্রতিষ্ঠানটি। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ধরনা দিয়েও জোগাড় করতে ব্যর্থ হয় এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের প্রয়োজনীয় অর্থ। তাই অর্থসংকট কাটাতে চীনের শ্যাংডং ইন্টারন্যাশনালে ৩৪ শতাংশ ও সিনো-হাইড্রো করপোরেশনের কাছে ১৫ শতাংশ শেয়ার বেচে দিয়েছে তারা। এর মধ্য দিয়ে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের অর্ধেক মালিকানা চলে গেল দুই চীনা কোম্পানির হাতে।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে মোট ব্যয় হবে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। পিপিপির ভিত্তিতে এর নির্মাণকাজ পাওয়ার পর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি কোম্পানিও গঠন করে ইতালথাই। এ কোম্পানির মাধ্যমে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, ২৫ বছর পরিচালনা (সাড়ে তিন বছর নির্মাণকালসহ) এবং টোল আদায় করা হবে। টোল আদায়ের মাধ্যমে বিনিয়োগ করা টাকা তুলে নেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান।

এক্সপ্রেসওয়ের নির্বাহক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ইতালথাইফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেড নামের যে কোম্পানি গঠন করে, তাতে ইকুইটির পরিমাণ নির্মাণ ব্যয়ের ৩১ শতাংশ। অন্যদিকে ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ড বা ভিজিএফ ২৭ শতাংশ, যা সরকার দিচ্ছে। নির্মাণ ব্যয়ের বাকি ৪২ শতাংশ অর্থ সংগ্রহ নিয়ে সংকটে পড়ে ইতালথাই। অর্থসংকটের প্রভাব সরাসরি এসে পড়ে এক্সপ্রেসওয়েটির নির্মাণকাজে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, প্রকল্পটির জন্য নেয়া বিদেশী ঋণের অর্থ পরিশোধও চলছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেডের পরিশোধিত আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণপ্রবাহ ছিল ৪০ লাখ ডলার।

সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইতালথাই এক্সপ্রেসওয়েটিতে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে পারেনি। এ কারণেই পিছিয়ে যেতে শুরু করে নির্মাণকাজ। নির্ভরযোগ্য মনে না করায় ইতালথাইকে ঋণও দিচ্ছিল না ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে চীনের দুই প্রতিষ্ঠান শ্যাংডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল করপোরেশন গ্রুপ লিমিটেড (সিএসআই) ও সিনো-হাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানির যথাক্রমে ৩৪ ও ১৫ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় প্রতিষ্ঠান দুটি। প্রকল্পটিতে বিনিয়োগের জন্য ৭ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠান দুটি এক্সপ্রেসওয়ের ৪৯ শতাংশ মালিকানা পেয়েছে।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য শ্যাংডং ও সিনো-হাইড্রোকে ঋণ দিয়েছে চীনের দুটি ব্যাংক। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ দিয়েছে ৩ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। বাকি ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না (আইসিবিসি)

জানতে চাইলে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক এএইচএম শাখাওয়াত আকতার বণিক বার্তাকে বলেন, এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে এখন থেকে তিনটি কোম্পানি বিনিয়োগ করবে। এর মধ্যে ইতালথাই ৫১ শতাংশ, শ্যাংডং ইন্টারন্যাশনাল ৩৪ শতাংশ ও সিনো-হাইড্রো করপোরেশন বাকি ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ করবে।

গতকাল সেতু ভবনে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিনিয়োগ-বিষয়ক দুটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেড ও ঋণদাতা এক্সিম এবং আইসিবিসির মধ্যে। ৭ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা ঋণ-বিষয়ক এ চুক্তিতে এক্সিম ও আইসিবিসির পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে সিটি ব্যাংক এনএর ঢাকা ব্র্যাঞ্চ। অন্য চুক্তিটি ছিল প্রকল্পটিতে সরকারের ভিজিএফ-বিষয়ক। এটি স্বাক্ষর হয় সরকারের আর্থিক বিভাগের পিপিপি ইউনিট, ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেড ও ঋণদাতা এক্সিম এবং আইসিবিসির মধ্যে। এতেও ব্যাংক দুটির পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে সিটি ব্যাংক এনএ, ঢাকা ব্র্যাঞ্চ।

চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প নিয়ে অনেক সমস্যা ছিল। মূল সমস্যা ছিল অর্থায়ন নিয়ে। বারবার কাজ পিছিয়ে যাচ্ছিল। এজন্য জনগণের অনেক প্রশ্ন ছিল। সাংবাদিকরাও বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তুলেছেন। ধীরগতির জন্য প্রকল্পটির বাস্তবায়ন নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন অনেকেই। তবে অনেক চেষ্টার পর ইতালথাই ফান্ডিংয়ের একটা সুব্যবস্থা করেছে। এর মাধ্যমে গোটা প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে। সময়মতো কাজ শেষ হবে বলে আমরা আশাবাদী। এতদিন অর্থায়ন সমস্যা থাকলেও নির্মাণকাজ কিন্তু থেমে ছিল না, কিছুটা ধীরগতি ছিল। এখন দ্রুত এর নির্মাণকাজ শেষ হবে।

তিন ধাপে বাস্তবায়ন হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। প্রথম ধাপে বিমানবন্দর-বনানী, দ্বিতীয় ধাপে বনানী-তেজগাঁও ও তৃতীয় ধাপে মগবাজার-কুতুবখালী অংশে কাজ হবে। বর্তমানে বিমানবন্দর-বনানী অংশে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ চলছে। সম্প্রতি শুরু হয়েছে বনানী-তেজগাঁও অংশের কাজ। পরিকল্পনাধীন অবস্থায় রয়েছে মগবাজার-কুতুবখালী অংশটি। কয়েক দফা পেছানোর পর প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি ১৮ শতাংশ।

বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত যাবে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এতে মূল সড়ক হবে ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। নকশায় সংস্থান রাখা আছে ৩১টি র্যাম্পের, যেগুলোর দৈর্ঘ্য আরো ২৭ কিলোমিটার। সরকারের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার (আরএসটিপি) তথ্যানুযায়ী, বাস্তবায়নের পর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার যানবাহন চলাচল করতে পারবে। পুরো এক্সপ্রেসওয়েটিতে থাকবে ১১টি টোলপ্লাজা, এর মধ্যে পাঁচটি হবে এক্সপ্রেসওয়ের ওপর। প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনসহ আনুষঙ্গিক কাজগুলো এগিয়ে নিতে ৪ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প (সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) বাস্তবায়ন করছে সেতু কর্তৃপক্ষ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন