আইকিউএয়ারের প্রতিবেদন

বিশ্বে বায়ুদূষণে শীর্ষে বাংলাদেশ দ্বিতীয় দূষিত রাজধানী ঢাকা

ফয়জুল্লাহ ওয়াসিফ

রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের বাসিন্দা আব্দুল আজিজ। সাত বছরের মেয়ে মালিহাকে নিয়ে ফার্মগেট এলাকায় মাস্ক কিনছিলেন তিনি। মাস্ক কেনার কারণ জানতেই বললেন, বায়ুদূষণের প্রভাব থেকে বাঁচতে এখন মাস্ক ব্যবহার অপরিহার্য। দূষণ এখন যে মাত্রায় দাঁড়িয়েছে, তাতে শুধু এ ধরনের সচেতনতাও জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা দিতে যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন তিনি।

আব্দুল আজিজের এ আশঙ্কার প্রতিফলন দেখা গেছে বায়ুমানসংক্রান্ত তথ্য সেবাদাতা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের২০১৯ ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি রিপোর্ট শীর্ষক প্রতিবেদনেও। এতে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণকারী দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ এখন শীর্ষে। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি দূষিত রাজধানীর তালিকায় ঢাকার অবস্থান এখন দ্বিতীয়। সরকারি-বেসরকারি উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

তালিকায় থাকা শীর্ষ ১০ দেশের সবই এশিয়ার। বাংলাদেশের পর শীর্ষ তালিকায় থাকা অন্য দেশগুলো হলো পাকিস্তান, মঙ্গোলিয়া, আফগানিস্তান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, বাহরাইন, নেপাল, উজবেকিস্তান ও ইরাক। বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি বিবেচনায় ৮৩ দশমিক ৩ স্কোর নিয়ে দূষিত রাজধানীর তালিকায় ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। এক্ষেত্রে শীর্ষে থাকা ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির স্কোর ৯৮ দশমিক ৩। এ তালিকায় দ্বিতীয়বারের মতো শীর্ষে অবস্থান করছে প্রতিবেশী দেশের রাজধানী শহরটি।

প্রতিবেদনটি তৈরি হয়েছে বিভিন্ন শহরের সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রকাশিত তাত্ক্ষণিক বা প্রায় তাত্ক্ষণিক সময়ের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৯০ শতাংশ মানুষ যে বাতাস শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করছে, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত বায়ুমানের নিচে। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা মানুষের বড় একটি অংশই বায়ুমান সম্পর্কিত তথ্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত।

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ক্রমাগত বায়ুদূষণের ফলে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ার জীবনমানের ওপর মারাত্মক চাপ পড়ছে। এ অঞ্চলের শহরগুলো বায়ুদূষণের ফলে চরম ঝুঁকিতে আছে। ২০১৯ সালে বিশ্বের দূষিত ৩০টি শহরের মধ্যে ২১টি ভারতের। আর শীর্ষ ৩০-এর ২৭টির অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায়ই। এমনকি ৩০টি শহরের সবই এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অবস্থিত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরবাসীর কাছে যানজটের পাশাপাশি আরেক যন্ত্রণার নাম বায়ুদূষণ। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কবলে নগরজীবন বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে। বাড়িয়ে তুলছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু, বৃদ্ধ ও শ্বাসতন্ত্রের রোগীরা।

এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) ৫১ থেকে ১০০ স্কোর থাকলে বাতাসের মানকে গ্রহণযোগ্য ধরা হয়। সেখানে সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর একিউআই স্কোর ৪০০ ছাড়াতে দেখা গেছে। বিশ্ব একিউআইয়ের তথ্য অনুযায়ী এ বছর জানুয়ারিতে ঢাকার বাতাসের সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ৩১৯। তবে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার বাতাসের স্কোর কখনো ২০০-এর নিচে নামেনি। এ সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ স্কোর দাঁড়িয়েছিল ৪৭৭। ঢাকায় ইউএস কনস্যুলেটের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী এ অবস্থা বিদ্যমান থাকলে একিউআইয়ের সর্বোচ্চ স্কোর ৫০০ ছাড়াতেও পারে।

প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণে ফুসফুসের অক্সিজেন গ্রহণক্ষমতা কমে শ্বাসকষ্ট ক্রমাগত বাড়ে বলে জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, প্রথমে শ্বাসনালি ও চোখে সমস্যা তৈরি করে। ফলে অ্যাজমা ও নিউমোনিয়ার রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে এ দূষিত বায়ু গ্রহণ ব্রঙ্কাইটিস থেকে ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এদিকে বায়ুদূষণের কারণে ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বেশি দেখা দেয় বলে জানান এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়ে চললেও কর্তৃপক্ষ কার্যত কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না এমন অভিযোগ রয়েছে পরিবেশবিদদের। ঢাকার উন্নয়ন প্রকল্পকে ঘিরে সকাল-বিকাল পানি ছিটানো হলেও আশানুরূপ ফল দৃশ্যমান নয়। এ অবস্থায় সিটি করপোরেশনের পানি ছিটানোর কাজে সার্বক্ষণিক তদারক এবং বাতাসের মান স্বাভাবিক ও জীবনযাত্রায় স্বস্তি ফেরাতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। দূষণের মাত্রা যেভাবে বেড়েছে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গাড়ির কালো ধোঁয়া কমানো ও অপরিকল্পিত নির্মাণকাজের লাগাম টেনে ধরা প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকে।

এ প্রসঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল গ্লোবাল অ্যাটমোস্ফিয়ার কেমিস্ট্রির (আইজিএসি) সায়েন্টিফিক স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুস সালাম বণিক বার্তাকে বলেন, পরিবেশ রক্ষা করতে হলে মোটাদাগে যানবাহন, নির্মাণ শিল্প ও কল-কারাখানার দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর মধ্যে বায়ুদূষণকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করতে হবে। সামগ্রিকভাবে সারা দেশকে দূষণের জন্য বিবেচনা করা হলেও রাজধানীর দূষণ এ সূচককে বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন এ পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বর্তমান সময়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দূষণকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আলোকে ঢাকাসহ সারা দেশের বায়ুমান নিয়ন্ত্রণ করার পরামর্শ দেন তিনি।

প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, দেশে বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর প্রাণ হারাচ্ছে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষ। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বায়ুদূষণজনিত বার্ষিক মৃতের গড় সংখ্যা ৪৬ হাজার। অন্যদিকে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্য বলছে, বিশ্বে ৩০ কোটি শিশু দূষিত বায়ু পরিবেষ্টিত এলাকায় বাস করে। এর মধ্যে ২২ কোটিই দক্ষিণ এশিয়ার বাসিন্দা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন